সুফি’ শব্দটা শোনামাত্রই অনেকের কল্পনায় চলে আসে জালাল উদ্দিন রূমির হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কিছু শব্দমালা,
“আমি প্রভুকে বললাম,
আমি তোমাকে জানার আগে মরবো না!
প্রভু উত্তর দিলেন,
যে আমাকে জানে সে কখনো মরে না!”
কারো ভাবনা জগতে আবার ‘সুফি’ শব্দের সাথে জড়িয়ে আছে হাসান বসরি, আব্দুল কাদের জিলানি, মুজাদ্দেদ আলফে সানির মতো জগদ্বিখ্যাত অনেক নাম। এদিকে আমাদের দেশের একটা বিরাট অংশ ‘সুফি’ বলতেই মনে করেন মাজার, পীর-মুরিদদের নানাবিধ কাজকর্ম। তাহলে প্রকৃত সুফিবাদ আসলে কেমন? বিখ্যাত সুফি সাধকরা কীভাবে এর চর্চা করতেন। শরীয়তের কষ্টিপাথরে কতটা মানোত্তীর্ণ ছিলেন তাঁরা?
এতসব প্রশ্নের উত্তর প্রচলিত তথ্য ঘেঁটে কি আদৌ জানা সম্ভব? মনে হয় না। সুফিবাদের গভীরতা সম্পর্কে জানতে হলে পাড়ি জমাতে হবে এক বিস্ময়কর রহস্যলোকে। কিন্তু এগোনো যায় কোন পথে? কোনো মরমি সুফি সাধকের সান্নিধ্য বা ঐতিহাসিক নথিপত্র হতে পারে সমাধান। এমন ভাবনা থেকেই রচিত হয়েছে ‘সুফি চৈতন্যের বিচিত্র কথকতা’। বইটিতে তাসাউফ, সুফিবাদসহ কারামতের মতো আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে সংকলিত কিছু অনূদিত প্রবন্ধে উঠে এসেছে সুফি সাধকদের বিচিত্র সব ভাবনা ও নানা সমালোচনা, পর্যালোচনা।
সুফি চৈতন্যের বিচিত্র কথকতা
সুফি চৈতন্যের বিচিত্র কথকতা; Image source: wafilife.com
১
মোট ৪টি ভাগে সুফিবাদ ও তাসাউফ নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে বইটিতে। প্রথমেই ইবনে সিনা ও মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবির মতো প্রখ্যাত সুফিদের নিজস্ব ভাবনার আলোকে ধারণা দেওয়া হয়েছে সুফি হয়ে ওঠার বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে। তবে বইটির তথ্যগত সহায়তা নিয়ে যদি কারো মনে আবার ‘সুফি’ বনে যাওয়ার প্রয়াস জাগে! নির্ঘাত বোকামি হবে সেটা। প্রকৃত সুফি হয়ে ওঠার একেকটা ধাপ পাড়ি দিতে হয় কঠোর আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়ে। সুফিদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর যে ধাপগুলোর ব্যাপারে বলা হয়েছে বইটিতে, তার সবই ছিল নিগূঢ় আত্মিক উপলব্ধির। ফলে একই বিষয়ে বিজ্ঞ সুফিদের চিন্তার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বৈচিত্র্য। কাছাকাছি বিষয় নিয়ে তাঁদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পরিভাষা। এতে সাধারণ পাঠক কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে পারে। প্রথমদিকে অনেক কিছুই এলোমেলো মনে হতে পারে।
বইটির দ্বিতীয় অংশকে বলা হচ্ছে সমালোচনা ও পর্যালোচনা। এ পর্যায়ে সুফিবাদ নিয়ে ইবনে তাইমিয়া, হাসান আলী নদভি ও ইবনুল জাওযীসহ আরো বেশ কয়েকজনের সুচিন্তিত পর্যালোচনা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকেই শরীয়তের সাথে সুফিবাদের দূরত্ব ও ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সমালোচনা করেছেন দায়িত্ব নিয়ে। ইচ্ছাকৃত বদনাম বা মিথ্যাচার করেননি। ইতিহাস থেকে তুলে ধরেছেন কীভাবে হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর পর সুফিবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সাথে নিখুঁতভাবে খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে শরীয়তের যথাযথ অনুসরণে অন্তরের পরিশুদ্ধতা হাসিলের সঠিক উপায়।
সূচিপত্র; Image source: Wafilife.com
২
‘সুফি চৈতন্যের বিচিত্র কথকতা’র শেষ দুই ভাগের শুরুতে আলোচনা আবর্তিত হয়েছে একজন তুর্কি মহাপুরুষকে ঘিরে, যিনি নিজেকে সুফি সাধক বলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। তবে তাঁর গোটা সংগ্রামী জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে ছিল সুফিবাদ নিয়ে নানা ভাবনা। একই অংশে অন্য একটি লিখায় খিজির (আ.) এর জন্ম-মৃত্যুর ব্যাপারে আলেমদের মতামত উপস্থাপন করা হয়েছে।
উপমহাদেশে সুফিবাদকেন্দ্রিক বিদআত, কুফরের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের বিভিন্ন দিক গুরুত্ব পেয়েছে শেষ অংশে। বিশেষ করে মাওলানা আশরাফ আলী থানভির সুফি দর্শন নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি ছিল চমৎকার, যেখানে নিখাদ আধ্যাত্মিকতা ও তাজকিয়া (আত্মশুদ্ধি) চর্চার স্বচ্ছ পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে।
বাংলা ভাষায় সুফিবাদ নিয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে কোনো একক গ্রন্থে প্রকাশ পায়নি সম্ভবত। তাই বলাই যায়, আধ্যাত্মিকতা ও সুফিবাদ সম্পর্কে জ্ঞানের ধোঁয়াশা কাটাতে বইটি হতে পারে আলোর মশাল। যদিও অনুবাদের ভাষা যথেষ্ট ঝরঝরে বলা যাবে না। তবে প্রথমদিকে বইটিতে মনোযোগ বসাতে সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে তা কেটে যায়। শেষের দিকে অনুবাদক মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন বলতে হবে।