জর্ডান থেকে এক বিমান যাত্রা করে দিল্লির উদ্দেশ্যে। কিন্তু উড়বার ঘণ্টাখানেকের মাঝেই পাইলট জানান, ইঞ্জিনের ত্রুটির জন্য সামনের বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করতে হবে। সেই বিমানবন্দর আবার ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত। যাত্রীদের এতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যায় পড়ে রেউত আর শিরা নামক দুই যুবক-যুবতী। কারণ দুজনই ইসরায়েলি পাসপোর্টধারী। আর এটা তো জানা কথাই যে, ইরান আর ইসরায়েলের মধ্যে ছত্রিশের আখড়া!
বিমান তেহরানেই অবতরণ করে। রেউত আর শিরাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। যাত্রাপথে শিরা বাথরুমে গিয়ে আরেক তরুণীর সঙ্গে ধাক্কা খায়। পাইলটের ইউনিফর্ম গায়ে থাকলেও শিরা ঠিকই চিনে নেয় মেয়েকে। ইসরায়েলি নাগরিকদের বাধ্যতামূলক যে দুই বছর প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কাটাতে হয়, সেখানেই শিরা এই মেয়েকে দেখেছে। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে এই কথাই শিরা মুখ ফসকে বলে দেয় ইরানের ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা ফারাজ কামালিকে।
ব্যস, ইরান ইন্টেলিজেন্সের খোঁজ শুরু হয়। তামার রাবিনিয়ান নামের এক মোসাদ এজেন্ট জিলা নাম নিয়ে ইরানে প্রবেশ করেছে, অন্তত এতটুকুই জানতে পারে ইরানী গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা। অন্যদিকে, জিলার ছদ্মবেশে তামার ইরানে এসেছে এক গোপন মিশন নিয়ে। ইরানের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলোকে নিষ্ক্রিয় করাই মূলত এই কম্পিউটার হ্যাকারের গোপন মিশন। এমনকি জিলার ছদ্মবেশে ইরানের সেন্ট্রাল পাওয়ার কন্ট্রোল বোর্ডেও ঢুকে পড়ে তামার। কিন্তু সমস্যাটা বাধে অন্য কোথাও। জিলার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে উত্যক্ত করত, এবং একই ঘটনা তাকে মনে করে তামারের সঙ্গে করতে গেলেই মৃত্যু ঘটে লোকটির।
ঝামেলা বেড়ে যায়। পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে। অন্যদিকে জিলার স্বামী আত্মহত্যা করে বলে জানা যায়। ঘটনাস্থলে জিলা আর ফারাজ কামালি উপস্থিত হয়। ঘটনা বেগতিক বুঝতে পেরে পালিয়ে যায় জিলা তথা তামার। ফারাজি বুঝতে পেরে পিছু ধাওয়া করে। তামার পালিয়ে চলে যায় তার এক আত্মীয়ের কাছে। ছিন্ন হয় মোসাদের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ। অতীত এসে ধাওয়া করে তামারকে। মোসাদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে রক্তমাংস আর আবেগের মানুষ। প্রেমে পড়ে যায় তামার, তা-ও এক ইরানি বিদ্রোহীর সঙ্গে। ওদিকে ফারাজ কামালি হন্য হয়ে খুঁজছে তামার তথা জিলাকে।
মূলত এমনই গল্প নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ইসরায়েলি এসপিওনাজ-স্পাই থ্রিলার সিরিজ তেহরান। গল্পে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার দ্বন্দ্বের এক খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক আর সামাজিকতা বাদেও দুই দেশের নাগরিকরা কীভাবে নিজেদের মূল্যায়ন করে সেই ব্যাপারেও খানিকটা দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক আলোচনার পূর্বে জেনে নেওয়া যাক, কেন এই সংঘাত?
১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লব ঘটে, যা ইসলামি বিপ্লব নামেও পরিচিত। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ইরানের ধর্মীয় নেতারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। ক্ষমতায় বসেই তারা ইসরায়েলকে বর্জনের আহবান জানান। এমনকি ইরান সরকার ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, তা-ও বিশ্ব গণমাধ্যমের সামনেই। ইরানের এহেন আচরণের পেছনের কারণ কী? কারণ তারা মনে করে মুসলমানদের ভূমি জোরপূর্বক এবং অবৈধভাবে দখল করে ইসরায়েলিরা রাষ্ট্র গঠন করেছে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ইরানকে হুমকিস্বরূপ দেখা ব্যতীত ইসরায়েলের কোনো বিকল্প নেই।
মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরানের যে ব্যাপকতা, তা নিয়ে সদা উদ্বিগ্ন থাকে ইসরায়েলি নেতারা। উপরন্তু, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থাকাও তাদের কাছে অনেক বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন আর সিরিয়াতে সৈন্য ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে ইরান প্রতিনিয়ত। তাই ইসরায়েল নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সর্বদাই আতঙ্কগ্রস্ত। তবে ইসরায়েল চাইলেও ইরানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারবে না। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে আছে লেবাননের হেজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের হামাস। এরপরও যদি কোনো কারণে যুদ্ধ বেধে যায়, তবে সেটা বেশ ভয়াবহ হবে বলেই ধারণা করা হয়।
মূলত এসব কারণেই ইরান আর ইসরায়েলের মধ্যে ছত্রিশের আখড়া। সিরিজের মূল নির্মাতার নাম মোশে জোন্দার, নেটফ্লিক্সের ফাউদা সিরিজ যার রচনা অবলম্বনেই এসেছে। মূল চরিত্র তথা মোসাদ এজেন্টের চরিত্রে ছিলেন নিভ সুলতান। ইসরায়েলি এই নায়িকা বেশ ভালভাবেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। ইরানের বংশোদ্ভূত এক জায়োনিস্ট ফের ইরানেই এসেছে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায়, কেননা ইসরায়েল তাকে নাগরিকত্বের মর্যাদা দিয়েছে। উপরন্তু, ছদ্মবেশ ধারণ করেছে ভিন্ন এক নারীর নামে। এতকিছুর মধ্যেও মোসাদ এজেন্টের চরিত্রে নিভ সুলতান বেশ ভালো অভিনয় দক্ষতা ফুটিয়ে তুলেছেন।
এরপরেই আসে ইরানের গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফারাজ কামালির কথা। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন শন তৌব। শন নিজেও একজন ইরানি বংশোদ্ভূত ইহুদি। ফারাজ কামালি চরিত্র শুরুতে বেশ ঠান্ডা মাথার লোক মনে হলেও গল্পের স্বার্থে অনেকটাই রগচটে এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়। ফারাজি চরিত্রে নিজেকে বেশ ভালো মানিয়ে নিয়েছেন শন। মিলাদ চরিত্রে থাকা শারভিন আর নাভিদ চরিত্রে থাকা মাসুদের অভিনয়ও বেশ ভালো। এছাড়া কারদুস চরিত্রে থাকা লিরাজের কথাও বলা যেতে পারে। মোদ্দা কথা, অভিনয়-দক্ষতার দিক থেকে অনেকটাই পূর্ণ ছিলেন সিরিজের কলাকুশলীরা।
তবে এই সিরিজ নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ বিতর্ক উঠেছে আন্তর্জাতিক দর্শক মহলে। শুরুতেই আসে সিরিজটির অতিরঞ্জিত করে গল্প বলার ধরন। তাছাড়া সিরিজের বেশ কিছু দৃশ্য আছে যেগুলো আদতে ইরানের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একইসঙ্গে ইসরায়েলের দুরন্তপনা আর ব্যর্থতাকেও ফুটিয়ে তোলে। আবার ইরানের মেট্রোপলিস তেহরানে বসবাসরত নাগরিকরা যে এক জটিল আর উত্তপ্ত রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে জীবনযাপন করে, সেটাও যেন ফুটে উঠেছে।
মজার বিষয় হচ্ছে, তেহরান নাম হলেও এই সিরিজের শ্যুটিং ইরানে করা হয়নি। শ্যুটিং করা হয়েছে গ্রীসের এথেন্স নগরীতে। গ্রীসের রাস্তাঘাটকেই তেহরানের রূপ দিয়েছেন নির্মাতারা। যদিও তা বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না। দেখে মনে হয় যেন তেহরানেই শ্যুটিং হচ্ছে। যদিও তেহরান সিরিজটা ইসরায়েলিদেরই নির্মিত, তবুও তারা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে পুরো সিরিজ জুড়েই। অবশ্য নিজেদের বানানো গল্পে কতটুকুই বা নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব! বিচারের পুরো ভার তাই গিয়ে পড়ে দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তবে হ্যাঁ, পুরো সিরিজ জুড়ে যে টান টান উত্তেজনা তা দর্শক টের পাবেন বেশ ভালভাবেই।
তেহরান সিরিজের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিং বেশ ভাল ছিল। বিশেষ করে আবহ সঙ্গীত। মিউজিকও মাথায় গেথে থাকার মতোই। সিনেমাটোগ্রাফি ভালো হয়েছে। বেশ কিছু অ্যাকশনের দৃশ্য ছিল, খারাপ লাগেনি মোটের উপর। প্রোডাকশন ডিজাইন ছিল চমৎকার। সর্বোপরি, সিরিজের মেকিং বেশ ভালো। সিরিজটি মূলত পার্সিয়ান এবং হিব্রু ভাষায় নির্মিত। তবে পরবর্তীতে অ্যাপল প্লাস কিনে নেয়াতে ইংলিশ সাবটাইটেল যুক্ত হয়েছে। এখন অবধি আইএমডিবিতে ৭.৪ রেটিং এবং রটেন টমেটোজে ৯৩% দর্শকপ্রিয়তা নিয়ে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে সিরিজটি।