কেল্টিক, এক প্রাচীন পুরাণের নাম। কালের প্রবাহে পুরনো এই সংস্কৃতিতে নতুন ধারার বিশ্বাসের সংমিশ্রণ ঘটতে দেখা যায়। তবে রদবদলের কঠিন পরীক্ষায় উতরে গিয়ে কেল্টিক পুরাণ আজও বর্তমান। ভারী চমকপ্রদ তার গল্পগাঁথা। সৃষ্টিতত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু দেবতা ডন আর দেবী দানু।
দানুর প্রবল কান্নার স্রোতে ডনের টুকরো টুকরো শরীর ভেসে গিয়েছিল। পুরাণ মতে, সেখান থেকেই পৃথিবীর আবির্ভাব। দেবতার মাথা পরিণত হয় সুবিশাল আকাশে। মগজ থেকে তৈরি হয় মেঘ, মুখ থেকে জন্ম নেয় সূর্য। মন থেকে চাঁদ, হাড় থেকে পাথর, শ্বাস থেকে বাতাস। এভাবেই সবকিছুর শুরু। কিন্তু কেল্টিক কারা? কোথা থেকে এলো এরা?
গোড়াপত্তন ঘটে আয়ারল্যান্ড ও গ্রেট ব্রিটেনের আশেপাশে। ভিন্ন ভিন্ন জাতির আগমনে সমৃদ্ধ কেল্টিক পুরাণের গল্প। সিজারিয়ানরা এসেছিল সবার আগে। আরও এসেছিল পার্থলনিয়ান, নেমেডিয়ান, ফির বল্গ, থুয়া ডে দানান এবং মিলিশিয়ান। ফোমোরিয়ানদের উৎস সম্পর্কে ঠিকঠাক জানা যায় না। বহু আগে থেকেই আয়ারল্যান্ডে বসবাস করত এই অতিপ্রাকৃত জাতি। তবে ঝগড়াটে ফোমোরিয়ানদের গল্প কেল্টিক পুরাণে তেমন গুরুত্ব পায়নি। অন্যদিকে বহিরাগত থুয়া ডে দানানদের অলৌকিক গাঁথা সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে এখানে।
বহুল পরিচিত অন্যান্য পুরাণের সাথে কেল্টিক পুরাণের গঠনগত পার্থক্য সামান্যই— দেবদেবীর বিচিত্র আখ্যান স্থান পেয়েছে এখানেও। থুয়া ডে দানানরা ছিল ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। তারা জাদু জানত। শিল্পকলার চর্চা করত। আবার প্রয়োজনে যুদ্ধ করতেও দ্বিধা করত না।
থুয়া ডে দানানদের মা, দানু। সমৃদ্ধি, উর্বরতা, কৃষি, জ্ঞান, মৃত্যু আর পুনর্জন্মের দেবী— দানুর সন্তান সর্বপিতা দাগদা। প্রতিশোধের দেবতা আডুন, আরোগ্যের দেবী ব্রিজেট। সমুদ্রের দেবতা মানানান ম্যাক লির সমগ্র আয়ারল্যান্ডের রক্ষাকর্তা। স্বাধীনতার দেবী এয়ার। যুদ্ধের দেবতা লু। এছাড়াও বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে রহস্যময় কিছু পৌরাণিক চরিত্র। মরিগ্যানের কথাই ধরা যাক। কুকুলেইনের মৃত্যুর সময় দাঁড়কাক রূপধারী এই দেবীর অশুভ ক্ষমতার কথা টের পাওয়া যায়। আরেক অদ্ভুতুড়ে চরিত্রের নাম, মেডেভ। তার ধূর্ত ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণের বহু নিদর্শন স্থান পেয়েছে কেল্টিক পুরাণে।
দেবদেবী হলেও থুয়া ডে দানানরা সকল কিছুর উর্ধ্বে নয়। লোভ, ক্রোধ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসার ন্যায় মানবীয় প্রবৃত্তি থেকে তারা মুক্তি পায়নি। প্রয়োগের উল্টোপিঠেই থাকে অপপ্রয়োগ। আর কেল্টিক দেবদেবীরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে ছাড় দিত না। কিন্তু একটি কথা— প্রবৃত্তির তুলনামূলক সাদৃশ্যের কারণেই সম্ভবত পুরাণের গল্পের এত জনপ্রিয়তা। কেল্টিক পুরাণেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
কেল্টিক পুরাণের গল্পগুলোর অনেকটা জুড়ে দেবদেবীর অস্তিত্ব ও তাদের কৃতকর্ম। ড্রুইড, ফেইরি, দৈত্য-দানোর উপস্থিতি সেখানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ক্ষমতার ওঠানামা, বীরদের অবিশ্বাস্য কাহিনি, জাদুকরদের অলৌকিক গাঁথার মিশেলে যার অবতারণা- তাই পুরাণের প্রাচীন কাহিনি। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে এসব গল্প আটকে থাকে না ঠিকই। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের কিছু কিছু খোঁজ অন্তত পাওয়া যায়।
বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছু চক্রে বিভক্ত কেল্টিক পুরাণের সমস্ত গল্পগাঁথা। উলস্টার চক্রে জাদুর তুলনায় যুদ্ধের ভূমিকা বেশি। কেল্টিকদের হারকিউলিস নামে খ্যাত, বীর কুকুলেইনের দেখা পাওয়া যায় এখানেই। মাচার অভিশাপ থেকে সূচনা এই চক্রের, যার সমাপ্তিতে ফিয়ান্নার আগমন ঘটে।
ফিয়ান্না, কেল্টিকদের অন্যতম শক্তিশালী যোদ্ধার দল। মূলত এদের মধ্য দিয়েই ফেনিয়ান চক্রের অবতারণা। জীবনযাত্রার দিক দিয়ে উলস্টারের যোদ্ধাদের সাথে ফিয়ান্নাদের পার্থক্য বিদ্যমান। কুকুলেইনরা যেখানে একটি সুনির্দিষ্ট সমাজের অন্তর্গত, সেখানে ফিয়ান্নারা বরাবরই যাযাবর যোদ্ধা-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। তবে এটাও ঠিক, যুদ্ধের ময়দানে উভয়ের নৈপুণ্য চোখে পড়ার মতো।
আর রাজ চক্রে প্রাধান্য পেয়েছে কেল্টিক রাজাদের গল্প। তাদের শাসনব্যবস্থার বিচিত্র সব কাহিনি বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে। করম্যাক ম্যাক আর্ট, কনেইর মোর, ত্রিস্তার মতো রাজা-রাজড়ার অসাধারণ বীরত্বগাঁথা কেল্টিক পুরাণের অনন্য সংযোজন।
অবশ্য চক্রের মাঝে মাঝে গল্পের দেখা মেলে আরও। তাছাড়া পুরাণের গল্পের বিস্তৃতি বরাবরই কিছুটা বেশি হয়। এক গল্পের উৎস খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসে হাজারটা গল্প। সেসব গল্পের পেছনে ছুটলে সন্ধান পাওয়া যায় নতুন গল্পের। আর এভাবেই অদ্ভুত এক উপায়ে গল্পগুলো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। তবে লিখিত রূপে আবদ্ধ হতে গেলে অতীতের গল্পে বর্তমান বিশ্বাস মিশে যায়। কেল্টিক পুরাণের কিছু গল্পেও এর জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়।
আবার কিছু বিশ্বাসের কখনো মৃত্যু হয় না। একই বিশ্বাস তার অনুসারীদের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। কেল্টিক পুরাণের গল্প আয়ারল্যান্ডের জনসাধারণের মধ্যে যে বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, সেই বিশ্বাসে আজও ফাটল ধরেনি। সর্বপিতা দাগদার সম্মানে আইরিশ লোকসঙ্গীতে বীণার চর্চা বরাবরের মতোই অব্যাহত আছে। বসন্তের রোগ নিরাময়ে সূর্যদেবের স্মরণে বেল্টেইনের ভোজ এখনও আইরিশদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উৎসব।
বাংলা ভাষায় কেল্টিক পুরাণের গল্পের বই আগে লেখা হয়েছে বলে খোঁজ পাওয়া যায় না। ‘থুয়া ডে দানান: কেল্টিক পুরাণের গল্প’ সম্ভবত এই ধারার প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রচেষ্টা। লেখক সেঁজুতি রোশনাই এবং মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ’র সম্মিলিত প্রয়াসে বইয়ের পাতায় কেল্টিক পুরাণের আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে। গল্পের ছলে পুরাণ ও ইতিহাসের চমকপ্রদ বর্ণনা কমবেশি সবারই ভালো লাগবে। তাছাড়া গ্রিক, মিশরীয় বা নর্স পুরাণের সাথে কেল্টিক পুরাণের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের অংশটুকু অন্যান্য পুরাণের প্রতিও পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে। লর্ড জুলিয়ানের প্রচ্ছদটি বেশ সুন্দর, বইয়ের মূল বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বই সংক্ষেপ
বই: থুয়া ডে দানান: কেল্টিক পুরাণের গল্প
লেখক: সেঁজুতি রোশনাই, মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ
ধরন: কেল্টিক পুরাণ
প্রকাশনী: বিবলিওফাইল