Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অসুর: সুপারস্টার জিতের নবরূপে আত্মপ্রকাশ

কলকাতার ছবি একটা নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। সৃজিত মুখার্জি, কৌশিক গাঙ্গুলী, অরিন্দম শীলের মতো বাঘা বাঘা পরিচালকরা যেমন একের পর এক অসাধারণ ছবি উপহার দিয়ে যাচ্ছেন, তেমনই সৌকর্য ঘোষাল কিংবা মানস মুকুল পালের মতো উদীয়মান নির্মাতারাও নতুন এসেই চমকে দিচ্ছেন সবাইকে।

ফলে এখন আর নাচে-গানে-মারপিটে ভরপুর বাণিজ্যিক ঘরানার ছবির রমরমা দশা নেই সেখানে, ‘কনটেন্ট’ই হয়ে উঠেছে আসল রাজা। দর্শকদের রুচিও গেছে পাল্টে। হয় অনীক দত্তদের মতো হিউমার আর পানিংয়ের মিশেলে গূঢ়ার্থে সন্নিহিত কোনো বার্তা দিতে হবে, কিংবা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়দের মতো মধ্যবিত্ত মা-মাসিদের পাল্‌স্‌ অনুযায়ী আবেগঘন সমাজবাস্তবতা দেখাতে হবে, নতুবা সাহিত্যজগৎ থেকে ফেলুদা-ব্যোমকেশদের তুলে এনে অথবা সম্পূর্ণ মৌলিক কাহিনীর শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার বানাতে হবে। মোদ্দা কথা, ছবি হতে হবে কনটেন্ট-নির্ভর, নায়ক-সর্বস্ব নয়।

তবে বাংলার দর্শকের রুচি পরিবর্তনের এই চরম সত্যটা যেন জেনেও না জানার ভান করে যাচ্ছিলেন কলকাতার বাণিজ্যিক ছবির অন্যতম সুপারস্টার জিৎ। তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দেব যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, এবং ইতোমধ্যেই নিজের ভাবমূর্তি অনেকটা বদলে ফেলতেও সক্ষম হয়েছেন, সেখানে জিৎ চিরাচরিত দক্ষিণী রিমেকে কাজ করেই সন্তুষ্ট ছিলেন।

অবশেষে ‘অসুর’ ছবির মাধ্যমে কনটেন্ট-নির্ভর ছবির জগতে প্রবেশ করলেন তিনি। নতুন এ যাত্রার সূচনায় পরিচালক হিসেবে তিনি পেলেন পাভেল ভট্টাচার্যের মতো পরিচালককে, যিনি এর আগে ‘বাবার নাম গান্ধীজী’ আর ‘রসগোল্লা’-র মতো ছবি বানিয়ে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

এছাড়া এ ছবিতে জিতের পুনর্মিলনী হলো নুসরত জাহান আর আবীর চট্টোপাধ্যায়ের সাথেও। সাংসদ হবার পর নায়িকা নুসরতের প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ এ ছবি। অন্যদিকে বেশ লম্বা একটা বিরতির পর আবারো জিতের সাথে পর্দা ভাগাভাগি কিংবা বাণিজ্যিক ছবিতে ধূসর চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা অভিনেতা আবীরের।

নিজেকে নতুন রূপে চেনালেন জিৎ; Image Source: Jeetz Filmworks

অবশ্য কনটেন্ট-নির্ভর ছবির কথাই যখন হচ্ছে, সেখানে পর্দায় মুখ দেখানো কলাকুশলী কিংবা ক্যামেরার পেছন থেকে নির্দেশনা দেয়া মানুষটির মতোই, সমগুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ছবির গল্পও। আর সেখানেও রয়েছে আরেক চমক। ছবির নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, পৌরাণিক চরিত্র অসুরের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে এ ছবিতে। কিন্তু সেই অসুরকে পর্দায় তুলে ধরার বেলায়ও চেনা ছক থেকে বেরিয়ে এসেছে এ ছবি।

আরেকটু ভাঙিয়ে বলা যাক। এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র কিগান মাণ্ডি (জিৎ)। আর্ট কলেজের শিক্ষক সে। শিল্পই তার ধ্যান-জ্ঞান। শিল্পসৃষ্টির নেশায় দুনিয়ার আর সবকিছু ভুলে যায় সে, থাকে না হিতাহিত জ্ঞান বা বুদ্ধি-বিবেচনা।

মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় সে আউড়ায় সংস্কৃত শ্লোক, আবৃত্তি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা। এছাড়া এমন অনেক কিছুই করে বসে সে, যার উপর থাকে না নিজেরও নিয়ন্ত্রণ। তবে একটি জায়গায় সে সবসময়ই সজাগ ও সচেষ্ট, সেটি হলো শিল্প-নির্মাণের ক্ষেত্র। শিল্পবোধের জায়গায় এতটুকুও ছাড় দিতে সে নারাজ।

এই কিগানেরই দুই ‘বন্ধু’ অদিতি (নুসরত) আর বোধিসত্ত্ব (আবীর)। তবে কিগান তাদেরকে বন্ধু ভাবলেও, তাদের কাছে কিগান বন্ধুর চেয়েও বেশি বা ভিন্ন কিছু। অদিতি মনে মনে ভালোবাসে কিগানকে, চায় তার সাথে সংসার করতে। সহজ ভাষায় কিগান তার মনের মানুষ। তাই তো এক দুর্বল মুহূর্তে কিগান তার সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হতে চাইলে সাড়া দেয় সে-ও। যদিও পরবর্তীতে কিগানের কাছে সেটি বিবেচিত হয় নিছকই দুর্ঘটনা হিসেবে।

এদিকে বোধি ভালোবাসে অদিতিকে। কিগানের কাছে অদিতির মন ভাঙার পর সে বিয়ে করে অদিতিকে। তাদের একটা ছেলেও হয়। কিন্তু বিয়ের দীর্ঘ সময় পরও, বোধির চেয়ে কিগানের সাথেই ঘনিষ্ঠতা অদিতির। ফলে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে বোধি-অদিতির, হয়ে যায় বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে অনেক অনুনয়ের পরও কিগানের থেকে অদিতিকে দূরে সরাতে পারে না বোধি। ফলে একসময় সে হয়ে ওঠে কিগানের ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’।

লম্বা বিরতির পর বাণিজ্যিক ছবির ধূসর মোড়কে আবীর; Image Source: Jeetz Filmworks

আর্ট কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর কিগানের মাথায় চাপে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্গা প্রতিমা বানাবার ভূত। অদিতি তার বাবাকে বলে-কয়ে ব্যবস্থা করে দেয় দেশবন্ধু পার্কে তাদের ক্লাবের পুজোর জন্য সেই প্রতিমা নির্মাণ ও মণ্ডপসজ্জার।

এদিকে বোধি এখন বিরাট বড় কর্পোরেট লর্ড, কলকাতায় বহু পুজোর পৃষ্ঠপোষক সে। অথচ তার বদলে কিগান ও কিগানের সৃষ্টিকে নিয়ে শহরজুড়ে মাতামাতি শুরু হলে, মেনে নিতে পারে না সে। কিগানের কাছে গিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, যেভাবেই হোক কিগানের বানানো দুর্গা মূর্তি সে ধ্বংস করে দেবে।

ওদিকে কিগানও দৃঢ়সংকল্প, তার বানানো মা দুর্গার বিসর্জন হবে না, দর্শকের জন্য উন্মুক্ত থাকবে চিরকাল। এই সংকল্প বাস্তবায়নে নিজের জীবন বাজি রাখে সে।

শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি হয় কিগানের সেই মহান সৃষ্টির? এই সৃষ্টির সাথে জড়িয়ে থাকা কিগান, বোধি, অদিতি কিংবা অদিতির বাবা ও তার সন্তানের ভাগ্যেই বা কী থাকে অপেক্ষা করে? এই নিয়েই কাহিনী ‘অসুর’ এর।

অনেকেই হয়তো জানেন না, কিগান চরিত্রটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার পাভেল এ চরিত্রের অনুপ্রেরণা নিয়েছেন আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যকলার অন্যতম অগ্রপথিক, বাঙালি ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের থেকে। বলা যায় ছবিটি ওই মহান শিল্পীর প্রতি পাভেলের শ্রদ্ধার্ঘ্যও বটে। এছাড়া ২০১৫ সালের সবচেয়ে বড় দুর্গার ছায়াও স্বভাবতই চলে এসেছে কাহিনীতে। 

তো বুঝতেই পারছেন, কাহিনীতে কিগানরূপী জিৎ কিংবা বোধিরূপী আবীর, যারই জয় হোক না কেন, দিন শেষে প্রধান নায়ক একজনই। সেটি পাভেলের গল্প। আর সেজন্য বিশেষ প্রশংসা তার প্রাপ্য। 

সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ওয়েব সিরিজ ‘অসুর’-এর সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারেন অনেকেই; Image Source: Voot Select

কলকাতার ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর আবহে, শিল্পী ও শিল্পের সাথে সেই শিল্পবোধ বিনাশকারীর খুনে টক্করের পটভূমিতে সংস্থাপিত কাহিনী বারবারই যেন দর্শকের তালগোল পাকিয়ে দেয়। সম্প্রতি তুমুল আলোচনার জন্ম দেওয়া ওয়েব সিরিজ ‘অসুর’-এর মতোই, এ ছবিতেও দর্শকের সামনে ছুঁড়ে দেয়া হয় অভিন্ন প্রশ্ন: কে অসুর? কেনই বা সে অসুর?

কিন্তু উত্তরটাও কি অভিন্ন? মোটেই না। একই নাম হওয়া সত্ত্বেও সেই ওয়েব সিরিজ ‘অসুর’ আর এই চলচ্চিত্র ‘অসুর’-এর ইন্টারপ্রিটেশন একেবারে ভিন্ন। খুবই জটিল পশ্চাৎপট ও বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের মিশেলে গড়ে ওঠা ওয়েব সিরিজ ‘অসুর’-এর চেয়ে এই চলচ্চিত্র ‘অসুর’-এর কাহিনীর গতি-প্রকৃতি অনেকের কাছেই বড্ড সরল-সোজা মনে হতে পারে, বিশেষত যে কাহিনীর একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ত্রিকোণ প্রেমের বহু-ব্যবহারে ক্লিষ্ট জমিন।

তারপরও, শিল্পীর শিল্পবোধ ও আত্মকেন্দ্রিকতা, অন্যদিকে বঞ্চিতের প্রতিহিংসাপরায়ন মানবিক সত্তার দোটানার মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া যে আসুরিক প্রবণতাকে এ ছবিতে দেখানো হয়েছে, আর তার মাধ্যমে গোটা ‘অসুর’ ধারণাটাকেই যেভাবে ওলটপালট করে দেয়া হয়েছে, তাতে এ ছবি দেখার পর দর্শকের স্বীয় মনকে চিন্তার কাজে বিনিয়োগের সুযোগ কিছুটা বেশিই বৈকি।

সুতরাং একটি বিষয় মোটামুটি পরিষ্কার, এই ‘অসুর’ এর গল্প অসাধারণ। এ এমন এক গল্প, যা দর্শককে নতুন কিছুর সাথে পরিচিত করিয়ে দেবে তো বটেই, সেই সাথে তাকে ভাবতেও বাধ্য করবে। দর্শক অবাক হয়ে দেখবে, মুখে রবি ঠাকুরের পঙ্‌ক্তি আউড়ানো কিগানের শিল্পবোধ ও জীবনদর্শন কবিগুরুর চেয়ে কতটাই না বিসদৃশ।

রবীন্দ্রনাথ যেখানে ‘সোনার তরী’-তে আক্ষেপ করেছেন যে শিল্পী কেন শিল্পের সমান মূল্যায়িত হয় না, মহাকাল কেন কেবল শিল্পটাকেই সঞ্চিত করতে চায়, সেখানে এ ছবির কিগানের কাছে আলাদা করে শিল্পী কিংবা সেই শিল্পীর কোনো মানবসত্তার মূল্যই যেন নেই। এই কিগান প্রেমকে পুরোপুরি অস্বীকার করে, তার যাবতীয় প্রেম যেন তার শিল্পের প্রতি। প্রস্তরখণ্ডের উপর সে চিরকালীন কিছু বার্তা রেখে যেতে চায়, নিজের অস্তিত্বের চিন্তা না করে।

আবার রবি ঠাকুর যেখানে নিজের শেষ দিককার বহু রচনায় প্রচ্ছন্ন আত্মসংশয় রেখে গেছেন যে তার সৃষ্টিসম্ভার হয়তো কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়ে ব্যর্থ হয়ে গেছে, সেখানে কিগান নিজের সৃষ্টির প্রতি একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী, একটু বেশিই যেন অহমিকা ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে, তাই নিজেকে সে দাবি করে বসে প্রতিশ্বর হিসেবে। এবং এক পর্যায়ে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন তার সেই সৃজনশীল সত্তাটাই বিদ্রোহ করে একদম বিপরীত রূপে আবির্ভূত হয়, ভস্মীভূত করতে চায় সবকিছুকে, মেতে ওঠে ধ্বংসলীলায়।

‘অসুর’-এর পোস্টার; Image Source: Jeetz Filmworks

আবার শুধু কিগানকে নিয়ে পড়ে থাকলেই বা কেন হবে, বোধির চরিত্রটাও কি কম তাৎপর্যবহ! যে মানুষটার নামের আক্ষরিক অর্থই হলো আধ্যাত্মিক মুক্তিকামী, সে বিশ্বাস করে সে সবদিক থেকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এগিয়ে, তবু কিনা শিল্পবোধ ও শিল্পীসত্তার অভাবে প্রেয়সীর কাছে তার মূল্য বরাবর অকিঞ্চিৎকর।

আর যেহেতু সে পুরোদস্তুর মানুষ অর্থাৎ মানবিক গুণসম্পন্ন, তাই বারবার পরাজিত হয়ে তার মধ্যে তীব্রভাবে প্রস্ফুটিত হয় হিংসা, ক্রোধ, প্রতিশোধের আগুন। আবার সেই একই কারণেই, যেহেতু সে মানুষ, তাই তার মধ্যে থাকে ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা, অপত্যস্নেহের মতো অকপট গুণাবলিও। পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে তার বিবেক। কখনো সে অন্ধ হয় রিপুর তাড়নায়, আবার কখনো প্রকটিত হয় তার হৃদয়ের স্নিগ্ধ-কোমল দিক।

সে তুলনায় অদিতির চরিত্রটাকে শুরুর দিকে মনে হয় যেন একটু বেশিই চিরায়ত, আরো ততোধিক ক্লিশে। কিন্তু ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলতে থাকে তার চরিত্রটিও। শেষাংশের চমকে তার ভূমিকাও কোনো অংশে কম থাকে না কিগান অথবা বোধির চেয়ে।

প্রধান তিন চরিত্রের ভিত এত শক্তপোক্ত করে গড়ে তুললেও, পার্শ্বচরিত্রগুলো একটু যেন বেশিই নড়বড়ে। যেমন অদিতির বাবা কেন মেয়ের সব কথা মেনে নিচ্ছেন, কিগানের প্রতি সুস্পষ্ট বিরক্তি থাকলেও তাকে বিয়ে করতে মেয়েকে জোরাজুরি করছেন, এর পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ, অথবা চরিত্রটির মনোবিশ্লেষণ দেখানো হয়নি। আর্ট কলেজের ভিসির চরিত্রটিকেও চাইলে আরো খানিকটা প্রাসঙ্গিক করে তোলা যেত।

যা-ই হোক, মোটের উপর ‘অসুর’ এর গল্পে যে নতুনত্ব ও গভীরতা দুই-ই আছে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু যদি প্রশ্ন হয়, সার্বিকভাবে ছবিটি কেমন হয়েছে, তাহলে চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে পাভেলের নিন্দে করতেই হবে। একে তো চিত্রনাট্য খুবই অসংলগ্ন, তার উপর ‘জিৎ-ইয়’ বাণিজ্যিক ছবির মোড়ক থেকেও ‘অসুর’-কে পুরোপুরি বের করে আনতে পারেননি তিনি।

লম্বা চুলের এলোমেলো, পাগলাটে, বিস্রস্ত জিতের মাঝে কেন যে নায়কোচিত গ্ল্যামার পুরে দেয়ার চেষ্টা করা হলো, সেটি ঠিক বোধগম্য হয়নি। দৃষ্টিকটু লেগেছে তখনও, যখন কাহিনীস্রোতের বিপরীতে গিয়ে একাই দশজন গুণ্ডাকে ঠ্যাঙাতে শুরু করেছিল কিগান তথা জিৎ। একজন অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণে অভ্যস্ত শিল্পী, সারাক্ষণ যে মাতাল হয়েই থাকে, সে কীভাবে হঠাৎ ‘সিনেমার নায়কদের মতো’ হয়ে গেল, এ প্রশ্ন জাগবে যে কারো মনে।

অদিতির পারিবারিক প্রেক্ষাপট দেখানো হলেও, কিগান ও বোধির বেলায় সে অধ্যায়গুলো অনুন্মোচিত রাখাটা বিস্ময়কর। বোধি-অদিতির বিয়ে ও বিচ্ছেদের জায়গাগুলোতেও কিছু ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। কে জানে, সেগুলো পরিচালকের ইচ্ছাকৃতও হতে পারে। তবে হ্যাঁ, কাহিনীকে এই অনুপস্থিতিগুলো খুব একটা প্রভাবিত করেনি বলেই এগুলোকে খুব বড় কোনো দুর্বলতা বলা যাবে না।

‘অসুর’ এর পরিচালক পাভেল; Image Source: Anandabazar Patrika

তাহলে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী এ ছবির? সেটি হলো উৎকট আড়ম্বরতা। জিতের এত হাই পিচে ডায়লগ ডেলিভারি দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। তার চরিত্রটি হয়তো খানিকটা বাড়াবাড়ি ডিমান্ড করে, কিন্তু তাই বলে দর্শককে এমনটাও বোধ করানো উচিৎ নয় যে তিনি ‘আওয়ারা’, ‘পাওয়ার’ বা ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি’-র মতো লাউড ননসেন্স কমেডি দেখছেন। ছবিতে কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্যতা ও ধীর-স্থিরতা আবশ্যক ছিল। কিন্তু জিতের লার্জার দ্যান লাইফ ঘরানার পর্দা উপস্থিতি এবং উচ্চকিত সংলাপ বিনিময় সেটি হতে দেয়নি। আর সে দায়টা পরিচালক হিসেবে পাভেলকেই নিতে হবে।

অবাক করা বিষয় হলো, এত তর্জন-গর্জন করা জিতকে ক্লোজ শটে ডায়লগ ডেলিভারি করতে কমই দেখা গেছে। এর কারণ কি এই যে পরিচালক জিতের অভিনয় নিয়ে আস্থাশীল ছিলেন না? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে সেটি একদমই অযৌক্তিক, কেননা বিগত বছরগুলোতে জিৎ চরিত্র নির্বাচনে যেমন খামখেয়ালির পরিচয় দিয়েছেন, তেমনই কিছু ভালো অভিনয়ের দৃষ্টান্তও তো দেখিয়েছেন। ফলে পরিচালকের উচিৎ ছিল তার উপর আরো আস্থা রাখা, তার থেকে সেরাটা বের করে আনা।

সাম্প্রতিক সময়ে জিতের সেরা ছবির মতো এ যাবৎকালে জিতের সেরা অভিনয়সমৃদ্ধ ছবিও হতে পারত ‘অসুর’। তা না হওয়ায় জিতের পাশাপাশি কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে পরিচালককেও।

আবীর, নুসরতের অভিনয়কেও নিখুঁত বলা যাবে না। তাদের পারস্পরিক রসায়ন যেমন আরো ভালো হতে পারত, তেমনই সামগ্রিকভাবেও তাদের কাছ থেকে আরো ভালো অভিনয় প্রত্যাশিত ছিল। কিগানের কল্পনার দুর্গা হিসেবে রাজনন্দিনী পালের অভিনয় পরিমিত ছিল। বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়কে অদিতির বাবা হিসেবে দীর্ঘদিন পর বড়পর্দায় দেখতে পাওয়াটা বাড়তি পাওনা। কুশল চক্রবর্তীর অভিনয় থেকে আরো কিছুটা হাস্যরস হয়তো পাওয়া যেতে পারত।

‘অসুর’-কে এখন পর্যন্ত নিজের সেরা ছবি মনে করছেন নুসরাত; Image Source: Telegraph India

সবচেয়ে বড় দুর্গাকে ক্যামেরাবন্দি করার পাশাপাশি এ ছবিতে আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য ছিল, যেগুলোকে দৃষ্টিনন্দনভাবে উপস্থাপনে চিত্রগ্রাহক সুপ্রিয় দত্ত ও জয়দীপ বসুর মুনশিয়ানা অনস্বীকার্য।

আর সবশেষে বলব কাহিনীর পর এ ছবির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাপ্তির বিষয়ে। সেটি এ ছবির গান ও নেপথ্যসংগীত। সুগত গুহ’র লেখা, বিক্রম ঘোষের সুর দেয়া ‘আমি রাধার মতো কলঙ্ক যে চাই’ গানটি নিঃসন্দেহে অনবদ্য। এছাড়া বিক্রম ঘোষের ‘মন জানে না’, ‘আগুন’ এবং অমিত মিত্রের সঙ্গীতায়োজনের ‘তোর হয়ে যেতে চাই’, প্রতিটি গানই শ্রুতিমধুর, এবং কাহিনীকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর।

সব মিলিয়ে ‘অসুর’, সব ধরনের খামতি ও দুর্বলতা সত্ত্বেও, অবশ্যই একটি ভালো ও দেখার মতো ছবি। অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করতে না পারলেও, ছবিটির পুরোটা জুড়েই জিৎ, আর তাই এটি জিতেরই ছবি। তাকে এমন একটি ছবিতে দেখতে পাওয়া অবশ্যই ভক্তদের জন্য যেমন স্বস্তির, ঠিক তেমনই সমালোচকদের জন্য বিস্ময় উৎপাদনকারী। সামনের দিনগুলোতে জিৎ এমন কনটেন্ট-নির্ভর ছবিতে নিয়মিত হবেন, সেই প্রত্যাশা থাকবে।

আর জিতের ছবির পরিচালক হিসেবে পাভেলের কাজ এবার তার আগের ছবিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছাচ্ছে। আগের ছবিগুলোর সমতুল্য কাজ উপহার দিতে না পারলেও, নব্যলব্ধ এই এক্সপোজারই হয়তো তার ভবিষ্যৎ উন্নতির সোপানের ভূমিকা পালন করবে।

 

 

This article is in Bengali language. It is a review on the movie Asur directed by Pavel. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Jeetz Filmworks

Related Articles