হিজ হাউজ: অবশেষে ‘হন্টেড হাউজ’ সাব-জনরায় নতুনত্বের খোঁজ

প্রতিটা পদক্ষেপে তার শ্বাস আরো দীর্ঘ হচ্ছে। কাঁধে মাথা রেখে মেয়েটা ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে আছে। হাতের আঙুলে নির্বিকার ভঙ্গীতে ঝুলে আছে তার খেলনার সাথী, পুতুলটা। ওই জড়বস্তুটাকে আরো প্রাণহীন আর খটখটে দেখাচ্ছে। তা সম্ভবত পরিস্থিতির বিরূপতায়। এরপর সিনেমা কাট করে চলে গেল ভ্যানে মানুষ ওঠানোর দৃশ্যটায়। আরো একজনও ভ্যানে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। এরা কি পালাচ্ছে? কিন্তু কেন? কার বা কীসের থেকে বাঁচতে? বাঁচতেই যে পালাচ্ছে, সেটা তাদের চোখের গভীর আকুতিতে স্পষ্ট। নিজস্ব ভাষায়, বাচ্চা মেয়েটার কানে মুখ রেখে মা বলল, “আমি তোমাকে রক্ষা করব।” আরেকটা জাম্প কাট করে সিনেমা চলে গেল মানুষের ভারে ডুবুডুবু অবস্থায় কোনরকমে এগিয়ে চলা নৌকার কাছাকাছি।

হঠাৎ, পানির নিচ থেকে উঠে এল কারা যেন। কিছুতেই এদের পার হতে দেবে না। টেনে নিয়ে গেল বাচ্চা মেয়েটাকেও। বাবা-মা রক্ষা করবে, সে আশায় ছোট্ট শরীরটার সমস্ত শক্তি এক করে চিৎকার ছুঁড়ল। তারপর স্তব্ধতা! খুলে গেল লোকটার চোখ। সেই বাবা। পাশেই, তার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে মা। জানতে চাইল নির্লিপ্তকণ্ঠে, “কী স্বপ্ন দেখলে?” উত্তর এল, “না না তেমন কিছু না। আমাদের বিয়ের দিনটা দেখছিলাম।” প্রত্যুত্তর, “চিৎকার করার ব্যাখ্যাটা তবে খাপেখাপ।” এই সংক্ষিপ্ত বাতচিতে পরিস্থিতি বিবেচনায়, শুকনো রসবোধ যেমন যুক্ত করা হয়েছে, তেমনি তাদের দাম্পত্য জীবনের অবস্থার পূর্বাভাসও রূপকার্থে দিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। 

তারা দু’জনে যেখানে আছে, জায়গাটিকে হাসপাতাল ভেবে সহজেই ভুল করা যায় প্রথমে। মূলত সেটা শরণার্থী শিবির। হ্যাঁ, তারা শরণার্থী। স্বপ্নের দৃশ্যটার ব্যাখ্যা এবার তবে অনেকটাই স্পষ্ট। দক্ষিণ সুদানের লোক তারা। যুদ্ধবিধ্ধস্ত সুদান থেকে পালিয়ে এই ইংল্যান্ডে এসেছে। এখানে এসেই সিনেমার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে একদম সাম্প্রতিক এবং সংবেদনশীল। এবং পরবর্তী হরর আবহকে আলাদা করে অনুনাদী করে তোলার একটা যোগ্য উপাদান। অবশ্য, যুদ্ধই তো সবচেয়ে বড় হরর। 

শরণার্থী শিবিরে;
Image Source: NETFLIX

 

তো এই দম্পতিকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় আলাদা করে। শরণার্থী শিবিরে তাদের ভালো ব্যবহারের জন্য এখান থেকে তাদের ছুটকারা মিলছে। না, স্বাধীন নয়। সরকার থেকে তাদের আলাদা করে একটা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ঘরেই তাদের থাকতে হবে। বেঁধে দেওয়া সময় অব্দি কোনো কাজের সন্ধান তারা করতে পারবে না। প্রতিদিন খাবার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে যাওয়া হবে। কোনোরকম সামাজিক মেলামেশায় তারা যেতে পারবে না। ঘরে কোনো পার্টির ব্যবস্থা করতে পারবে না। কোনোরূপ হল্লা মাচানো যাবে না। আরো অনেক বিধিনিষেধ। দম্পতির মধ্যে স্বামী যে, বোল তার নাম, সে সবকিছুতে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি দিল। থাকার জায়গা তো পাচ্ছে। বাড়িটাও বেশ বড়সড়।

ঘরের চাবি এবং নিয়মাবলী বুঝিয়ে দিতে আসা ব্রিটিশ লোকটা তো বলেই ফেলল, “এটা তো আমার ঘরের চেয়েও বিশাল। রাজপ্রাসাদ রীতিমতো।” ওই কথায় সুগারকোট করে যেন সে বলে দিচ্ছে, “একে তো উড়ে এসে ঘাড়ে বসে রক্ত খাচ্ছ। তার উপর আবার খাতিরদারির নমুনা হিসেবে এত বড় বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা। রাজার কপাল একেবারে।” যত যা-ই হোক, বাইরের লোক তো তারা। দম্পতিও অবাক হলো এত বড় ঘর পেয়ে। বোল তো খুবই উত্তেজিত, নতুনভাবে জীবন শুরু করবে বলে। কিন্তু স্ত্রী রিয়াল নিশ্চুপ। অতীতের তিক্ততা আর বর্তমানের অনিশ্চয়তায় স্বাভাবিক আনন্দের বহিঃপ্রকাশটা তার মাঝে দেখতে পাওয়া যায় না। 

সেই ঘরে বোল এবং রিয়াল;
Image Source: NETFLIX

তাদের দু’জনের বৈপরীত্যটা সামনে আসে খুব শীঘ্রই। একদিকে বোল টেবিলে বসে, খাওয়ায় কাঁটা চামচের ব্যবহার করে, পোলো শার্ট পরে ঘুরে বেড়ানোয় প্রাণপণে নিজেকে ব্রিটিশদের একজন করে তোলার চেষ্টা করছে; অতীতসত্ত্বা ভুলে। ওদিকে রিয়াল নিজস্ব পোশাক পরে, মেঝেতে বসে, হাত দিয়ে খাওয়ার বিষয়গুলোতে নিজের সংস্কৃতিটাকেই ধরে রাখার চেষ্টা করছে। ওটাই যে তার পরিচয়ের বাহক। বোলের নতুনভাবে জীবন শুরু করার প্রস্তাবে সে একটাই প্রশ্ন করে, “কীভাবে এত তাড়াতাড়ি দুঃস্বপ্নটা ভুলতে পারো? আমাদের মেয়ে…” বোল মুখে হাত দিয়ে কথা শেষ করতে বাধা দেয়। চটে যায়।

কিন্তু সমস্যাটা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। পাড়াপড়শিদের বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ, ঘৃণা তাদের একদম কোণঠাসা করে রাখে। তার উপর এই বড় ঘর কেন তাদের দেওয়া হলো, সে সন্দেহ তো ছিলই। সেটা গাঢ় হয়, যখন কাঠের সিঁড়িতে চিড়চিড় শব্দ ধরিয়ে কারো পদক্ষেপ এগিয়ে আসে। ঘরের ফাঁপা দেয়ালগুলোর ভেতর থেকে আসে শব্দ। কানের পাশ দিয়ে হঠাৎ যেন বাতাস কাটে কারো উপস্থিতি। না, এসব শুধুই বোলের অতীতের ট্রমা থেকে উদ্ভুত আতঙ্ক নয়। কারণ সেসব রিয়ালও দেখতে, শুনতে পায়। তাহলে কেন অদ্ভুত ঘটনাবলী এবং অদ্ভুত সব অবয়বের প্রতি তাদের দু’জনের আচরণ দু’রকম? কী স্বীকার করার জন্য জোর করে সে, বারবার বোলকে? সেসবের অনুসন্ধান চালাতে তো যেতে হবে আরো গভীরে। 

‘হিজ হাউজ’ পরিচালক রেমি উইকসের অভিষেক সিনেমা। চিত্রনাট্যটিও তার লেখা। গল্পটির মুন্সিয়ানার জায়গা হলো, যুদ্ধের মতো একটা জান্তব হররকে ব্যবহার করে মানব মনের অন্ধকার জায়গাটিতে আলোকপাত করার চেষ্টা, যেখানে শুধু ভয় আর ত্রাসের রাজত্ব। এবং তেমনটি অঙ্কন করতে লেখা চিত্রনাট্যটিও হয়েছে ওমন প্রগাঢ়। ‘হন্টেড হাউজ’ সেটিংয়ের মাঝে শরণার্থী সংকটকে সামনে এনেছে এই সিনেমা। স্বদেশীয় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বিবেচনায় যা এদেশীয় দর্শকদের কাছে খুবই নিকটের বলে মনে হবে। এই সিনেমা তার সেটিং আর হরর জঁনরার অবিচ্ছেদ্য অলংকার ‘জাম্প স্কেয়ার’কে ব্যবহার করে দু’জন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, জটিলতা ও ভয়ের গভীরে পৌঁছেছে। একাকিত্ব, বিদ্যমান ব্যবস্থার ভঙ্গুরতাকে সামনে এনেছে। হারানোর বেদনা, না ভুলতে পারার কষ্ট থেকেই যেন ওই ভূতেদের সৃষ্টি। তারাও যেন বয়ে বেড়াচ্ছে এক করুণ গ্লানি। বায়বীয় আত্মা নয়, রক্তমাংসের ভূত তারা। 

প্রথম যখন কিছুর উপস্থিতি টের পেলো বোল;
Image Source: NETFLIX

 

এবং এই জায়গাটিই হিজ হাউজকে এই জঁনরার অন্য ১০টি সিনেমা থেকে ভিন্ন করেছে। ভূত এখানে মস্তিষ্কের গভীরে প্রোথিত ভয় থেকে সৃষ্ট নয়, যেমনটা বলা হচ্ছিল; তারা রক্তমাংসের ভূত। শুধু বোল নয়, রিয়ালও তাদের দেখতে পায়। কিন্তু রিয়াল ভয় পায় না। এই জায়গাটায় এসে, একই ছাদের নিচে বাস করা এই দম্পতির ভিন্ন আর দ্বন্দ্বের বিষয়টা অভিঘাতী হয়ে ওঠে। বোল ভুলে যেতে চায়, সে শরণার্থী। সে ভুলতে চায় তার অতীত। মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হওয়াটা আসলে তার কাছে একটা ‘কোপিং মেকানিজম’।

রিয়ালের ক্ষেত্রে সেটা কাজ করে বিষাদে ডুবে থাকায়। বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকার কষ্ট, কোণঠাসা হয়ে পড়ার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার অস্ত্রটা তার কাছে শুধু অতীতে পড়ে থাকাটাই; যা ক্রমশ তাদের দাম্পত্য জীবনে একটা শীতল যুদ্ধের আবহ তৈরি করে। এবং তখনই বুঝতে পারা যায়, ঘরটা ভূতুড়ে নয়। ঘরের মানুষগুলা ভূতুড়ে। তাদের বেদনাহত স্মৃতিগুলো ভয় হয়ে দৌড়ে বেড়ায় সারা ঘর জুড়ে। আর এই দু’টি মানুষের চরিত্রে সোপ দিরিসু এবং উনমি মোসাকু’র অভিনয়, প্রলেপিত ও শক্তিশালী। দু’জনের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো ভিন্ন পুরোপুরি। কিন্তু দু’জনের এই বৈপরীত্যের রসায়নটা তাদেরকে একদম পাশাপাশি থেকে দেখতে সহায়তা করেছে। 

সিনেমাটোগ্রাফার জো উইলেমস’কে সাথে নিয়ে রেমি উইকস ছায়ায় মিশে থাকা হররটাকে ক্যামেরায় ধারণ করেছেন দক্ষতার সাথে। স্পেসের ব্যবহার এত সূক্ষ্মতা আর সতর্কতার সাথে করেছেন যে, মুখে আঁকিবুঁকি আঁকা ওই ভূতেদের করুণ চোখের তাকানোটাও দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হন্টেড হাউজ জঁনরার সিনেমা হিসেবে একটা নতুন ভিজ্যুয়াল ভাষা দেখা যায় এই সিনেমায়। সুরিয়াল দৃশ্যগুলোতে তা সবচেয়ে বেশি নজরে আসে। বোল টেবিলে বসে খাচ্ছে। ধীরে ধীরে জায়গাটা আরো পিছিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালটা সরে যাচ্ছে। তারপর দেখা যায় অথৈ জলে পড়েছে বোল। তার দিকে এগিয়ে আসছে মৃতরা, তাদের হন্তারকেরা। এই গোটা দৃশ্যটি যেন তার পরবাসের অভিজ্ঞতাকেই তুলে ধরে। পানি, অন্য আরো দৃশ্য এই কথাটিই বারবার মনে করিয়ে দেয়।

সেই দৃশ্যটি;
Image Source: NETFLIX

তারপর আরেক দৃশ্যে দেখা যায়, রিয়াল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে। কিন্তু ম্যাপ দেখে হাঁটতে হাঁটতে এক গোলকধাঁধায় পড়ে যায় সে। দেয়ালগুলো তাকে যেন আটকে ফেলবে। ফুটবল নিয়ে খেলা ওই বাচ্চা ছেলেকে বারবার ক্রস করতে গিয়ে ভয়টা তার চরমে পৌঁছে। এই দেয়ালগুলো যেন দুটো দেশের মাঝে দাঁড়ানো দেয়াল। পাড়াপড়শি আর তাদের মাঝে দাঁড়ানো অদৃশ্য দেয়াল। জেনোফোবিয়ার সৃষ্ট দেয়াল, এই বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য আরো শক্তিশালী হতে পারত যদিও। এমনকি নিজের স্বামী আর তার মাঝে তৈরি দেয়াল। চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে রেখে দাঁড়িয়েছে শুধু দেয়াল। ট্র‍্যাকিং আর ক্লোজ শটের সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা রক বানোস-এর অন্তর্ভেদী মিউজিক রিয়ালের ভয়টাকে স্পর্শনীয় করেছে। তার মেলোডিয়াস মিউজিকের সাথে সাউন্ড মিক্সিং-এর চাপা আর্তনাদ যুক্ত হয়ে হররের অভিজ্ঞতাটাকে জীবন্ত করেছে।

হিজ হাউজ’কে বলা যায় মাতি ডিওপের ‘আটলান্টিকস’ (২০১৯) সিনেমার ‘স্পিরিচুয়াল সাক্সেসর’। হন্টেড হাউজের পরিচিত অলঙ্কার ব্যবহার করে নতুন কিছু উপহার দিয়েছে এই সিনেমা। সেইসাথে রেমি উইকস তার স্বকীয়তার জানানও দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, হিজ হাউজে ‘হরর’ আছে, ‘হার্ট’ও আছে।

This article is a bengali review of the film 'His House' (2020). It's directed by the debutent director Remi Weekes, hailed from South Sudan. It depicts the modern refugee crisis in a haunted house setting. The film is applauded by the critics and it's been described as, one of the best films in the haunted house sub-genre.

Featured Image: Netflix

Related Articles

Exit mobile version