বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির এই যুগে আমাদের নতুন নতুন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের চাহিদা বাড়ছে। নিজেকে আরও উন্নত, আরও দক্ষ হিসেবে প্রমাণ করার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে প্রত্যেককেই ক্রমাগত লড়ে যেতে হচ্ছে। অল্প সময়ে ধারণ করতে হচ্ছে বিবিধ জ্ঞান, প্রয়োগ করতে হচ্ছে নিত্যনতুন ক্রিয়াকৌশল।
তাই আজকের এই আয়োজনে কীভাবে অল্প সময়ের মধ্যে কোনো কিছু শেখা বা আয়ত্ত্ব করা যায়, সে বিষয়ে ধারণা দেওয়া হলো।
অভিজ্ঞ কারো সাহায্য নিন
নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে আমাদের একটি প্রবণতা থাকে যে, পুরো ব্যাপারটি কারো সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে আয়ত্ত্ব করার। কিন্তু সম্পূর্ণ কাজটি একা শেখার চেয়ে যিনি আরও আগেই কাজটি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন, এমন কারো সাহায্য নিলে বরং শেখার প্রক্রিয়াটি দ্রুত ও সহজ হয়। নিজে প্রথম থেকে ধীরে ধীরে শেখা শুরু করা, এরপর ভুল করে সেই ভুলের কারণে পিছিয়ে যাওয়া, আবার ভুল শুধরে নিয়ে নতুনভাবে কাজে লেগে পড়া- এসব করতে করতে অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যায়। তার চেয়ে বরং অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে সম্ভাব্য ভুলগুলো সম্পর্কে আগেই সতর্ক হয়ে এবং তাদের উদ্ভাবন করা সহজ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে তুলনামূলক কম সময়েই কোনো কিছু শিখে ফেলা সম্ভব। আপনি নিজেকে যে অবস্থানে দেখতে চান, সে অবস্থানে বর্তমানে যারা কর্মরত আছেন, তারাই হতে পারেন আপনার আদর্শ পথপ্রদর্শক। সুতরাং তাদের সাহায্য ও পরামর্শ নিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না।
কাজটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে নিন
কোনো একটি কাজকে আয়ত্ত্ব করতে হলে সেটি শেখার পুরো প্রক্রিয়াটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে নিন। প্রথম ধাপে একেবারে মৌলিক এবং বাধ্যতামূলক বিষয়গুলো শিখে নিন। এখানে পারেটোর নীতি অনুসরণ করা যেতে পারে। অর্থনীতিবিদ ভিলফ্রেডো পারেটোর নামানুসারে এই নীতির নামকরণ করা হয়েছে। এটি মূলত কোনো কাজের ইনপুট এবং আউটপুটের মধ্যে একটি অসম সম্পর্ক নির্দেশ করে। এই নীতির উদ্দেশ্য হলো, মাত্র ২০ শতাংশ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ৮০ শতাংশ ফলাফল অর্জন করা। জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে এই পারেটোর নীতি প্রয়োগ করা সম্ভব।
যেমন- ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কোনো একটি পণ্যের ৮০ শতাংশ বিক্রয় প্রতিষ্ঠানটির ২০ শতাংশ ক্রেতার ওপর নির্ভর করে। কিংবা কোথাও ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ঐ এলাকার প্রধান আকর্ষণগুলোর কথা (২০%) উল্লেখ করলেই পুরো ভ্রমণের সম্পর্কে ৮০ শতাংশ ধারণা পাওয়া যায়।
একইভাবে নতুন কিছু শেখার জন্যে প্রথমে যে ২০ শতাংশ মৌলিক জ্ঞানের ওপর কাজটির ৮০ শতাংশ সফলতা নির্ভর করছে, এরকম মৌলিক বিষয়গুলো আলাদা করে সেগুলো শেখার দিকে জোর দিতে হবে। যেমন- কোনো একটি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সচরাচর ব্যবহৃত হয় এমন ১,৫০০-২,০০০ শব্দ এবং তার প্রয়োগ শিখে নিলেই মোটামুটি ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলো।
একসাথে একাধিক কাজ করা বন্ধ করুন
বর্তমানে এই ব্যস্ততার যুগে একসাথে একাধিক কাজ সম্পন্ন করতে পারলে আমরা এক ধরনের আত্মতুষ্টি লাভ করি। পাঁচ মিনিটের কর্মবিরতিতে ডেস্কে আসা সহকর্মীর সঙ্গে খোশগল্প করতে করতে কফির কাপে চুমুক দেওয়া, সাথে আবার ই-মেইল চেক করা, সোশ্যাল সাইটগুলোতে একটু চোখ বুলানো, ফোনে কারো জরুরি কল রিসিভ করা- এমন কয়েকটি কাজ একসাথে সেরে নেওয়ার অভ্যাস আমাদের অনেকেরই আছে। এটিকে অভ্যাস না বলে বরং বদভ্যাস বলা ভালো, কারণ এরকম অভ্যাস নতুন কিছু দ্রুত শেখার ব্যাপারে বাধার সৃষ্টি করে।
একটি কম্পিউটারের কথাই ভাবা যাক। এর ব্রাউজারে একবারে বিশটি ভিন্ন ভিন্ন ট্যাব খুলে রেখে কাজ করতে গেলে কম্পিউটার ধীরগতির হয়ে যায় এবং তখন যেকোনো কাজের প্রক্রিয়াকরণে প্রচুর সময় নেয়। মানুষের মস্তিষ্কও ঠিক তাই। এটি একবারে কেবলমাত্র একটি বিষয়ের প্রতিই পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারে। তাই একসাথে অনেকগুলো কাজ করতে থাকলেও আদতে সবক’টি কাজে সমানভাবে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। ব্রেইন রুলস বইয়ের লেখক Dr. John Medina জানান,
“গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোনো ব্যক্তির একটি কাজ করার মাঝে বিঘ্ন ঘটলে কাজটি সম্পন্ন করতে তার ৫০% বেশি সময় লাগে। শুধু তা-ই নয়, কাজটিতে তার ভুলের পরিমাণও ৫০% বেড়ে যায়।”
কোনোকিছু শেখার জন্যে দীর্ঘসময় মনোযোগ ধরে রাখতে গেলে ঠিক এরকমই সমস্যা দেখা দেয়। প্রতিদিনের নিত্যনতুন কর্মপরিকল্পনার ভিড়ে নির্দিষ্ট একটি কাজ শেখার পেছনে ৬-১২ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে লেগে থাকা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। আর যখনই আমরা কাজটি থেকে মনোযোগ সরিয়ে অন্যত্র মনোনিবেশ করে ফেলি, তখন ঐ আগের কাজটিতে ফেরার পর ঠিক আগের মতোই উৎসাহ ও আগ্রহ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো কাজ করার সময় মনোযোগ অন্য দিকে সরে গেলে আবারও ঐ কাজে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে গড়ে পঁচিশ মিনিট সময় লাগে। সুতরাং নতুন কিছু শেখার সময় সেটিই আপনার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
বারবার অনুশীলন করা
Practise makes a man perfect – অতি প্রচলিত এই উক্তিটি কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। একই জিনিস বারবার অনুশীলনের ফলে স্নায়ুকোষের অ্যাক্সনের মায়েলিনেশান ঘটে, আর মায়েলিনেটেড স্নায়ুকোষের কর্মক্ষমতা বেশি থাকে। আমাদের মস্তিষ্কে থাকা গ্লিয়াল কোষ অ্যাস্ট্রোসাইট স্নায়ুকোষের অ্যাক্সনের কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে। কোনো একটি কাজ বারবার করতে থাকলে একটি নির্দিষ্ট অ্যাক্সন থেকে ক্রমাগত সক্রিয়তার সংকেত আসতে থাকে। এতে অ্যাস্ট্রোসাইট এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, যা মস্তিষ্কের আরেক প্রকার গ্লিয়াল কোষ ওলিগোডেনড্রোসাইটকে মায়েলিন উৎপন্ন করার জন্যে উদ্দীপিত করে। এই মায়েলিন অ্যাক্সনকে ঘিরে রাখে, স্নায়ুর অনুরণন প্রবাহের গতি ও শক্তি বৃদ্ধি করে, ফলে মস্তিষ্কের শেখার ক্ষমতার উন্নতি হয়।
সুতরাং, নতুন কিছু শেখার পর দক্ষভাবে সেটি করতে পারার জন্যে সেটির অনুশীলনেও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। কাজটির পেছনে সময় দিয়ে বারবার অনুশীলন করতে হবে। এমনভাবে কাজটিকে আয়ত্ত্ব করতে হবে যেন অবচেতন মনেও কাজটি সম্পন্ন করতে গেলে কোনোকিছু ভাবতে না হয়।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জেনে নেওয়া
কোনো কিছু শেখার সময় একটা করে ধাপ পার করার পর অভিজ্ঞ কারো সামনে সেই ধাপটির পুনরাবৃত্তি করে তার কাছ থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জেনে নিতে হবে। কাজের মান কেমন হলো, কোনো ভুল হলো কিনা, কীভাবে ভুলগুলো শুধরে নিজের আরও উন্নতি করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ নিতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ মনে করুন, আপনি নতুন একটি ভাষা শিখছেন। সেক্ষেত্রে প্রথম ধাপে আপনি যে শব্দগুলো শিখলেন, সেগুলো ব্যবহার করে সেই ভাষা ভালো জানেন এমন কারো সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে চর্চা করতে পারেন।
আর আপনি যখন জানবেন যে, এই মুহূর্তে আপনি যা শিখছেন, কিছুক্ষণ পরই তা আবার আপনাকে কারো সামনে পুনরাবৃত্তি করতে হবে, তখন একটা ভালো প্রতিক্রিয়া পাওয়ার আশায় নিজ থেকেই আপনি আরও মন দিয়ে কাজটি শিখতে উদ্যোগী হবেন।
হাল ছেড়ে না দেওয়া
নতুন কিছু শেখার শুরুতে আমরা উদ্যমে পরিপূর্ণ থাকি। আনন্দিত চিত্তে এগিয়ে যাই অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের পথে। আমাদের অদম্য উৎসাহের সামনে কোনো বাধাই যেন বাধা বলে মনে হয় না।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, শরীরের গঠন আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে কেউ ব্যায়াম করবেন বলে মনস্থির করলেন। সুস্থ, শক্তিশালী শরীর এবং নতুন মাত্রায় আত্মবিশ্বাস অর্জনের প্রচণ্ড ইচ্ছা এক্ষেত্রে তাকে প্রেরণা জোগাবে। তিনি ব্যাপক আগ্রহের সাথে প্রতিদিন ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলতে শুরু করবেন। এই প্রথম ধাপটিকে বলা হয় ইউফোরিয়া বা দ্য হানিমুন স্টেজ। এই ধাপে একজন ব্যক্তি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে পূর্ণোদ্যমে নিজের লক্ষ্য পূরণে এগোতে থাকেন।
এরপরের ধাপটিতে ঘটে তলিয়ে যাওয়া, ডুবে যাওয়া বা আমেরিকান লেখক সেথ গডিনের ভাষায়- ‘The Dip’। এই ধাপে এসে আপনাকে নিজের লক্ষ্যের কথা সবসময় মাথায় রেখে প্রথম ধাপে রপ্ত করা অভ্যাসগুলো চালিয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ সেই ব্যায়াম শুরু করা ব্যক্তিটি দ্বিতীয় ধাপে তার রুটিন অনুযায়ী নিয়মিত ব্যায়াম চালিয়ে যেতে থাকবেন। এই ধাপে দীর্ঘ সময় ধরে একই ছকে বাঁধা নিয়মে চলতে চলতে এক ধরনের একঘেয়েমি চলে আসতে পারে। প্রথম ধাপের মতো উৎসাহ-উদ্দীপনা এ সময়ে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু সফল ব্যক্তিদের জীবনযাত্রা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদেরও চলার পথে ‘ডিপ’ এসেছিলো, এবং সেই সময়ে তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে নিজের কাজ করে গেছেন এবং সফল হয়েছেন। সুতরাং দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছবার পর যা করণীয়, তা হচ্ছে ধৈর্য ধরে নিজের লক্ষ্যের দিকে অবিচল দৃষ্টি রেখে যে কাজটি শিখছেন, অব্যাহতভাবে সেটির পেছনে লেগে থাকা। এটি না করতে পারলে এই ধাপে এসে পথ থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
তো পাঠক, অল্প সময়ে নতুন বিষয়বস্তু আয়ত্ত্ব করার রহস্য তো জানা হলো। এবার তবে কাজে নেমে পড়ুন। আর এই কৌশলগুলো কাজে লাগিয়ে জীবনের প্রতিযোগিতায় নিজেকে এগিয়ে নিন কয়েক ধাপ।