ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কথা। ততদিনে পৃথিবী এগিয়ে গেছে অনেকদূর। এখনকার সময় যেমন খুনোখুনি মারামারি অশান্তি বিরাজমান আছে, ভবিষ্যতের সে সময়টাতে এরকম কিছুই নেই। শান্তি, সাম্য, পরোপকার ও মানবতারই জয়জয়কার। পৃথিবীতে নেই কোনো আলাদা আলাদা দেশ, সবাই মিলে একটি অভিন্ন দেশে সকলের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে বসবাস করছে। একটি দেশ হয়ে গেছে অতি উন্নত, সে দেশের মানুষেরা পার করছে অতি উঁচু দরের জীবন আর অপর পিঠে আরেকটি দেশ রয়ে গেছে দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত, মানুষ পাচ্ছে না খাদ্য পাচ্ছে না শিক্ষা- এমনটা আর নেই।
অবস্থা এতটাই ভালো যে রাজনীতিবিদরা আর পৃথিবীর হর্তাকর্তা নেই। পৃথিবীর মানুষ অনুধাবন করতে পেরেছে যে এই পৃথিবী পরিচালনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত কেউ থাকলে তারা হলো বিজ্ঞানী সম্প্রদায়। সে অনুসারে বিজ্ঞানীরাই চালাচ্ছে পৃথিবী। বিজ্ঞানীরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে পৃথিবীর কোন অংশে কী করতে হবে, কোন ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীরা স্বার্থহীন হয়ে থাকেন এবং সবসময়ই চান কোনোকিছুতেই যেন মানুষের ক্ষতি সাধিত না হয়। বর্তমান ধারার রাজনীতি তখন বজায় থাকলে অস্ত্রশস্ত্রে সাজ সাজ থাকতো সবগুলো জাতি। কিন্তু নির্লোভ বিজ্ঞানীদের হাতে শাসন থাকাতে অস্ত্রহীন হয়ে গেল পুরো পৃথিবী।
তবে শান্তির মাঝেও বিপদ আছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে নাহয় শান্তি সাম্য বিরাজ করছে, সকলে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে, কিন্তু পৃথিবীর বাইরে যদি কোনো জাতির অস্তিত্ব থাকে এবং তারা যদি পৃথিবীতে আক্রমণ করে বসে তাহলে কেমন অবস্থা হয়? তারা তো শান্তিপ্রিয় না-ও হতে পারে। তখন তো অস্ত্রের দরকার হবে। অন্তত পৃথিবীর বাইরের আক্রমণকারীকে তো ঠেকিয়ে রাখতে হবে। সেজন্য কিছু অস্ত্রের মজুদ আছে, তবে তা যথেষ্ট নয়।
এদিক থেকে ভাগ্য ভালো পৃথিবীর বাইরের এলিয়েন সত্তারা হরহামেশা আক্রমণ করে বসে না, যেমন করে পৃথিবীর মানুষেরাও পৃথিবীর বাইরের কাউকে আক্রমণ করে না। কিন্তু বুদ্ধিমান সত্তা নাহয় আক্রমণ করলো না, যে জিনিসের কোনো প্রাণ বা চেতনা নেই তারা কি আর এসব বুঝবে? অন্য কোনো গ্রহের সাথে সংঘর্ষ কিংবা বাইরের কোনো গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
আগে হোক আর পরে হোক, ছোট আকারে হোক আর বড় আকারে হোক এরকম মহাজাগতিক সংঘর্ষ পৃথিবীতে হয়ই। আগেও হয়েছে ভবিষ্যতেও হবে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের এবারের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ত্রাতিনার পটভূমির সময়েও পৃথিবী মুখোমুখি হয় এক মহাজাগতিক সংঘর্ষের।
সৌরজগতে ঘটা কোনো এক বিশৃঙ্খলার ফলে নিজের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে ৭০ কিলোমিটার ব্যাসের এক গ্রহাণু। পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে প্রবল বেগে। এত বড় গ্রহাণু যদি পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে তাহলে সাথে সাথেই কয়েকটি মহাদেশ বিরান হয়ে যাবে। আঘাতের পর এটি যে পরিস্থিতি তৈরি করবে তার ফলশ্রুতিতে নরক নেমে আসবে পৃথিবীতে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের ভাষায়-
“প্রায় সত্তুর কিলোমিটার চওড়া একটা গ্রহকণা আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর পৃথিবীতে আঘাত করবে। কক্ষপথ নির্ভুলভাবে বের করা হয়েছে, আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতে সেটি ঘণ্টায় প্রায় ষাট হাজার কিলোমিটার বেগে আঘাত করবে। আঘাতটি হবে তিন লক্ষ মাঝারি সাইজের হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের কাছাকাছি। আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড আঘাতের সাথে সাথে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। গ্রহকণাটি যখন আঘাত করবে, তখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তার কক্ষপথে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হবে। সেই শূন্যতার ভেতর দিয়ে ধুলোবালি, পাথর, ধোঁয়া কয়েক সেকেন্ডের ভেতর বায়ুমণ্ডলের উপরের অংশে ঢুকে যাবে। কয়েক মিনিটের ভেতর পুরো আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। কয়েক ঘণ্টার ভেতর সারা পৃথিবীর আকাশ কুচকুচে কালো হয়ে যাবে। পৃথিবী হবে একটি ঘন অন্ধকার গ্রহ। দুই থেকে তিন বছর আকাশ এভাবে অন্ধকার থাকবে। ধুলোবালি পৃথিবীতে ঝড়ে পড়তে আরো সময় নেবে। সূর্যের আলো ঢুকতে পারবে না বলে সমস্ত পৃথিবী হিমশীতল হয়ে যাবে। পৃথিবীর যত জীবিত প্রাণী, তার শতকরা নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই অংশ মারা যাবে। পৃথিবী হবে একটা প্রাণহীন গ্রহ।”
পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে এরকম একটি মহাজাগতিক সংঘর্ষ হয়েছিল পৃথিবীতে। আঘাতের ফলে আঘাতস্থল দেবে গিয়ে আস্ত এক সাগর তৈরি হয়েছিল। এত বেশি পরিমাণ ধুলো উড়েছিল যে সে ধুলো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। ঐ সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ডায়নোসরদের অনেকগুলো প্রজাতি বিরাজ করছিল জলে ও ডাঙ্গায়। তাদের সবগুলোই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এই আঘাতের ফলশ্রুতিতে।
পৃথিবীতে যে আঘাতটি ধেয়ে আসছে তাকে আসতে দিলে মানবজাতিরও এই অবস্থা হবে। মানুষ নিজে কৌশল করে টিকে থাকতে পারলেও অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ তো আর বাঁচবে না। আর মানুষ যেহেতু অন্য প্রাণের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে তাই তারা মরে গেলে আগে পরে মানুষও মরে যাবে। এমন অবস্থায় যেকোনো মূল্যে বাঁচানো দরকার পৃথিবীকে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে কাউকে না কাউকে আত্মঘাতী মিশনে যেতে হবে। এ মিশন থেকে বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা শূন্য। তবে তখনকার পৃথিবীর মানুষ এখনকার মতো স্বার্থপর নয়, বেশ মানবিক। সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানবজাতির তথা পৃথিবীর মঙ্গল চায়। কেউ কেউ মঙ্গলের জন্য নিজেদের জীবনও ঝুঁকিতে নিয়ে যায়। এরকমই একজন মঙ্গল কামনাকারী হলেন রায়ীনা। সে তার সন্তান যেন সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে তার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করে। এটা না করলে আগে পরে উভয়কেই মরা লাগবে, তার চেয়ে একজন মৃত্যুকে গ্রহণ করে নিয়ে বাকিদের জন্য সুন্দর পৃথিবী উপহার দেয়ার মাঝে অনেক অসাধারণত্ব আছে।
যার কথা ভেবে এই বিসর্জন, তার আদরের মেয়ের নাম ত্রাতিনা। এই ত্রাতিনা পরবর্তীতে বড় হয় এবং মায়ের মতো মহাকাশচারী হয়। ত্রাতিনার মহাকাশচারী জীবনই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ত্রাতিনার মূল বিষয়।
এবার বইটি নিয়ে সামান্য সমালোচনায় প্রবেশ করা উচিত। এই বইয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, এখানে বলা গল্পের মাঝে কোনো নতুনত্ব থাকা। গত কয়েক বছর ধরে তিনি যেসব সায়েন্স ফিকশন লিখছেন তাদের গল্প আসলে পূর্বে প্রকাশিত সায়েন্স ফিকশনে আগেই বলেছিলেন। সম্পূর্ণ নতুন কোনো প্লটে সম্পূর্ণ নতুন কোনো গল্প আসছে না। ত্রাতিনাও হয়েছে তা-ই। সেই মহাকাশযান, সেই অদ্ভুত মহাজাগতিক প্রাণী, প্রাণীগুলো মানুষের মস্তিষ্ককে খুলে খুলে দেখে, সেই রোবট-সাইবর্গ-এন্ড্রয়েড ইত্যাদি আর কত?
এসব উপাদান যে বারবার আনা যাবে না তা নয়, কিন্তু সায়েন্স ফিকশনে বলা গল্পে যদি নিজেরই লেখা আগের গল্পের ছায়া থাকে, তাহলে তো পাঠকদের জন্য তা হতাশা বয়ে আনবে। বই পড়ুয়াদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুডরিডস-এ গত কয়েক বছরে প্রকাশিত মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইগুলো নিয়ে পাঠকদের মনে বেশ ক্ষোভ। ত্রাতিনার বেলাতেও ব্যতিক্রম হয়নি।
পাঠকদের এই অভিযোগ যদি বাদ দিয়েও বিবেচনা করা হয় তাহলে কেমন দেখায়? ধরা যাক, কোনো একজন পাঠক, যিনি কিনা মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন আগে আর পড়েননি, তার কাছে তো ত্রাতিনা পড়ার পর অন্যান্য পাঠকের মতো মনে হবে না। যেহেতু তিনি আগে থেকে লেখকের সায়েন্স ফিকশন পড়েননি তাই এটাই তার কাছে নতুন গল্প। তাহলে তার কাছে কেমন লাগবে? এদিক থেকে বিবেচনা করলেও বলতে হবে ত্রাতিনার গল্পের প্লট বেশ দুর্বল। গল্পে লেখক আসলে কী বলতে চেয়েছেন? গল্পের মূলে ছিল কী? সেই সৌরজগতের বাইরের বুদ্ধিমান সত্তাই তো, তাই না? তাহলে সেই সত্তাকে কোন পর্যায়ে রেখে গল্পের সমাপ্তি টেনেছেন লেখক? যাকে উদ্দেশ্য করে গল্প আবর্তিত হয়েছে তাকে দিয়ে কি গল্পের শেষ হয়েছে?
এ প্রসঙ্গটি বাদ দেয়া যায়। কারণ কোনো গল্প তার উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে সমাপ্তি হতেই হবে এমন নয়। ব্যতিক্রম হতেই পারে। এটিকে বাদ দিলে বলতে হবে বইয়ের মূল প্রসঙ্গ ছিল মানবতা। দুই পর্বে দুই ধরনের মানবতার নিদর্শন এখানে এসেছে। সেদিক থেকে এটিকে ইতিবাচক বলা যায়।
তাছাড়া বইটি আরো একটি ভুল দৃষ্টিকটুভাবে রয়ে গেছে। ত্রাতিনার বয়স। যেখানে ত্রাতিনার বয়স হবার কথা ছিল আঠারো বছর সেখানে লেখক বলছেন ষোল বছর। কীভাবে? ত্রাতিনার মা রায়ীনা যখন মহাকাশ অভিযানে যায় তখন ত্রাতিনার বয়স ছিল দুই বছর। তারপর এতিমখানায় ত্রাতিনা থাকে ষোল বছর। দুই আর ষোল মিলে ত্রাতিনার মোট বয়স হয় আঠারো বছর। কিন্তু লেখক বারবার বলেছেন “ষোল বছরের মেয়ে হয়েও…”।
ধ্রুব এষের চমৎকার প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশনী। বইমেলায় সময় প্রকাশনীর স্টলের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অভিজাত লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন এটি।
ফিচার ছবি- সিরাজাম মুনির শ্রাবণ