বাংলাদেশের শিক্ষিত নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন কেউ কি আছেন যাদের বাসা, সেলফোন কিংবা কম্পিউটারে, কোথাও কোনো ডিকশনারি বা অভিধান নেই? বাঙালি অত্যন্ত মেকি সংস্কৃতিমনষ্ক জাতি বলে আমাদের অধিকাংশ মানুষের কাছে বাংলা অভিধান থাকা তো দূরের কথা, বেশিরভাগ বাঙালি ‘অভিধান’ শব্দের মানেই বুঝি না। তবে হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকেই ইংরেজিতে পড়াশোনার জন্য, শব্দের অর্থ বোঝার জন্য বা বাক্যে শব্দ ব্যবহারের ধরন বোঝার জন্য আমাদের সবারই একটি ‘ইংলিশ টু বেঙ্গলি’ ডিকশনারি থাকে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের মধ্যে পঁচানব্বই ভাগ মানুষেরই ‘ইংলিশ টু বেঙ্গলি’ ডিকশনারি বলতে যেটা থাকে সেটার উপর বড় বড় করে লেখা থাকে ‘Oxford English Dictionary’। কিন্তু না, অক্সফোর্ড ডিকশনারি বলতে আপনি যেটা পড়েন সেটা আসল Oxford English Dictionary (OED) না। আপনি যেগুলো পড়েন সেগুলো বাংলাদেশে ছাপানো হয় এবং বাজারে কাটতি বাড়ানোর জন্য নাম দেয়া হয় ‘অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’। আসল অক্সফোর্ড ডিকশনারির জন্ম ইংল্যান্ডে, বাংলাদেশে নয়।
১৮৫৭ সাল; ইংল্যান্ডের ভাষাতত্ত্ববিদগণ (Philological Society of London) দেখলেন, ইংরেজি ভাষার ডিকশনারিগুলো অসমাপ্ত, ত্রুটিপূর্ণ এবং অপর্যাপ্ত। ফিলোলজিক্যাল সংঘের সদস্যরা একটি নতুন, পরিপূর্ণ ও পরীক্ষিত ইংলিশ ডিকশনারি তৈরি করতে চাইলেন। কিন্তু সেসময় তাদের মনে হয়েছিল, তারা এক অলীক উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বপ্ন দেখছেন। তারা তখনও ভাবতে পারেননি, তাদের এই ছোট্ট উদ্যোগ একদিন তাদের স্বপ্নের মতোই বৃহদাকার ধারণ করবে। প্রথমদিকে এই নতুন ডিকশনারি প্রণয়নের কাজ ফিলোলজিক্যাল সোসাইটির হাতে ধরে খুবই ধীর গতিতে চলছিল। এরপর ১৮৭৯ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের সাথে ফিলোলজিক্যাল সোসাইটি একটি চুক্তি করে এবং জেমস মারির নেতৃত্বে ডিকশনারি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়।
নতুন ইংলিশ ডিকশনারিকে চার খণ্ডে, ৬,৪০০ পৃষ্ঠায় ভাগ করার কথা ভাবা হয়; যেখানে মোটামুটি ১১৫০ সালের পর থেকে ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত সমস্ত শব্দ অন্তর্ভুক্ত হবে। পাশাপাশি সেসময় নতুন যেসব শব্দ ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয় সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়।
ভাষাতত্ত্ববিদগণ এই নতুন ডিকশনারি প্রণয়নের কাজ দশ বছরে শেষ করার জন্য ছক কষে মাঠে নেমে পড়েন। পাঁচ বছর অতিক্রম করার পর মারি এবং তাঁর দল দেখলেন, তাঁরা সবে ‘ant’ শব্দে এসে পৌঁছেছেন। ডিকশনারি প্রণয়নের কাজ যে পরিকল্পিত সময়ে শেষ হবে না- এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কাজ যে বড় বেশি শ্লথ গতিতে চলছে! মারি এবং তাঁর সতীর্থরা দমে না গিয়ে ডিকশনারিতে নতুন নতুন শব্দ অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি পূর্বে অন্তর্ভুক্ত করা শব্দগুলো নিয়েও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে ১৮৮৪ সালে মারি এবং তাঁর দল ডিকশনারির প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল, ফিলোলজিক্যাল সোসাইটি যে ডিকশনারি প্রণয়নের স্বপ্ন দেখেছিল সেটিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য আরো বুদ্ধিদীপ্ত ও কঠোর সাধনার প্রয়োজন। তাঁরা কাজটিকে যতটা কঠিন ভেবেছিলেন সেটি আসলে তার থেকেও অনেক বেশি কঠিন।
পরের চার দশক ধরে ডিকশনারি প্রণয়নের কাজ চলতে থাকল এবং আরও নতুন নতুন সম্পাদক যুক্ত হলেন এ কাজের সাথে। ততদিনে জেমস মারি, হেনরি ব্র্যাডলি, ডব্লিউ. এ. ক্রেইগি ও সি. টি. অনিয়নসের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে অনেক বড় একটি দল। অবশেষে ১৯২৮ সালের এপ্রিলে ডিকশনারির শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মূল নেতা জেমস মারি সম্পূর্ণ ডিকশনারিটি দেখে যেতে পারেননি। যে ডিকশনারি প্রণয়নের জন্য তিনি তাঁর পুরো জীবন সাধনা করে গেলেন সেটি অসমাপ্ত রেখেই ১৯১৫ সালে মারা যান মারি।
ডিকশনারিটি হওয়ার কথা ছিল চার খণ্ডে, ৬,৪০০ পৃষ্ঠায়। কিন্তু যা হলো সেটা এর চেয়েও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নতুন ডিকশনারিটি ৪ লাখ শব্দসমষ্টি (Phrase) ও শব্দসম্বলিত দশ খণ্ডের বিশাল আকারে প্রকাশিত হলো। নাম দেয়া হলো ‘A New English Dictionary on Historical Principles’। এই ডিকশনারি ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাষার প্রধান এবং চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ (Ultimate authority) হয়ে উঠলো।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ বদলায়, মানুষের জীবন বদলায়, সংস্কৃতি বদলায়, বদলায় ভাষাও। ভাষাকে বেঁচে থাকতে হয় বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। যে ভাষা বা সংস্কৃতি সময়ের আবেদন বুঝতে পারে না, সময়কে ধারণ করতে পারে না, সেই ভাষা তার সমৃদ্ধির জোরে খুব বেশিদিন টিকতে পারে না। ঠিক এ কারণেই ল্যাটিন বা সংস্কৃতের মতো সমৃদ্ধ ভাষাও আজ ‘মৃত ভাষা’ (Dead Language)। যেহেতু ভাষা বদলায়, সেহেতু ভাষার ব্যাকরণ, অভিধান এসবও বদলায়। ভাষা তো সময়ের সাথে সাথে বদলায়, কিন্তু অভিধান ও ব্যাকরণকে ভাষার বিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্ধন, পরিবর্তন করতে হয় মানুষকেই। এ কথা ভাষাতত্ত্ববিদদের চেয়ে ভালো কে বুঝবে?
দশ খণ্ডের ডিকশনারি প্রকাশ করেই দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি ভাষাতত্ত্ববিদরা। ক্রেইগি ও অনিয়নস, এই দুই সম্পাদক ডিকশনারি প্রণয়নের কাজ শেষ হওয়ার পরেও ডিকশনারি হালানাগাদের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা ১৯৩৩ সালে একখণ্ডের Supplement (ক্রোড়পত্র) প্রকাশ করেন। প্রায় একই সময়ে মূল ডিকশনারি ১২ খণ্ডে পুনঃমুদ্রিত হয় এবং নতুন নাম নেয় ‘Oxford Dictionary English’; যে নামে সারা পৃথিবীর কাছে সুপরিচিত। ১৯৫৭ সালে রবার্ট বার্চফিল্ডের সম্পাদনায় একটি নতুন ‘Supplement’ প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জের অনেক শব্দ যুক্ত হতে থাকে অক্সফোর্ড ডিকশনারির শব্দভাণ্ডারে। ১৯৭১ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় ‘Supplement’ এর আরও চার খণ্ড।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ প্রিন্ট মিডিয়াবিমুখ হয়ে উঠল, ইলেকট্রিক মিডিয়ার ব্যাপক প্রচলন শুরু হলো। অক্সফোর্ড ডিকশনারিরও যুগে সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজন হলো। ১৯৮৪ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারিকে কম্পিউটারাইজড করার জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস এক নতুন প্রজেক্ট হাতে নিল। পাঁচ বছরের নিরবচ্ছিন্ন কাজের পর ১৩.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার ব্যয়ে পুরো অক্সফোর্ড ডিকশনারিকে কম্পিউটারাইজড করা হলো। জন সিম্পসন, এডমণ্ড ওয়েইনার এবং তাদের দল অক্সফোর্ড ডিকশনারির এই নতুন ভার্সনকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করলেন। এই ভার্সনে নতুন করে যুক্ত হলো পাঁচ হাজার নতুন শব্দ। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হলো অক্সফোর্ড ডিকশনারির এই নতুন সংস্করণ, যা অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির দ্বিতীয় সংস্করণ। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হলো অক্সফোর্ড ডিকশনারির সিডি-রম এডিশন। জেমস মারিদের স্বপ্নের ডিকশনারি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল মাত্র ১৫০ পাউণ্ড ওজনের একটি ডিস্কে করে।
এতটুকু কাজ শেষ দিয়েও অক্সফোর্ড ডিকশনারির কর্তাব্যক্তিরা বসে থাকেননি। অক্সফোর্ড ডিকশনারিকে সময়োপযোগী করতে তৈরি হয়েছে অনলাইন সংস্করণ। অক্সফোর্ড ডিকশনারি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই নিরবচ্ছিন্ন সংযোজন-বিয়োজন অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিকে করে তুলেছে ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে নির্ভুল অভিধান। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি হয়ে উঠেছে সারা দুনিয়ার ইংরেজি ভাষাভাষী, ইংরেজি ভাষার শিক্ষার্থী, সাধারণ শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষ থেকে পণ্ডিতজনের কাছে ভাষাগত সমস্যা সমাধানের এক তীর্থস্থানস্বরুপ।