গল্পের মাঝে প্রাণ সৃষ্টি করায় অপূর্ব দক্ষতা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। মধ্যবিত্তের জীবনের অজস্র সাধারণ গল্পের এক একটিকেই গাঢ় মমতা মিশিয়ে তিনি বলতেন তার উপন্যাসগুলোতে। খরস্রোতা নদীর মতো তরতরিয়ে বয়ে চলা সেই গল্পগুলোর মধ্যে একইসাথে থাকে হাস্যরস, যাপিত জীবনের টুকরো টুকরো অজস্র আনন্দ বেদনার গল্প। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো এতটাই কাছের যে, পাঠকরা নিজেকেই যেন খুঁজে পায় গল্পের পাতায় পাতায়।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার এমনই জাদু যে জোর করে মনোযোগ ধরে রেখে তার বই শেষ করার প্রয়োজন হয় না, বরং এর গল্পই পাঠককে আপন গতিতে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে চলে। পাঠক হৃদয় জয় করতে পারার এই অসামান্য দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলেন বলেই জীবনকালে পেয়েছিলেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা, আবার মৃত্যুর পরেও সাধারণ পাঠকের হৃদয়ে তিনি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।
গাঢ় আবেগ অনুভূতির সংমিশ্রণে হুমায়ূন আহমেদ যে কয়েকটি অপূর্ব কোমল উপন্যাস রচনা করেছেন, তাদের মধ্যে ‘নির্বাসন’ অন্যতম। লেখক জীবনের প্রথম পর্বে রচিত এই উপন্যাসটি তার সৃষ্টিগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ছোট্ট এই উপন্যাসটির মাঝে এমন কিছু গল্প আছে, যা মনের গভীরে দাগ কেটে যায়; এমন কোনো গভীর বেদনা, যা বুকের ভিতর আপন সুরে বাজতে থাকে।
‘নির্বাসন’ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটি মাত্র দিনের গল্প। দিনটি গল্পের নায়িকা জরীর বিয়ের দিন। সারাবাড়িতে সেদিন আনন্দের ঢল নেমেছে। হই-হুল্লোড়, চেঁচামেচি আর রঙ মাখামাখিতে সবাই ব্যস্ত। সেই বাড়িরই দোতলার ঘরে শুয়ে আছে জরীর চাচাতো ভাই আনিস। আর্মির লেফটেন্যান্ট ছিল সে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাক আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মেরুদণ্ডে গুলি লেগেছিল তার। তারপর থেকে কোমরের নিচ থেকে অবশ। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়, তখন প্যাথিড্রিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয় তাকে।
অথচ আনিস এবং জরী দু’জন দু’জনকে ভালবাসতো। হয়তো বিয়েও হতো তাদের। কিন্তু মাঝখানে এক যুদ্ধ বদলে দিয়েছে সব কিছু। আনিস নিজেও জানে, সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। অন্যদিকে জরীর জন্যও অন্য ছেলেকে বিয়ে করে ফেলা ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। আনন্দঘন পরিবেশে একদিকে জরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে আনিস তার ঘরে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে, এমন এক আনন্দময় করুণ দিনের গল্প বলেছেন হুমায়ূন আহমেদ তার ‘নির্বাসন’ উপন্যাসে।
তাই বলে এই করুণ গল্প বলতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ পাঠকদেরকে হতাশা এবং বেদনায় জর্জরিত করে ফেলেননি। বরং নদীর স্রোতের মত এই গল্পটি প্রবাহিত হয়েছে আপন গতিতে। দিনের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন চরিত্রের স্মৃতি থেকেই ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে এ উপন্যাসের মূলগল্প। সাধারণত হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে যে খামখেয়ালিপনা উপস্থিত থাকে, তা এখানে অনুপস্থিত। এর প্রতিটি চরিত্রই বরং অনেক বেশি স্থিতিশীল। চরিত্রগুলোকে পুনঃপুনঃ স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
উপন্যাসটির সূচনা হয়েছে জরীর বড় চাচার নির্ঘুম অস্থিরতা দিয়ে। জরীর বিয়ে নিয়ে নিজস্ব একটি পরিকল্পনা আছে তার। লেখকের ভাষায়,
“রেডিওগ্রামে সানাইয়ের তিনটি লং প্লেয়িং রেকর্ড সাজানো আছে। সুইচ টিপলেই প্রথমে বেজে উঠবে বিসমিল্লাহ খাঁর মিয়া কি টোরী। তিনি সুইচে হাত রেখে ভোরের অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন জরীর বিয়ের দিনে ভোরবেলায় সানাইয়ের সুর শুনিয়ে সবার ঘুম ভাঙাবেন। ঘুম ভাঙতেই সবাই যেন বুঝতে পারে– জরী নামের এ বাড়ির একটি মেয়ে আজ চলে যাবে।
বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ তাঁর চোখে জল এল। বয়স হবার পর থেকে এই হয়েছে। কারণে অকারণে, চোখ ভিজে ওঠে। সুখ এবং দুঃখের অনুভূতি বড় তীব্র হয়ে বুকে বাজে।”
গল্পের প্রবাহের সাথে সাথে উপন্যাসের চরিত্রগুলো ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হতে থাকে। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন আশাবাদী সাহিত্যিক, তার অন্যান্য উপন্যাসের মতো এখানেও আশাবাদ এবং জীবনের সূক্ষ্ম অনুভবগুলো প্রবল। অসুস্থ আনিসের জীবনকেও বিষাদগ্রস্ত করে তিনি উপস্থাপন করেননি। তার জীবনেরও কিছু আনন্দময় ক্ষণ আছে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত আনিসের জন্যও তিনি সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন। সেই বাড়িরই চার বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে টিংকুমনি আনিসকে সঙ্গ দেয়। প্রতিদিন সকালে এসে হাজির হয় সে৷ টিংকুমনির সাথে আনিসের সকালবেলার পর্বটি বর্ণিত হয়েছে এভাবে,
“তারপর সেই লাল চুলের মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়বে বিছানায়। তার হইচই- এর কোনো সীমা থাকবে না। এক সময় বলবে, আমি হাতি হাতি খেলব। তখন কালো কম্বলটা তার গায়ে জড়িয়ে দিতে হবে। একটি কোলবালিশ ধরতে হবে তার নাকের সামনে এবং সে ঘন ঘন হুঙ্কার দিতে থাকবে। আনিস বারবার বলবে, আমি ভয় পাচ্ছি, আমি ভয় পাচ্ছি। এক সময় ক্লান্ত হয়ে কম্বল ফেলে বেরিয়ে আসবে সে। হাসিমুখে বলবে, আনিস এখন সিগারেট খাও। টিংকু নতুন দেশলাই জ্বালাতে শিখেছে, সে সিগারেট ধরিয়ে দেবে।”
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলোতে কখনও প্রেমের উচ্ছ্বসিত বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় না। বরং এখানে প্রেম আসে কোমলভাবে। এ উপন্যাসেও আনিস এবং জরীর প্রেমের কোনো বর্ণনা বা বহিঃপ্রকাশ নেই, তবুও উপন্যাসশেষে সেই প্রেম এবং প্রেমের বেদনা যুগপৎ অনুভূত হতে থাকে। আমাদের স্বাধীনতা যে কত সহস্র প্রাণের ত্যাগ এবং হারানোর বেদনা থেকে এসেছে, সেই অনুভূতিটিও উপন্যাসটি পড়ার সময় জাগ্রত হয়। জরীর বান্ধবীরা যখন আনিসের কাছে এসে বলে,“আপনি আমাদের যুদ্ধের গল্প বলুন, আনিস ভাই।” আনিস থেকে তখন বলে, “আমি যুদ্ধের কোনো গল্প জানি না। … আমি যুদ্ধের গল্প বলি না।”
মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়ের দিনগুলোতে এক অন্যরকম আমেজ থাকে, বিচিত্র ঘটনায় সারাটা দিন মুখরিত থাকে, তার সূক্ষ্ম সরস বর্ণনা উপন্যাসটির পুরোটা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। যেমন,
“বড় রকমের একটি ঝগড়াও শুরু হয়েছে বিয়ে বাড়িতে। এসব ঝগড়াগুলো সাধারণত শুরু করেন নিমন্ত্রিত গরীব আত্মীয়রা। তাঁরা প্রথমে খুব উৎসাহ নিয়ে বিয়ে বাড়িতে আসেন, কোনো একটা কাজ করবার জন্যে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু কিছু করতে না পেরে ক্রমেই বিমর্ষ হয়ে ওঠেন। এক সময় দেখা যায় একটি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তাঁরা মেতে উঠেছেন। চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না। বর পক্ষের তরফ থেকে দুটি রুই মাছ পাঠানো হয়েছিল। মাছ দুটি না কি পচা, এই হচ্ছে আজকের ঝগড়ার বিষয়। তবে সব বিয়েতেই চরম গণ্ডগোল যেমন ফস করে নিভে যায়, এখানেও তা-ই হলো। দেখা গেল বরপক্ষীয় যারা বিয়ের তত্ত্ব নিয়ে এসেছিল তারা মহানন্দে রঙ খেলায় মেতে গেছেন।”
উপন্যাসটি ছোট হলেও এখানে যথেষ্ট পরিমাণে চরিত্রের সম্মিলন ঘটেছে। তাদের প্রত্যেকেরও নিজস্ব কিছু গল্প আছে। জরীর বড় বোন পরী ও তার স্বামী হোসেন সাহেবের দাম্পত্য জীবন, আবার স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার দীর্ঘদিন পর আনিসের মার বিয়ের দিনে ঘুরতে আসার অংশগুলো পাঠককে যথেষ্ট আলোড়িত করে।
দৈর্ঘ্যের হিসেবে এটিকে উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা (Novella) বলা চলে। প্রায় চল্লিশ পৃষ্ঠার এই ছোট্ট উপন্যাসটা পড়তে হয়তো ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগে না, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের অন্য উপন্যাসগুলোর মতো এটি চট করে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায় না, বরং এর আবেশ রয়ে যায় বহুক্ষণ। গল্পের মানুষদের জন্য গহীন বেদনা বুকের ভেতর চিনচিন করে বাজতে থাকে।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-