বইটিকে ঠিক কোন ধারার বইয়ের কাতারে ফেলা উচিত তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। তবে যিনি আমাকে এই বইটি পড়তে উৎসাহিত করেছিলেন তিনি বলেছিলেন,
‘It’s about everything. Read it first, otherwise you can’t understand.’
পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, আসলেই তো, কী নেই এখানে! জীবন, দর্শন, তত্ত্ব, ধর্ম, নারী, মাদক, যুদ্ধ, অপরাধজগৎ, অন্ধকার, আলো সবকিছু নিয়েই মোটের উপর উপন্যাস হিসেবেই বাজারে প্রচলিত।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের কোবার্গ শহরে অবস্থিত ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন ‘পেন্টরিজ’। গল্পের মূল চরিত্র একসময় ছিলেন হিরোইনে আসক্ত একজন ব্যাংক ডাকাত, তার ১৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়, আর তাকে রাখা হয় এই জেলখানায়। সেখান থেকে দিনে-দুপুরে দেয়াল টপকে পালিয়ে ভারতে আসেন। তারই জবানীতে পুরো উপন্যাসের যাত্রা, যেখানে প্রতিটা সংলাপে আপনি পাবেন ভিন্ন মাত্রা। ঘটনাক্রমে পরবর্তী দশ বছরে তিনি হয়ে উঠেন, অস্ট্রেলিয়ার মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান। Lindsay Ford নামে নকল পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে আসলেও পরবর্তীতে বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি লীন বা শান্তারাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
বোম্বে এয়ারপোর্টে নেমেই তার পরিচয় হয় সদা হাস্যোজ্জ্বল মারাঠা গাইড প্রভাকরের সাথে, যিনি কি না পরবর্তী জীবনে লীন থেকে শান্তারাম হয়ে উঠার পথে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
অপরাধী হিসেবে জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় তিনি লীন থেকে শান্তারাম কীভাবে হয়ে উঠেন সেই যাত্রার বর্ণনা উঠে আসে উপন্যাসে। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে তার মানবিক পরিবর্তন ঘটে, সাথে ঘটে আত্মিক উন্নতি। যাদের সংস্পর্শে এ সকল পরিবর্তন ঘটে এই উপন্যাসে, কিংবা বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ডে, কোনোটিতেই তাদের ভূমিকা কম নয়। তবে তার আগে বোম্বে’র বস্তিতে বসবাসরত সাদা চামড়ার মানুষ লীন কীভাবে বস্তির মানুষের সাথে মিশে যায়, মারাঠি ভাষা শিখে, এসবের দৈনন্দিন নিটোল বিবরণ শুনতে শুনতেই গল্প জমে যাবে।
বোম্বে’র প্রথম দিনেই খুঁজে পান তার ভালবাসাকে, কার্লা। রহস্যময়ী সুইস সুন্দরী। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেলেও, তার প্রেম তাকে কীভাবে, কোথায় নিয়ে যায়, তা জানতে হলে বইটি পড়তেই হবে। আপনার যদি প্রেমকাহিনী পছন্দ না হয়, কোনো সমস্যা নেই, গল্পের বুননে আপনি একরত্তি আদিখ্যেতা পাবেন না। কেননা, একজন লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে আসামীর জবানবন্দিতে উঠে আসে পুরো ঘটনাক্রম। যেখানে ধর্ম, তত্ত্ব, দর্শন, রাজনীতি, এমনকি হাল আমলের সোভিয়েত-তালেবান যুদ্ধেরও চাক্ষুস বিবরণ পাওয়া যায়। ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের বানিজ্যের আঁচ পাবেন নিপাট লেখনীতে।
সবচেয়ে সুখকর ব্যাপারটা ছিল গল্পের গাঁথুনি। একজন পলাতক আসামী পর্যটকের ছদ্মবেশে উপমহাদেশের অপরাধজগৎ কীভাবে চষে বেড়ায়, তা যেমন উঠে আসে, পাশাপাশি সামাজিক পরিস্থিতির সাথে সে কীভাবে একজন ভারতীয়ের তুলনায়ও অধিক ভারতীয় হয়ে উঠে, তাও দেখতে পাবেন।
মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বোম্বে’র বস্তিতে বসবাস, জীবনধারন, পাপমোচন আর আক্ষেপ, সকল মানবিক ভাবনা উঠে আসে খুবই মন্থর কিন্তু সাবলীল ভঙ্গিতে। আপনাকে ওগুলো রপ্তবাক্য হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে না, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী পাঠের জন্য ইতিহাস অধ্যয়নেরও প্রয়োজন নেই। সরল লেখনী আর অসাধারণ বাস্তবতা দর্শন আপনার ভোঁতা অনুভূতিগুলো সজাগ করবে নিজের অজান্তেই, উপন্যাস হিসেবে গোগ্রাসে গিলতে সমস্যা হবার কথা নয় মোটেও।
এই পৃথিবীতে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, ঠিক বুঝতে না পারা, কিংবা আদর্শ আর স্বার্থের দ্বন্দ্বে পিষ্ট মানুষের জীবনে সামাজিক বাস্তবতায় খেই হারিয়ে ফেলা এক সাধকের ন্যায় ভালো-মন্দের সুক্ষ্ম যে ব্যবধানটি কাঁটাতার জিইয়ে রাখে, তা উঠে আসবে দার্শনিক কিছু সংলাপে। তর্কে-বিতর্কে বিদ্ধ হয়ে সিদ্ধদর্শন না হলেও বাস্তবতার নিরিখে উতরে যায়, অভিজ্ঞতার আধার হিসেবে। ঐশ্বরিক লীলাখেলা ও এর আড়ালের মানুষের রাজনীতি, বিশ্বাস ও ব্যবসা, লোভ ও নির্মোহ ভালোবাসা, অকৃত্রিম বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা মাদক, নারী, শ্রম-ঘামের ঘ্রাণ, আর সমসাময়িক বোম্বে’র রঙিন আলোর পেছনের নিকষ অন্ধকারের গান- সব মিলিয়ে আপনার স্নায়ু যে চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যাবে, তার ঘোর কাটতেই সময় লাগবে নিশ্চিতভাবে। এজন্য আমাকে দায়ী করবেন না, প্লিজ।
মুম্বাইয়ের কুখ্যাত আর্থার রোড জেল, কোলাবা, মেরিন ড্রাইভ, বলিউড, ওয়াল স্ট্রিট স্ল্যাম, লিওপোল্ড ক্যাফে, বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ড ঘুরে আসবেন সরল লেখনীতে। গল্প বলার ভঙ্গিটা চমৎকার লেগেছে আমার; কোথাও বাড়তি মেদ নেই। কী অসাধারণ বলিষ্ঠ বর্ণনা একদম সরল ভঙ্গিতে। একজন হিরোইনসেবী পলাতক আসামী হিসেবে অসাধারণ প্রতিভা বটে! বিশ্ববিখ্যাত টেলিগ্রাফ পত্রিকার মতে, ‘literary masterpiece’। আমার কাছেও মাস্টারপিস মনে হয়েছে।
একজন আপাত অপরাধীর জীবনের চড়াই-উতরাই, আক্ষেপ-অভিমান, ভালবাসা-ভুল, সোজা কথায় তার ভাষ্য উঠে আসে এখানে। যদিও লেখক এটিকে আত্মজীবনী না বলে উপন্যাস হিসেবেই পরিচয় দেন। কিন্তু নব্বইয়ের সেই বোম্বে যেন নতুন এক দুনিয়া, যেখানে মাদক, নারী, অস্ত্র একে অপরের পরিপূরক। সেই সাথে ভয়ংকর এসব অপরাধী, তথা গ্যাংস্টারদের মানবিক গুণাবলিতে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য।
এর গল্পে মূল সৌন্দর্য্য হলো এর সংলাপ। অন্তত এই উপন্যাসের সংলাপ চয়ন তা-ই বলে। সম্মোহিত হয়ে থাকবেন এর গল্প বলার ভঙ্গিতে। যেখানে উঠে এসেছে শতবর্ষী সাধকের দর্শন। হৃদয়গ্রাহী এ সকল সংলাপ আপনাকে ঘোরের মধ্যে রাখবে, আর কাহিনী আপন গতিতেই এগিয়ে যাবে, বুঝতেও পারবেন না। সবচেয়ে অদ্ভুত অনুভূতিটা হলো, এখানে থ্রিল আর দর্শনের এমন দুর্লভ সন্নিবেশ সার্থকভাবে লেখক করেছেন যে, বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। কিছু সংলাপ বাঁধাই করে ঘরে রাখার মতো।
বইয়ের নাম: শান্তারাম || লেখকের নাম: গ্রেগরী ডেভিড রবার্টস
প্রকাশনী: Abacus || অনলাইন প্রাপ্তিস্থল: রকমারি