ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে সুইসদের নাম বেশি শোনা যায়। সারা দুনিয়ার বিত্তশালী এবং বিখ্যাত লোকজনের অঢেল অর্থ রাখার প্রথম পছন্দ সুইস ব্যাংক। কিন্তু কেন?
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, সুইস ব্যাংক বলে আসলে একক কোনো ব্যাংকই নেই। তাহলে খবরের শিরোনামের জনপ্রিয় বিষয় সুইস ব্যাংক আসলে কী? সুইজারল্যান্ড সরকারের আর্থিক সব কাজের নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক লেনদেনের সাথে যুক্ত এমন সব প্রতিষ্ঠানের তদারকি করে সুইস ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট সুপারভাইজরি অথোরিটি (Swiss Financial Market Supervisory Authority – FINMA) এবং সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের অধীনে যত ব্যাংক আছে, একসাথে সবগুলোকেই সুইস ব্যাংক বলে। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে তিন শতাধিক অধিক ব্যাংক আছে।
কীভাবে গড়ে উঠলো সুইস ব্যাংকিং ব্যবস্থা?
সুইস ব্যাংকিং ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৩ শতকের শুরুতে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ ব্যবসায়ীরা সুইজারল্যান্ডে এসে পৌঁছায়, যাদের বেশিরভাগই ছিল ইহুদী। বিশপ অ্যাডহেমার ফাব্রি ১৩৮৭ সালে জেনেভার ব্যাংকারদের সুদ ব্যবসা করার অনুমতি দেন।
ইতালি, জার্মানি এবং ফ্রান্সের মতো পরাশক্তি দেশগুলোর মাঝে অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ সুইজারল্যান্ড মধ্যযুগে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যের রুট হয়ে দাঁড়ায়। বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জেনেভা। ১৬ শতকের দিকে জন কেলভিনের প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চভিত্তিক ধর্ম সংস্কার ব্যাংকিং ব্যবসার গতিকে বৃদ্ধি করে এবং সুদ ব্যবসাকে পুরোপুরি বৈধতা দেয়।
একই সময়ে সুইজারল্যান্ডের আশেপাশের অঞ্চলগুলোর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল এবং সেসব অঞ্চল থেকে অনেকেই তাদের সব সম্পদ নিয়ে সুইস অভিবাসী হতে শুরু করে। ১৭ শতকের শুরু থেকেই জেনেভাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো আর্থিক লেনদেনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। ১৭১৩ সালে গ্রেট কাউন্সিল অব জেনেভা ব্যাংকিয়ের গোপনীয়তার নীতিমালা প্রকাশ করে। এই নীতিমালাই একজন গ্রাহককে চরম গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেয়। ব্যাংকার তার গ্রাহক ব্যতীত আর কারো সাথেই কোনো তথ্য বিনিময় করতে বাধ্য না।
১৭১৩ সালের এই নীতিমালায় কর ফাঁকিবাজদের সুস্পষ্টভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। ১৭৪১ সালে অনুষ্ঠানিকভাবে সুইজারল্যান্ডের প্রথম ব্যাংক Wegelin and Co প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৪ সালে ৬টি ব্যাংক মিলে সুইস ব্যাংক কর্পোরেশন গঠন করে। ১৯ শতকে ইউরোপের প্রায় সব দেশেই যখন যুদ্ধের দামামা বাজছে, তখন বিত্তশালীরা তাদের অর্থ রাখতে সুইজারল্যান্ডকে বেছে নেয়।
১৯৩৪ সালে ফ্রান্স সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে প্যারিসে সুইস ব্যাংকের শাখায় হানা দেয় এবং সব নথি জব্দ করে। বেশ কিছু কর ফাঁকিবাজকে তারা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ভবিষ্যতে এরকম ‘দুর্ঘটনা’ এড়াতে সুইসরা ১৭১৩ সালের আইনকে আরো কঠোর করে দেয়। তৈরি হয় ‘সুইস ফেডারেল ব্যাংকিং ল’ নামের নতুন আইন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এবং যুদ্ধ চলাকালে কোনো দেশের ব্যাংকই জার্মান মুদ্রা গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছিলো না। জার্মানদের ভরসা হয়ে দাঁড়ায় সুইস ব্যাংকগুলো। একইসাথে তারা নাৎসিদের লুট করা স্বর্ণ জমা রাখছিল, আবার ইহুদীদের সম্পদও গচ্ছিত রাখছিল। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সুইস ব্যাংক কর্পোরেশনের উত্তরাধিকারী ইউবিএস এবং ক্রেডিট সুইস ১.২৫ বিলিয়ন ডলার ইহুদী পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে রাজি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু জার্মান রাজনৈতিক নেতা সন্দেহ করেছিলেন, সুইস ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জার্মানির প্রাদেশিক অর্থ বিভাগে গুপ্তচর নিয়োগ করেছে। তবে এর সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
সুইস ব্যাংক কেন পছন্দের শীর্ষে?
ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে একজন গ্রাহক সবথেকে বেশি যে জিনিসটি আশা করে তা হলো গোপনীয়তা। যদি অবৈধ টাকা বা কালো টাকা হয়, তবে গোপনীয়তাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিয়ের সুনাম এখানেই। ডাক্তারের সাথে রোগীর বা উকিলের সাথে মক্কেলের যেমন বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক, তেমনই সুইস ব্যাংকের সাথেও তাদের গ্রাহকদের সম্পর্ক চরম বিশ্বাসের। সুইস ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের কোনো তথ্যই কাউকে দিতে বাধ্য না। অনেকের ধারণা, সঞ্চিত অর্থের উপর সুইস ব্যাংক প্রচুর পরিমাণ মুনাফা দিয়ে থাকে। সুইজারল্যান্ডের স্বনামধন্য ব্যাংক ইউবিএস খুব বেশি হলে ১.৫০% মুনাফা দিয়ে থাকে, তা-ও ক্ষেত্রবিশেষে।
গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্যের প্রকাশ ঘটলে সুইস আইনানুযায়ী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ৬ মাস পর্যন্ত কারাবাস ভোগ এবং ৪০,০০০ সুইস ফ্রাঁ জরিমানা হতে পারে। এছাড়াও ক্ষতি বিবেচনা করে গ্রাহক ক্ষতিপূরণও পেতে পারেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, গ্রাহকের গোপনীয়তা বজায় রাখতে সুইজারল্যান্ডের আইন সবচেয়ে কঠোর।
সাধারণত ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে হলে অর্থের উৎস ছাড়াও কর জমা দেওয়ার ছাড়পত্র, ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি এবং বিদেশি হলে পূর্বের অ্যাকাউন্ট বা লেনদেনের ইতিহাস জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে হলে অর্থের উৎস নিয়ে জানতে চাওয়া হয় না। ন্যূনতম ১৮ বছর এবং একটি বৈধ পাসপোর্ট, এই দুটি জিনিস থাকলেই সুইজারল্যান্ডে একটি ব্যাংকে অর্থ রাখা যায়। এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে, গ্রাহককে খুব অভিজাত বা উচ্চবিত্তের হতে হবে। মাত্র ৫,০০০ সুইস ফ্রাঁ থাকলেই যে কেউ একটি নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে।
সুইস ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আফ্রিকার স্বৈরশাসক বা ল্যাটিন মাদকসম্রাট সবাইকেই চিহ্নিত করা হয় একটি অদ্বিতীয় নম্বর দিয়ে। নম্বরটির বিপরীতের মানুষটি কে এটা ব্যাংকের হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তাই শুধু জেনে থাকেন।
বছরের পর বছর ধরে সুইজারল্যান্ডের অর্থনৈতিক কাঠামো খুবই স্থিতিশীল। দেশের অর্থনীতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। সুইজারল্যান্ড সর্বশেষ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে ১৫০৫ সালে। ইউরোপের অন্য দেশগুলো যখন নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ দিয়েছে, সুইসরা তার বদলে নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামো করেছে শক্তিশালী। ১৯ শতকের প্রথমার্ধেই দুনিয়া দুটি বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হয়, যার কেন্দ্রে ছিল ইউরোপ। সেখানেও নিরপেক্ষ ছিল এই দেশটি। বর্তমানেও সুইজারল্যান্ডকে অত্যন্ত নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এই দেশটির অর্থনীতির টালমাটাল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। উল্লেখ্য, সুইস ব্যাংকগুলোর ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্ধেকই বিদেশিদের।
সুইস ব্যাংক এবং অর্থ পাচার
সুইস ব্যাংকের দুনিয়া জুড়ে খ্যাতির বদলে কুখ্যাতিই মনে হয় বেশি। আইনের সুযোগ নিয়ে সুইস ব্যাংকগুলো হয়ে উঠেছে কর ফাঁকির স্বর্গ। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সুইস ব্যাংকগুলো কিছুটা শিথিল হয়েছে। বর্তমানে সুইস ব্যাংক সুস্পষ্ট প্রমাণের সাপেক্ষে কোনো গ্রাহকের তথ্য দিয়ে থাকে। এছাড়াও জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তির নিষেধাজ্ঞায় পড়া কোনো স্বৈরশাসকের অ্যাকাউন্টও জব্দ করা হয়। ২০০৫ সালে থেকে অব্যাহত চাপের মুখে ২০১৩ সালে এসে শেষপর্যন্ত সুইস সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তথ্য বিনিময়ের জন্য একটি আইন করে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ফরাসি পত্রিকা লা পারিয়েজেঁ জানায়, কর ফাঁকির তদন্ত হিসেবে ৪৫,১৬১ জন গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে ফরাসি কর কর্তৃপক্ষ। এটা নিয়ে অবশ্য বেশ দর কষাকষি করতে হয়েছিল ফরাসিদের।
গত বছর অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (Organization for Economic Cooperation and Development – OECD) সম্মেলনে সুইজারল্যান্ড একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে ৬০টি রাষ্ট্র সুইস ব্যাংকে থেকে তাদের নাগরিকদের তথ্য জানতে পারবে। পাকিস্তানের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের খবর অনুযায়ী, পাকিস্তান এবং আরো ২১টি রাষ্ট্রও একই ধরনের চুক্তি করতে যাচ্ছে।
২০১১ সালে সুইস ব্যাংক লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফি এবং তার ২৯ জন সহযোগীর সম্পদ জব্দ করে। এর আগে সুইজ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকেরও সম্পত্তি জব্দ করে। ধারণা করা হয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও তার বিশাল সম্পত্তি সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছেন। তিউনিশিয়ার ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক বেন আলীও বিরাট অঙ্কের অর্থ জমা রেখেছিলেন, যা এখন ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে।
সুইস ব্যাংক নিয়ে প্রচলিত একটি মিথ হলো, এখানে বেনামী প্রচুর অ্যাকাউন্ট আছে। বাস্তবে এটি সত্য নয়। মুভি বা উপন্যাসের মতো এখানে বেনামী অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না।
আইনের কোনো প্যাঁচ ছাড়াই একজন গ্রাহকের তথ্য সুইস ব্যাংক প্রকাশ করে, যখন কোনো গ্রাহক মৃত্যুবরণ করেন। যদি বিগত ৬০ বছর ধরে অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো লেনদেন না করা হয় এবং অর্থের পরিমাণ ৫০০ সুইস ফ্রাঁর বেশি হয়, তবে সেটা প্রকাশ করা হয়। যদি কোনো উত্তরাধিকারী সম্পত্তির দাবি না করে, তবে ১ বছর পর সুইস সরকার সেই সম্পদ নিজেদের কোষাগারে জমা নেয়
২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (International Consortium of Investigative Journalists – ICIJ) তাদের ওয়েবসাইটে “সুইস লিক” শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। ১৩০ জন সাংবাদিকের গবেষণায় এটা বেরিয়ে এসেছে যে, এইচএসবিসি ব্যাংকের জেনেভা শাখা ১৮০ বিলিয়ন ইউরো কর ফাঁকি দিয়ে লুকাতে সহায়তা করেছে। এই রিপোর্ট প্রকাশ না করতে বিবিসি’র উপরও প্রচুর চাপ ছিল।
অনেকের ধারণা, সুইস আইন তৈরি করা হয়েছে কালো টাকার মালিকদের জন্য। এটি ভুল ধারণা। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, লুকোচুরির এই আইনের ব্যবহার করে যাচ্ছে আমেরিকান ধনকুবের থেকে এশিয়ার কর ফাঁকিবাজরা। সুইসরা তাদের ব্যাংকিয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে যেমন তৎপর, তেমনই অন্য রাষ্ট্রগুলোও চাপ দিয়ে সুইসদের আইন সংস্কার করাতে তৎপর। গত সেপ্টেম্বর থেকে সুইস ব্যাংক ইউরোপ এবং বাইরের কিছু দেশের সাথে পূর্ণমাত্রায় তথ্য বিনিময় শুরু করেছে।
তাহলে কি সুইস ব্যাংকিংয়ের গোপনীয়তার অধ্যায় শেষ? সময়ই সেটা বলে দেবে।