কোথা থেকে এসেছে মানুষ? কেমন ছিল তাদের শারীরবৃত্তীয় গঠন? কীভাবে প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে তারা? কৌতূহলের যেন শেষ নেই। এমনকি মানুষের মস্তিষ্কের আকার, ডিএনএ’র গঠন, শারীরিক গঠন, কোষের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কার্যাবলী সবকিছু নিয়ে মানুষের কৌতূহল। আছে অন্য সব প্রাণীর সাথে তুলনা, আছে নানা আলোচনা সমালোচনা। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সবকিছুতে আছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। শুধু পরিবর্তন হচ্ছে না মানুষের শারীরবৃত্তীয় গঠনের।
যদি মানুষের শারীরবৃত্তীয় গঠনের এমন পরিবর্তন হয় যাতে মানুষের জীবনযাত্রা আরো উন্নত হয়, তাহলে কেমন হতো? মানুষের অতীত নিয়ে যেমন জল্পনা কল্পনা আছে তেমনি ভবিষ্যৎ নিয়েও মনে আছে অনেক ভাবনা। মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার কিছু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে মানুষের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ও তার ফলাফল তুলে ধরেছেন। তার এই কল্পকাহিনীর কিছু মানুষের গবেষণার ফলে সৃষ্টি, আবার কিছু প্রকৃতিপ্রদত্ত। এই লেখায় আলোচনা করা হবে মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের কিছু কল্পকাহিনী নিয়ে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা সেরকম কিছু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হলো-
- অক্টোপাসের চোখ
- ইকারাস
- ওমিক্রনিক রূপান্তর
- ত্রাতিনার স্বগ্রহে প্রত্যাবর্তন ও
- অপারেশন অপক্ষেপ
‘অক্টোপাসের চোখ’, প্রকাশিত হয় অনুপম প্রকাশনী থেকে। বইটি মূলত দশটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সংকলন। সংকলনের প্রথম গল্প এটি। এতে দেখা যায় মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও অধিক আরামদায়ক করার উদ্দেশ্যে মানব শরীরের বাহ্যিক গঠনে কিছু পরিপূর্ণতা আনা হয়। যেমন- মানবচোখের জায়গায় অক্টোপাসের চোখ, দুটি পায়ের বদলে চারটি পা ইত্যাদি। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে- কেন মানবচোখের জায়গায় অক্টোপাসের চোখ ব্যবহার করা হলো?
মানুষের চোখের গঠনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, মানব চোখের আলো সংবেদনশীল কোষটি নিচে আর নার্ভ উপরে। এক্ষেত্রে অক্টোপাসের চোখটি এই ত্রুটি থেকে মুক্ত। তাই পরিপূর্ণ মানুষের মানবচোখের বদলে অক্টোপাসের চোখ স্থান করে নেয়। তেমনই কল্পকাহিনীতে মানুষের মাথাকে আকারে ছোট করা হয়। কারণ মাথা বড় হলে প্রসবে কষ্ট হয়। এছাড়া মানুষের হাঁটুর সংযোগটা পুরো শরীরের হাড়ের ওজন ঠিকভাবে নিতে পারে না। তাই দুটি পায়ের বদলে চারটি পা করা হয়।
এবার আসি মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘ইকারাস’ কল্পকাহিনীতে। মূলত কিশোরদের জন্য লেখা এই কল্পকাহিনীতে দুটি ভিন্ন প্রাণীর কোষের মিলনের মাধ্যমে অপর একটি প্রাণ সৃষ্টি করে। যেমন: একটি মানুষের কোষের সাথে একটি পাখির বিশেষ মিলন ঘটানো। এক্ষেত্রে জন্ম নেয় উড়তে পারা এক মানুষ। এর ফলে সুবিধা-অসুবিধা দুই-ই আছে। তবে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই যেন বেশি হয়ে ধরা দিয়েছে এখানে।
এখন আসা যাক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘ওমিক্রনিক রূপান্তর’-এ। এখানে মানুষের জীবনযাত্রার মানকে আরো উন্নত করার লক্ষ্যে, দূষিত আবহাওয়া থেকে মানুষকে রক্ষার উদ্দেশ্যে এবং মানুষকে অমর করার লক্ষ্যে প্রত্যেকটি মানুষকে কম্পিউটারের সফটওয়্যারে পরিণত করা হয়। এখানে একেকজন মানুষ একেকটি সফটওয়্যার।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের আরেকটি কল্পকাহিনী ‘ত্রাতিনার স্বগ্রহে প্রত্যাবর্তন’। এখানে ত্রাতিনা অনেক দিন শীতল ঘরে অবস্থানের পর পৃথিবীতে ফিরে আসে। কল্পকাহিনীতে শীতলঘর এমন এক স্থান যেখানে যুগের পর যুগ মানুষের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম বন্ধ থাকে এবং মানুষটি শত বছর পরও ঠিক সেই অবস্থায় ফিরে আসবে যে অবস্থায় সে শীতলঘরে ঢুকেছিল। শীতলঘর থেকে সে পৃথিবীতে এসে দেখে এখানে মানুষের হাত, পা, চোখ কিছুই নেই। শুধু মস্তিষ্ক আছে। সকল প্রকার বাহুল্য বাদ দিয়ে শুধু মস্তিষ্কটি আছে। আর তাতে সত্যিকারের অনুভূতি দেওয়ার জন্য তার মধ্যে আছে আধুনিক যোগাযোগ মডিউল।
‘অপারেশন অপক্ষেপ’ মুহম্মদ জাফর ইকবালের এমন আরেকটি কল্পকাহিনী। এতে প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত, সবাই সুখী। কিন্তু এই জীবনকে এক বিজ্ঞানীর কাছে একঘেয়েমি লাগে। আর এই একঘেয়েমি থেকে রক্ষা পেতে নতুন এক পৃথিবী তৈরির ব্যবস্থা করে, যেন মানুষ নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারে বা কিছু পরিবর্তন করতে পারে সেই আশায়। ঠিক একশ বছর পর সেই পৃথিবীর মানুষেরা একটি মাস্কিট্রন আবিষ্কার করে। মাস্কিট্রনটি মাথার খুলিতে ছিদ্র করে লাগানো হয়। মাস্কিট্রন তার ইমপালস দিয়ে সরাসরি যেকোনো ধরনের অনুভূতি দিতে পারবে।
একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝালে ব্যাপারটি এরকম হবে- যদি কেউ ভয়ানক কোনো পাপ করে তাহলে মাস্কিট্রন দিয়ে তার এই পাপকে পুণ্যের অনুভূতিতে বদলানো যাবে। তখন মনে হবে সে পাপ নয়, পুণ্য করেছে। অথবা কেউ যদি কোনো অখাদ্য খায় তাহলে মাস্কিট্রন তাকে সুখাদ্যের অনুভূতি দিবে ইত্যাদি। এককথায়, মাস্কিট্রন সকল পরিস্থিতিতে মানুষকে সুখের অনুভূতি দিতে পারবে, যেন মাস্কিট্রন পারবে না এমন কিছুই নেই!
কল্পকাহিনীগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেকটি কল্পকাহিনীর বিষয়বস্তু একটি বিশেষ দিক থেকে এক। তবে তাদের প্রেক্ষাপট, দৃশ্যপট ভিন্ন। প্রত্যেকটি কল্পকাহিনীতে লেখক পাঠকদের বিমোহিত করার চেষ্টা করেছেন, এক্ষেত্রে তার চেষ্টা সার্থক। লেখকের দারুণ বর্ণনাশৈলী এবং সুন্দর ব্যাখ্যা কল্পকাহিনীগুলোকে দারুণ রূপ দিয়েছে।
তুলনা করলে এদের মধ্যে ‘ইকারাস’ একটু ভিন্ন ধাঁচের কল্পকাহিনী। এতে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও মানবিকতার দেখা পাওয়া যায়। তবে ‘ইকারাস’ ব্যতীত প্রত্যেকটি কল্পকাহিনীতে দেখা যায় মানুষের শারীরিক গঠনের পরিবর্তনের ফলে মানুষের মানবিক গুণাবলী, মানবিক জ্ঞান সম্পূর্নরূপে বিনষ্ট হয়। প্রত্যেকটি কল্পকাহিনীর শেষের পরিণতি প্রায় একইরকম। ‘ইকারাস’ ব্যতিত বাকি চারটি কল্পকাহিনীর মধ্যে বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং ভবিষ্যত পৃথিবী কেমন হবে তার গুরুত্ব দিয়েছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইগুলো অনলাইনে কিনতে ঘুরে আসুন রকমারি.কম থেকে