টিনের কৌটা, ছুরি দিতে চাঁছতে চাছঁতে জংসহ কফির শেষ ভগ্নাংশটুকু ঝেড়ে দিচ্ছেন কেটলিতে। দেশের গৃহযুদ্ধ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর রাজনৈতিক বাস্তবতা মানুষের জীবনের শেষ শক্তিটুকু কেড়ে নিচ্ছে, ঢেলে দিচ্ছে উত্তপ্ত কেটলিতে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘কর্নেলকে কেউ লেখে না’ এমনই বাস্তবতায় লেখা এক ছোট কলেবরের উপন্যাস। কাগজে কলমে অনেকেই একে ‘নভেলা’ বলে থাকেন, ছোটগল্পের চাইতে আকারে বড় তবে উপন্যাসও নয়।
মার্কেজের জন্মভূমি কলম্বিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস দীর্ঘদিন বন্দী ছিল সহিংসতার কারাগারে। গৃহযুদ্ধ আর সহিংসতা সেখানে এক সূর্যের আলোর মতোই প্রত্যক্ষ। এই অস্থির সময়কে কেন্দ্র করে রচিত কলম্বিয়ার সাহিত্যের পাতায় পাতায়ও দেখা যাবে রক্ত আর খুনাখুনি। তবে মার্কেজ সবার চাইতে আলাদা। রক্ত নেই, অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই উপন্যাসের পাতায় তবুও পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে ধরা দেয়, মানুষগুলো ভালো নেই, নিঃসঙ্গতার বিষ বড়ে বেড়াচ্ছে এই মানুষগুলো।
মার্কেজের কাজকে সবচেয়ে বেশি বিচার বিশ্লেষণ করা ‘জাদু বাস্তবতা’র প্রেক্ষাপট থেকে। অনেকেই বলেন এই জাদু বাস্তবতার ধারণাটাই পশ্চিমাদের, বইয়ের কাটতি বাড়াতেই সুন্দর একটি নতুন শব্দের উত্থান। তবে ‘কর্নেলকে কেউ লেখে না’ যতটা না জাদু বাস্তবতার দলিল তার চেয়ে বেশি লাতিন আমেরিকার সমাজ সভ্যতার প্রতিফলন। লাতিনের সাধারণ আটপৌরে জীবনের গল্প, সহিংসতার থাবার ছিন্ন মানুষের দিনলিপিই প্রাশ্চাত্যের চোখে জাদু হয়ে ধরা দেয়।
উপন্যাস যাকে ঘিরে ঘুরপাক খায় তার কোনো আসলে নাম নেই, সে এক বৃদ্ধ কর্নেল। ১৯০২ সালের ২৪ অক্টোবরের নেএর্লান্দিয়ার সন্ধিচুক্তিতে উপস্থিত ছিলেন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার অস্থির সময়ের ইতিহাসে যুক্ত হয় একটি নাম, ‘সহস্র দিনের যুদ্ধ’। কর্নেল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন উদারপন্থীদের হয়ে কিন্তু যুদ্ধে জিতে গিয়েছিল রক্ষণশীলরা। সন্ধির সময় উপস্থিত ছিলেন সেই কর্নেল, সেখানেই প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন তিনি পেনশনের টাকা পাবেন, জীবনের শেষ কয়েকটা দিন হয়তো একটু ভালো কাটবে।
উপন্যাসে পেনশনের জন্য অপেক্ষারত কর্নেল আর তার অসুস্থ স্ত্রী ছাড়াও দৃষ্টি কাড়বে একটি মোরগ, কর্নেলের ছেলে আগুস্তিনের মোরগ। বৃদ্ধ কর্নেল আর অসুস্থ স্ত্রীর সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি ছিলো আগুস্তিন, মোরগ লড়াইয়ের ভীষণ শখ তার। শুধু আগুস্তিন বললে ভুল হবে, লাতিন আমেরিকার শত-সহস্র তরুণের মাঝে দারুণ জনপ্রিয় এই মোরগ লড়াই। মোরগের উপর বাজি ধরে তারা, মাসের পর মাস লড়াইয়ের জন্য মোরগকে প্রস্তুত করে, মহড়া দেওয়ায়, নিজের খাদ্যের ভাগ মোরগকে তুলে দেয়। তাই লড়াইয়ের মোরগকে রক্ষণাবেক্ষণও ব্যয়বহুল। লড়াইয়ে মোরগের উপর বাজি ধরা হয়, জিতে যাওয়া মুরগীর মালিক বাজির বিশ শতাংশ পায়। আগুস্তিনও মোরগ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল জিতবে বলে, টাকায় গড়াগাড়ি খাবে বলে স্বপ্ন ছিলো তার। কিন্তু জিতে যাবার আগেই গুলি খেয়ে প্রাণ হারায় আগুস্তিন।
কর্নেলের কাছে থেকে ছেলের রেখে যাওয়া একমাত্র সম্পত্তি মোরগ, ঘরে খাবার নেই। প্রতি শুক্রবার একদম ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে পোস্ট অফিসে গিয়ে কর্নেল খবর নেন। চিঠির বস্তা থেকে তার নামে কি একটি চিঠি বের হবে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে একটি চিঠির অপেক্ষায়, যে চিঠিতে তার পেনশনের খবর থাকবে। কিন্তু প্রতিবার পোস্ট মাস্টার তাকে বলে দেন, কর্নেলকে লেখবার মতো কেউ নেই।
জীবনের নিঃসঙ্গতা কাঁধে নিয়ে বেড়ান বৃদ্ধ কর্নেল, তবুও আশা ছেড়ে দিতে পারেন না। ছেলে মারা যাওয়ার পরে সেলাই মেশিনের মতো ঘরে বিক্রি করার মতো যা ছিলো তা একে একে বিক্রি হয়ে গেছে। কর্নেলের মান্ধাতা আমলের ঘড়ি কেউ কিনতে চায় না। প্রতিবেশীদের কাছে দারিদ্র্য ঢেকে রাখতে কর্নেলের স্ত্রী পাথর কুড়িয়ে পানিতে গরম করেছে কোনো কোনো দিন। সংসার যেন আটকে আছে এক অদ্ভুত নিয়তির সূতায়, এই হয়তো সবকিছু ভেঙে পড়বে।
ঘরে দানাপানি নেই, কর্নেলের স্ত্রীর দাবী বুকে পাথর চেপে ছেলে আগুস্তিনের মোরগটা বিক্রি করে দাও। নয়শো পেসোতে চাইলে বিক্রি করে দিতে পারেন শেষ সম্পত্তি। কিন্তু তাতে সায় দেয় না কর্নেলের মন, হয়তো তার পেনশন আসবে। কর্নেলের সাথে তার আইনজীবীর কথোপকথনে বেরিয়ে আসে পেনশন আটকে থাকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা। এই টেবিল থেকে ঐ টেবিলে, এই মন্ত্রণালয় থেকে ঐ মন্ত্রণালয়ে ঘুরে কোনো এক টেবিলে হয়তো আটকে আছে বৃদ্ধ কর্নেলের পেনশনের সমাধান। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে কর্নেলের সহযোদ্ধাদের অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন ওপারে, নিতান্তই কম বয়সে পদোন্নতি পেয়ে কর্নেল হয়ে গিয়েছিলেন বলেই তার অপেক্ষা হয়েছে দীর্ঘ।
গার্সিয়া মার্কেজের এই উপন্যাসের পটভূমিতে আরো উঠে এসেছে কলম্বিয়ার ‘লা ভায়োলেন্সিয়া’ সময়কালের কথা। চারদিকে মৃত্যু আর রক্তপাত, সংবাদপত্র থেকে সিনেমাতে সেন্সরশীপ, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন। এর মাঝেও মার্কেজের উপন্যাসে আশ্চর্যভাবে কোনো রক্তপাত নেই।
সাদা কোটটা ইস্ত্রী করা হয়নি, তাই এক অন্ত্যেষ্ঠিক্রিয়ায় যোগ দিতে কর্নেল আর কিছু খুঁজে না পেয়ে তার বিয়ের দিনের পোশাকটাই পরেছিলেন। তার অসুস্ত্র স্ত্রী এক নজরে তাকিয়ে বলছিলেন, কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার মতো করে সাজার কারণ কী?
কর্নেল উত্তর দিয়েছিলেন অনেক দিন পরে এক স্বাভাবিক মৃত্যু, অনুষ্ঠানের চেয়ে কম কিসে! লা ভায়োলেন্সিয়ার এই সময়ে চারদিকে অকারণে শয়ে শয়ে মানুষ মরেছে, এর মধ্যে একটি স্বাভাবিক মৃত্যু যে কত অদ্ভুত পরিস্থিতির জন্ম দেয় তা তুলে ধরেছেন মার্কেজ। আর এই মৃত্যুর সাথে কর্নেলের কাছে ছেলেকে হারানোর শোক প্রবল হয়ে উঠে। শুধু আরো কয়েকটা দিন লড়াই করে বেঁচে থাকতে চান।
কিন্তু অভাব যেন তার পিছু ছাড়ে না, মোরগ বিক্রি করে দিতে গিয়েও পারেন না। নিঃসঙ্গ কর্নেলের কাহিনী শুরু হয়েছিল অক্টোবরের এক সকালে, মাঝে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে কর্নেল চান যে জানুয়ারিতে মোরগ লড়াইয়ের দিনে পৌঁছাতে, এই অনাহার আর দারিদ্র্য কর্নেল নিতে পারছেন না। বাজি ধরা লোকেরা যখন মোরগকে ভুট্টা দিয়ে যায় তা থেকে অল্প বাঁচিয়ে নিজেরা খেয়ে নেওয়া। কর্নেলের অসুস্থ স্ত্রী দাবি করে, মোরগকে কি এবার নিজেদের কলিজাটাও রেধে দিতে হবে কি না? কর্নেল শুধু অপেক্ষা করে যায় লড়াইয়ের দিনের, কর্নেল শুধু অপেক্ষা করেন একটি চিঠির, যেখানে থাকবে তার পেনশনের টাকা!
উপন্যাসের আলো যখন নিভে আসছে তখন কর্নেলের স্ত্রী জিজ্ঞেস করে মোরগ লড়াইয়ের এখনো পঁয়তাল্লিশ দিন বাকি; জিতে গেলে বিশ শতাংশ পাবো, আর হেরে গেলে কী হবে? কর্নেল একটি জবাব দিয়েছিলেন, সেই জবাবে ছিলো পঁচাত্তর বছরের অনেক রাগ, অভিমান আর ব্যর্থতা!
মার্কেজের ‘কর্নেলকে কেউ লেখে না’ উপন্যাসটি মূলত তার নানাকেই চিত্রাঙ্কিত করেছে খানিকটা। তার নানা কর্নেল নিকোলাস রিকার্দো মার্কেস মোহিয়াও সহস্র দিনের যুদ্ধে উদারপন্থী শিবিরের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। আর ১৯৫৭ সালে তিনি যখন ‘কর্নেলকে কেউ লেখে না’ এই বইটি শেষ করেন তখন প্যারিসে উপন্যাসের কর্নেলের মতোই এক দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের কাছে নতজানু হয়ে আছেন মার্কেজ। যে পত্রিকার প্রতিনিধি হয়ে প্যারিসে এসেছিলেন তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দেশেও কর্মসংকট। প্যারিসেও দিন মোটেই সুখের কাটছে না, মুরগীর মাংস খেয়ে হাড়গোড় রেখে দিতেন, ডজনখানেক বার সেইগুলো দিয়ে স্যুপ খেয়ে কেটে গেছে দিন। এই দারিদ্র্যের খানিকটা প্রতিরূপ তিনি দিয়েছেন কর্নেলকেও, কফির কৌটা থেকে জংসহ কফির শেষ ভগ্নাংশটুকু ঢেলে দিচ্ছেন কেটলিতে।
এর বহু পরে মার্কেজের জীবনে সুসময় এসেছিলো, ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’, ‘কলেরার সময়কার প্রেম’ বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে। লেখক মার্কেজের জীবন বদলে গিয়েছিলো, কিন্তু বইয়ের পাতায় বন্দী থাকা সেই নিঃসঙ্গ কর্নেল তার চিঠি পাননি।
বাংলায় বইটি পড়তে চাইলে আজই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-