স্ট্রিমিং পরিষেবায় নেটফ্লিক্সের একচেটিয়া রাজত্বে ভাগ বসাতে আবির্ভূত হয়েছে আরো অসংখ্য প্রতিযোগী। শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বর্তমানে তিন শতাধিক স্ট্রিমিং পরিষেবা কাজ করছে। প্রতিষ্ঠিত অনেক কোম্পানিই এখন নিজস্ব স্ট্রিমিং পরিষেবা চালু করতে আগ্রহী। সামনের দিনগুলোতে এদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
নেটফ্লিক্সের বাইরে মূলধারার স্ট্রিমিং পরিষেবার মধ্যে এখন হুলু এবং অ্যামাজন প্রাইমের যথেষ্ট সংখ্যক গ্রাহক রয়েছে। এগুলোর বাইরেও সাম্প্রতিক সময়ে এই পরিষেবায় যুক্ত হয়েছে ডিজনি ও এটিঅ্যান্ডটি (টাইম ওয়ার্নার মিডিয়া এবং ডিরেক্টটিভির বর্তমান মালিক)। এমনকি ফেসবুক এবং অ্যাপলের মতো প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও অচিরেই এই পরিষেবায় যুক্ত হতে এখন অত্যন্ত আগ্রহী।
স্ট্রিমিং পরিষেবার বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজার অনেকের কাছেই বেশ আকর্ষণীয় মনে হতে পারে। অনেকেই ভাবতে পারেন যে, যত বেশি কোম্পানি এমন পরিষেবায় যুক্ত হবে, দর্শকেরা হয়তো তত বেশি গুনগত মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি কিন্তু ঠিক এমন নয়।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। সহজ কথায়, স্ট্রিমিং সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর এই প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটি আসলে নষ্ট করে ফেলছে। পারস্পরিক সহযোগিতার বদলে এক ধরনের বৈরী প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়ার কারণে এই পরিষেবাদাতারা কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র জায়গা ছাড় দিতে আগ্রহী নয়।
উদাহরণস্বরূপ, গত বছরের শেষের দিকে লুক কেইজ নামে একটি ওয়েবভিত্তিক টিভি শো বাতিল হওয়ার কথা বলা যায়। সিরিজটি শুধু বাতিলই হয়নি, বরং ডিজনি এবং নেটফ্লিক্সের মধ্যে আদর্শগত বিভাজনও তৈরি করে দিয়েছে।
অনেকগুলো স্ট্রিমিং পরিষেবা একদিকে যেমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে আস্থাগত বিভাজন তৈরি করছে, আবার ঠিক তেমনি, মূলধারার হলিউড চলচ্চিত্র ব্যানার এবং এই ধরনের কোম্পানিগুলোর মধ্যেও মুনাফাভিত্তিক বৈরিতা তৈরি করছে।
নেটফ্লিক্স বিস্ফোরণ
এখন থেকে ঠিক পাঁচ-ছয় বছর আগে স্ট্রিমিং পরিষেবা বলতে ছিল শুধুমাত্র নেটফ্লিক্সই। বিভিন্ন চ্যানেলের জনপ্রিয় পুরনো টিভি শো-গুলোকে স্ট্রিমিং পরিষেবার আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে নেটফ্লিক্স এবং মূল টিভি চ্যানেল- উভয়েই নতুন করে মুনাফা লাভ করছিল।
ব্রেকিং ব্যাড, দ্য ওয়াকিং ডেডের মতো শো-গুলোর কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেগুলো নেটফ্লিক্সের মাধ্যমেই নতুন প্রজন্মের অনেক দর্শকের কাছে আবারো জনপ্রিয় হয়েছে এবং পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণে মুনাফা লাভ করেছে।
নেটফ্লিক্সের এই বিস্ফোরণসম-দ্রুত উত্থানে পরবর্তীতে হুলু, কমকাস্ট, ফক্সের মতো কোম্পানিগুলো পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। ব্যবস্থা হিসেবে এইচবিও এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের নিজস্ব অ্যাপ চালু করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
এদিকে নেটফ্লিক্সও তাদের ব্যবসা বাড়াতে অঞ্চলভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শক টানতে নানা ভাষায় নিজস্ব কন্টেন্ট তৈরি করতে শুরু করে।
এর দরুন, মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেল এবং নেটফ্লিক্সের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হতে শুরু করে। শুধুমাত্র ২০১৮ সালে নেটফ্লিক্স তাদের নিজেদের তৈরী কন্টেন্টের মাধ্যমে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার মুনাফা লাভ করেছে। নেটফ্লিক্স পরিষেবার এই বিস্ময়কর সাফল্য ভাবিয়ে তুলেছে মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকেও।
বর্তমানে বেশ এইচবিও, শোটাইম, স্টারজ, সিবিএসের মতো নামকরা টিভি চ্যানেল প্লেস্টোরে অবমুক্ত করেছে নিজস্ব অ্যাপ। সেখানে তাদের অতীত-বর্তমানের সব শো নিয়ে নিজস্ব আর্কাইভ গড়ে তোলা হয়েছে, যেন দর্শকেরা ‘চাহিবা মাত্রই’ প্রিয় অনুষ্ঠানটি খুঁজে নিতে পারেন। মূলধারার চ্যানেল হয়েও অ্যাপ, তথা অনলাইনভিত্তিক এ সক্রিয়তার মূল কারণ একটিই- নেটফ্লিক্সের কাছে বাজার খোয়াতে চায় না তারা।
স্ট্রিমিং পরিষেবা এবং গ্রাহক অসন্তুষ্টি
স্ট্রিমিং পরিষেবা গ্রহণকারী দর্শকদের উপর হাব রিসার্চের সাম্প্রতিক এক জরিপে চমকপ্রদ বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। পরিষেবা গ্রহণকারী প্রায় ২৫ শতাংশ দর্শক একাধিক পরিষেবা নিয়ে থাকেন। অথচ ঠিক এক বছর আগেও এই ধরনের একাধিক স্ট্রিমিং পরিষেবা-গ্রহণকারী ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ।
একই জরিপে পাওয়া আরেক তথ্যানুসারে, এই ব্যবহারকারীদের শতকরা ৩৬ ভাগ ব্যবহারকারী বর্তমানের স্ট্রিমিং পরিষেবার ধরন বা কাঠামো নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। মানসম্পন্ন নতুন কোনো পরিষেবার জন্য তারা তাদের বর্তমানের সাবস্ক্রিপশন পরিবর্তন করতেও রাজি আছেন।
বর্তমানের উঠতি বাজারের পাশাপাশি, এই স্ট্রিমিং পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে গ্রাহকদের যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, এই বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রচ্ছন্নভাবে হলেও, সাম্প্রতিক জরিপে এই বিষয়টি উঠে এসেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি ব্যবহারকারী সাম্প্রতিক সময়ের এই পরিষেবাগুলোর লড়াই নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত। পছন্দের প্রোগ্রামগুলো দেখতে তাদের যে একাধিক কোম্পানির সাবস্ক্রিপশন নিতে হচ্ছে, এই বিষয়টি নিয়ে তারা মোটেও সন্তুষ্ট নয়।
ডিলোইটের ভাইস চেয়ারম্যান কেভিন ওয়েস্টকট স্ট্রিমিং পরিষেবার বর্তমান বাজার বেশ কয়েক বছর ধরেই গবেষণা করেছেন। তার মন্তব্য অনুসারে-
“আমরা প্রায় ২০০০ গ্রাহকের উপরে একটি গবেষণা চালিয়েছি। স্ট্রিমিং পরিষেবার ব্যবহারকারীরা খুব যে একটা শান্তিতে তাদের পছন্দের অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করতে পারছেন, তা কিন্তু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের একাধিক পরিষেবা গ্রহণ করতে হচ্ছে।
অনেকেই আছেন, যারা চার-পাঁচটি পরিষেবা নিয়ে বসে আছেন। এক্ষেত্রে তাদের যেমন বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে, তেমনি তারা একটি নির্দিষ্ট কোনো একটি পরিষেবা থেকে পুরোপুরি সন্তুষ্টও হতে পারছেন না।
প্রায় ৫৭ শতাংশ ব্যবহারকারীর এই অভিযোগ যে, তাদের অনেকের পছন্দের শো হঠাৎ করেই নাকি মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আবার ৪৭ শতাংশ ব্যবহারকারী, স্ট্রিমিং প্রতিষ্ঠানগুলোর এই মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ নিয়েই বিরক্ত।”
কেবল টিভি এবং নেটফ্লিক্স হুমকি
স্ট্রিমিং পরিষেবার ক্রমবর্ধমান বাজার প্রচলিত ক্যাবল টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য বর্তমানে মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯ সালে, অর্থাৎ বিগত এক বছরে এই টিভি চ্যানেলগুলোর দর্শক প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে।
ঠিক বিপরীতভাবে, অ্যামাজন প্রাইম এবং হুলুর মতো স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলো এই সময়ে গড়ে প্রায় ৫-১০ শতাংশ নতুন ব্যবহারকারী পেয়েছে। এক্ষেত্রে সবথেকে এগিয়ে আছে নেটফ্লিক্স।
স্ট্রিমিং পরিষেবার প্রায় ৬২ শতাংশ ব্যবহারকারী হলেন নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইবার। একসময়ে বছরে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা পাওয়া এই নেটফ্লিক্সের বর্তমানে বার্ষিক লাভের পরিমাণ ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
জরিপে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাবল টেলিভিশন আর আগের অবস্থানে নেই। কয়েক গুণ বেশি বাৎসরিক চার্জ পরিশোধ করে ক্যাবল টিভি দেখতে দর্শকেরা দিনকে দিন আগ্রহ হারাচ্ছেন। ঝুঁকে পড়ছেন স্ট্রিমিং পরিষেবার দিকে।
এদিকে স্ট্রিমিংয়ের ক্ষেত্রেও, শুধুমাত্র পরিষেবার সাবস্ক্রিপশন নেওয়াই আবার দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য যথেষ্ট হচ্ছে না! একাধিক পরিষেবার সম্মিলিত চার্জ নিয়েও তারা বেশ বিরক্ত। আবার, এই ধরনের স্ট্রিমিং পরিষেবা কোম্পানিগুলো বাড়তি সুবিধা প্রদানের নামেও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে।
স্ট্রিমিং পরিষেবা এবং পাইরেসি
স্ট্রিমিং পরিষেবার মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা পাইরেসিকে উৎসাহিত করছে। পছন্দের অনুষ্ঠানগুলো একটি নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে না পাওয়ায় অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ছেন। পছন্দের স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলোর সম্মিলিত চার্জ উন্নত বিশ্বের জনগণ সামাল দিতে পারলেও, ৩য় বিশ্বের অধিকাংশের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। কাজেই, অনেকেই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বেআইনি টরেন্ট কিংবা ডাউনলোডিং সাইটগুলোতে ভিড় করছে। কিন্তু এই পাইরেসির ফলে স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলো বঞ্চিত হচ্ছে বড় অঙ্কের মুনাফা থেকে।