২০১৩ সালের ৩০ মে, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় ঘুমের মধ্যেই মারা যান বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। সাত বছর হয়ে গেছে তার অকালপ্রয়াণের। কিন্তু এখনও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে তার স্মৃতি অম্লান। তার নির্মিত ছবিগুলো হয় ভীষণ রকম উদযাপিত।
তার স্মরণে এই লেখাটি ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রবোদ্ধা, লেখক ও সম্পাদক শান্তনু রায়চৌধুরীর “Remembering The Life and Times of Rituparno Ghosh” শীর্ষক প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ। প্রবন্ধটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ফিল্ম কম্প্যানিয়ন’-এ।
‘To each epoch its poet’
– Jean-Paul Sartre
কাল
১৯৮০ সালে উত্তম কুমারের মৃত্যুর সাথে সাথে, বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রবেশ করেছিল এক অন্ধকার যুগে। ঋত্বিক ঘটক তখন আর নেই, এদিকে সুচিত্রা সেনও বেছে নিয়েছেন স্ব-আরোপিত নির্বাসন। যদিও এ দশকে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন ও তপন সিনহারা আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ অব্যাহত রেখেছিলেন, এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও অভিনেতা হিসেবে সক্রিয় ছিলেন, তারপরও বাংলা চলচ্চিত্র তার মধ্যগগণ অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছিল। অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো নতুন নির্মাতারা ‘ভালো’ সিনেমার ব্যাটন বয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছিল বটে, কিন্তু তাতে সাফল্য ছিল সীমিত। যেহেতু টালিগঞ্জ অধঃপতিত হয়েছিল হিন্দি ও দক্ষিণ ভারতীয় ছবির অত্যন্ত বাজে নকল তৈরিতে – যদিও তাদের মতো অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সংস্থান কিংবা তাদের স্পর্ধা, কিছুই সেগুলোতে ছিল না – তাই দর্শকরা বেছে নিয়েছিল টেলিভিশনকে। আর টেলিভিশনও বেঁচে ছিল দর্শকদের স্বর্ণযুগের স্মৃতিমেদুরতাকে ভর করে, দেখাচ্ছিল ১৯৫০ ও ৬০-র দশকের ধ্রুপদীগুলো।
এরকমই এক সঙ্কটাপন্ন সময়ে, ১৯৯৪ সালে ‘উনিশে এপ্রিল’-এর মাধ্যমে পাদপ্রদীপের আলোয় আবির্ভূত হয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। পরবর্তী প্রায় বিশ বছর ধরে, বিশটি কাহিনী চিত্রের মাধ্যমে, এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি কেবল নতুন প্রাণসঞ্চারই করেননি, বরং এতটা প্রভাব-প্রতিপত্তি ও উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা তার আগে বাংলার খুব কম সংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মাতাই করতে সমর্থ হয়েছেন।
সিনেমা
ঋতুপর্ণ উঁচুদরের শিল্প ও বাণিজ্যিক সাফল্যের এক ঈর্ষণীয় মিশ্রণ অর্জন করেছিলেন, যা তার আগে বাংলায় কোনো চলচ্চিত্র-নির্মাতাই, যদিও বা করে থাকেন, এতটা ধারাবাহিকতার সাথে করতে পারেননি। এক দশক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘রেসপন্স’-এ কাজের সুবাদে অর্জিত যোগাযোগ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে, তিনি অনায়াসে সত্যজিৎ রায়ের বুদ্ধিদীপ্ত চলচ্চিত্রের সাথে এক করে দিয়েছিলেন স্বর্ণযুগের তপন সিনহা ও অজয় করদের মতো বলিষ্ঠ নির্মাতাদের অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য ও দর্শকবান্ধব কাজের ধারাকে। এবং তা করতে গিয়ে, তিনি বাঙালি দর্শককে হলে ফিরিয়ে এনেছিলেন, নিজের শিল্পসত্তার সাথে তিলমাত্র সমঝোতায় না গিয়েও।
সমালোচকেরা প্রায়শই উচ্চকিত হয়েছে উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং বুর্জোয়া লিভিং রুমের আবহের প্রতি তার চলচ্চিত্রিক মোহ নিয়ে। কিন্তু ঋতুপর্ণের সাথে বেশ কিছু ছবিতে সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ করা, এবং তাকে নিয়ে জীবনীমূলক তথ্যচিত্র ‘বার্ড অভ ডাস্ক’ তৈরি করা, লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সঙ্গীতা দত্ত বলেন,
“কলকাতা ভিত্তিক কিংবা শহুরে গল্পের প্রতি তার মনোযোগকে দেখতে হবে ১৯৯০’র দশকের ভোক্তা সংস্কৃতির পটভূমিতে। তবে তিনি সত্যজিৎ রায়ের ঐতিহ্যের সত্যিকারের ধারকও ছিলেন, তার সাহিত্যভিত্তিক সিনেমা (বাংলা ধ্রুপদী সাহিত্যের, বিশেষত রবি ঠাকুরের রূপান্তরে) এবং তার নারীকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত বাঙালি গল্পগুলো যার প্রমাণ। ঋতুপর্ণের প্রথমদিককার ছবিগুলো ছিল নারীবাদী, এবং সেগুলোতে তিনি গৃহনির্যাতন, বৈবাহিক ধর্ষণ, ইনসেস্ট কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবারে ট্যাবু হিসেবে বিবেচিত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছিলেন। পরের দিকের ছবিগুলোতে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন যৌনতা এবং জেন্ডার তারল্যের দীর্ঘ পরম্পরা নিয়ে, যা বাংলার সংস্কৃতি ও প্রতিপাদ্য প্রথার চিরন্তন অংশ।”
এর সাথে আরো যোগ করেন সোহিনী ঘোষ, যিনি এ জে কে গণযোগাযোগ গবেষণা কেন্দ্র, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক:
“তিনি এমন একটি সময়ে চলে গেছেন, যখন তিনি চলচ্চিত্রিক ধারণার নতুন নতুন সব দিকের উন্মোচন করছিলেন। তিনি এমন সব ছবি বানাতে চেয়েছিলেন, যার গল্প থাকবে নির্মাণের মাঝেই নিহিত। ‘কেউই পারবে না বাড়ি গিয়ে নিজে সেই গল্পটি বলতে,’ বলতেন তিনি। ‘তাদেরকে ছবিটি দেখতে হবে এবং সেটির অভিজ্ঞতা নিতে হবে।’ সব চরিত্র কাল্পনিক ছিল ওই ঘরানার দিকেই একটি পদক্ষেপ।”
তার সিনেমা সমস্ত সীমারেখা পার করে দিয়েছিল। হোক সেটি মধ্যবিত্ত শহুরে কলকাতার অন্তরঙ্গ নারী-ও-সম্পর্ক-কেন্দ্রিক চার দেয়ালে বন্দি কাহিনী, কিংবা ধ্রুপদী ও সমসাময়িক সাহিত্যের রূপান্তর, যার মধ্যে ছিল রবি ঠাকুরের কাহিনীও। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি বের করে আনতে চেয়েছিলেন বিকল্প যৌনতা এবং জেন্ডার ইস্যুগুলোকে। এছাড়াও, যে কাউকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে এমন আরেকজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতার কথা স্মরণ করতে, যিনি তার ছবিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ কিংবা পারফর্মিং আর্টের বিষয়গুলোর এত ঘন ঘন উল্লেখ রেখেছেন। এ থেকে মনে হয় যেন তিনি নিজের শিল্পসত্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচিত করছেন, এভাবে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষজনের মনস্তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজের মাধ্যমে।
ঋতুপর্ণ রবি ঠাকুরের কাজগুলোর যে রূপান্তর করেছেন, তা সত্যজিৎ রায়ের রূপান্তরগুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা। সত্যজিতের ছবি, কিংবা তার নিজেরই কম বাজেটের প্রকোষ্ঠগত কাহিনীগুলোর তুলনায়, রবি ঠাকুরের ছবিগুলো ছিল মাত্রা ও মাপকাঠিতে অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মহাকাব্যিক ‘চোখের বালি’র কথাই, যেখানে তিনি মৃতপ্রায় বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক নবদুয়ার উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন ঐশ্বরিয়া রাইয়ের মতো একটি বিশাল নামকে দলে ভিড়িয়ে।
যেহেতু তার ছবিগুলো অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানগুলোর প্রিয়মুখ হয়ে উঠেছিল, প্রতিনিধিত্ব করছিল আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতেও, তাই তার পেছনে লাইন পড়েছিল হিন্দি ছবির সবচেয়ে বড় তারকাদেরও। সেই তালিকায় ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, শর্মিলা ঠাকুর, রাখী, প্রীতি জিনতা, সোহা আলি খান, অভিষেক বচ্চন, অর্জুন রামপাল, অজয় দেবগন, জ্যাকি শ্রফ, বিপাশা বসুসহ আরো অনেকে। তাদের সাথে কাজের মাধ্যমে তিনি মুমূর্ষু ইন্ডাস্ট্রিকে চাঙ্গা করে তুলছিলেন, এবং থিয়েটারে লোকসমাগম বৃদ্ধিতেও এক অমূল্য ভূমিকা পালন করছিলেন।
দ্বিতীয়ত, যেমনটি সোহিনী ঘোষ বলেন,
“ঋতুপর্ণ অনুভব করতেন যে, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রগুলো যত অসাধারণই হোক না কেন, সেগুলোতে তিনি রবি ঠাকুরের কাজের সম্ভাব্য অতিক্রম্য দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমিত করে ফেলতেন। অন্যদিকে তার (ঋতুপর্ণের) রূপান্তর ও উদ্ভাসনগুলো ছিল নির্ভীক ও স্বাধীনচেতা।”
খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা
তবে, সম্ভবত নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে লড়াই করতে গিয়েই, তিনি সৃজনশীলতার এক পথিকশূন্য পথের হদিস পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এক বহুমনা বুদ্ধিজীবী এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভাধর লেখক, যিনি সম্পাদনা করতেন জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র সাময়িকী ‘আনন্দলোক’, এবং পরবর্তীতে বাংলা দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন এর সাংস্কৃতিক ক্রোড়পত্র ‘রোববার’। এগুলোতে কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজেকে জড়িয়েছিলেন বহুবিধ বিষয়ের সঙ্গে, যার মধ্যে ছিল কবিতা, রাজনীতি, যৌনতা, ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ও আত্মকথা। আর সেগুলো প্রচণ্ড পাঠকপ্রিয়ও হয়েছিল। সঙ্গীতা দত্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সেই দিন আর দূরে নয় যেদিন ঋতুপর্ণ ঘোষ পুনর্মূল্যায়িত হবেন বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে।
“জীবনের শেষ দিনগুলোতে তার লেখনী এত বেশি সংবেদনশীলতায় পূর্ণ ছিল! এবং সেগুলো শুধু এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের প্রতিই নয়, বরং প্রান্তিক কিংবা মধ্যবর্তী সকলের জন্যই।”
তার সিনেমায় সেই শুরু থেকেই ‘অস্বাভাবিকতা’-র একটি অন্তঃস্রোত বিদ্যমান ছিল, এবং সম্ভবত তিনিই প্রথম ‘তারকা’ যিনি আড়ম্বতার সাথে, দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ‘উদ্ভাসিত হয়েছিলেন’ স্বমহিমায়। এটি নিঃসন্দেহে ছিল এমন একটি বিষয় যা নিয়ে তিনি সবসময় বেদনার্ত ছিলেন। ‘বার্ড অভ ডাস্ক’-এ ঋতুপর্ণের বন্ধু ও গুরু, অপর্ণা সেন কথা বলেছেন তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার অন্তঃবিক্ষোভ নিয়ে:
“আমি প্রায়ই ওকে জিজ্ঞেস করতাম ও আমার মতো হতে চায় কি না, লিঙ্গান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে চায় কি না, এবং ও সবসময়ই ‘না’ বলত।”
তারপরও, ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট থেকে আইপিসি’র সেকশন ৩৭৭ এর রায়প্রদানের পূর্বে তিনি প্রকাশ্যে ‘মেয়েলী পোশাক’ ও জাঁকালো সাজসজ্জায় হাজির হতে শুরু করেছিলেন। ‘ক্রস ড্রেসিং’ ছাড়াও, তিনি নিজের ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন দৃপ্তভাষী, এবং সোহিনী ঘোষের শব্দে, তিনি চেষ্টা করতেন “নিজের স্টার পারসোনাকে কাজে লাগিয়ে বাঙালি ভদ্রলোকের অন্দরমহল থেকে এই ব্যতিক্রমিতাকে বের করে আনতে।” এবং এ কাজে তার যে ভূমিকা ও অবদান, তা অতুলনীয়।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এর জন্য তাকে বিরাট মূল্য চোকাতে হয়েছিল, ব্যক্তিগতভাবে, এবং একজন শিল্পী হিসেবেও। প্রথমত, এটি প্রায়ই তার চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক হিসেবে অর্জনগুলোকে ঢেকে দিতে শুরু করেছিল। দ্বিতীয়ত, যেমনটি তিনি নিজেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌস্তুভ বকশীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন,
“আমি প্রকৃতপক্ষেই আমার দর্শকগোষ্ঠীর একটি শ্রেণীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। যে শ্রদ্ধা ও সম্মান আমি পেতাম, তাতে গুরুতর আঘাত লেগেছে আমার যৌনতা প্রকাশের সিদ্ধান্তে।”
এরপরও সমকালীন সংস্কৃতিতে তার যে প্রভাব ছিল, তা কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। তার প্রথমদিকের নারীবাদী কাজগুলো থেকে শুরু করে ‘গে ফিল্ম মেকার’ হিসেবে শেষের কাজগুলো, সবখানেই তিনি নতুন নতুন সব ‘ট্রেন্ড’ স্থাপন করছিলেন, এবং পারিবারিক দৃশ্যপটে যৌন পরিচয় ও সামাজিক প্রথা বিষয়ক অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন উত্থাপন করে যাচ্ছিলেন।
ঋতুপর্ণ ঘোষের গুরুত্ব কেবল একটি মরণোন্মুখ ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে তোলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিবেশে তার অবদানকে অগ্রগামী করে তুলেছে যুগের ভাবধারা ও মানসিকতাকে তুলে ধরার এক অভূতপূর্ব ধরন। আর তা করতে গিয়ে তিনি এক সামাজিক ও সিনেম্যাটিক বিপ্লবেরও প্রবর্তন করেছিলেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন তার যুগের এমন একজন শিল্পী, যিনি বিদায় নেয়ার পূর্বে, অতিক্রম করেছিলেন আপন সময়ের অনেক কিছুকেই।