চলচ্চিত্র জগতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের ‘অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম’। মুক্তি পাওয়ার আগেই অনেক বক্স অফিস বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই ছবিটির সামনে রয়েছে জেমস ক্যামেরনের অ্যাভাটার ছবির গড়া দশ বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার সুবর্ণ সুযোগ।
২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যাভাটার ছবিটি ২.৭৮ বিলিয়ন আয় করে এখন পর্যন্ত সর্বকালের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবি। তবে এন্ডগেম যেহেতু মাত্র ১১ দিনেই ২ বিলিয়নের বেশি আয় করার গৌরব অর্জন করেছে, এবং ইতিমধ্যেই টাইটানিককে পেছনে ফেলে সর্বকালের সর্বাধিক আয়কৃত ছবির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে, তাই এখন আর এন্ডগেমের পক্ষে অ্যাভাটারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে অসম্ভব কিছু বলে মনে হচ্ছে না। বরং শেষ পর্যন্ত এন্ডগেম যদি অ্যাভাটারকে টপকে যেতে না পারে, সেটিই হবে পরম বিস্ময়ের ব্যাপার।
তবে এন্ডগেম অ্যাভাটারকে ছাড়িয়ে যাক কিংবা অ্যাভাটারই শীর্ষস্থান ধরে রাখুক, এতে আর যারই মাথা ব্যথা থাকুক না কেন, একজন ব্যক্তির কিন্তু থাকবে না। কেননা যা-ই ঘটুক না কেন, ‘আল্টিমেট উইনার’ যে তিনিই। অ্যাভাটার ও এন্ডগেম দুই ছবিতেই যে তিনি অভিনয় করেছেন! হ্যাঁ পাঠক, বলছি জো সালদানার কথা। তিনিই সেই পরম সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি সর্বকালের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল দুটি ছবিতেই অভিনয় করেছেন।
এখানেই শেষ নয়। সর্বকালের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় এই মুহূর্তে পঞ্চম স্থানে থাকা ‘অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার’ ছবিটিতেও ছিলেন তিনি, যা তাকে পরিণত করেছে ইতিহাসের একমাত্র অভিনেতায় (নারী-পুরুষ মিলিয়ে), যিনি সর্বকালের সর্বোচ্চ পাঁচটি ব্যবসাসফল ছবির মধ্যে তিনটিতেই অভিনয় করেছেন। তাই তো বিনোদন জগতে অনেকেই এখন তাকে অভিহিত করছে ‘বক্স অফিস কুইন’ হিসেবে।
এন্ডগেম মুক্তির আগপর্যন্ত সালদানার ঝুলিতে ছিল সর্বকালের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল পাঁচটি ছবির মধ্যে দুটিতে অভিনয়ের কৃতিত্ব। অবশ্য একই কৃতিত্ব ছিল তার গার্ডিয়ানস অব দ্য গ্যালাক্সির সহ-অভিনেতা ক্রিস প্র্যাটেরও। ক্রিস প্র্যাটকে দেখা গেছে ইনফিনিটি ওয়ার ও জুরাসিক ওয়ার্ল্ডে, যে দুটি ছবি যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে ছিল শীর্ষ পাঁচের তালিকায়।
তবে এন্ডগেমের সাফল্যে এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন সালদানা। তিনি নিজে যেমন এখন সেরা পাঁচের তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছেন, ঠিক তেমনই পেছনে ফেলে দিয়েছেন প্র্যাটকেও। প্র্যাট এন্ডগেমে থাকলেও, সামগ্রিকভাবে তার ঝুলিতে এখন সেরা পাঁচের দুটি ছবিতে অভিনয়ের কৃতিত্ব রয়েছে। কেননা, এন্ডগেমের অন্তর্ভুক্তিতে প্র্যাট অভিনীত জুরাসিক ওয়ার্ল্ড নেমে গেছে সর্বকালের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে।
চলুন দেখে নিই, এই মুহূর্তে সর্বকালের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল পাঁচটি ছবি কোনগুলো:
১. অ্যাভাটার – ২.৭৮ বিলিয়ন ডলার
২. অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম – ২.১৮৮ বিলিয়ন ডলার (প্রথম ১১ দিনে)
৩. টাইটানিক – ২.১৮৭ বিলিয়ন ডলার
৪. স্টার ওয়ার্স: দ্য ফোর্স অ্যাওয়াকেন্স – ২.০৬৮ বিলিয়ন ডলার
৫. অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার – ২.০৪৮ বিলিয়ন ডলার
অর্থাৎ শীর্ষ পাঁচের প্রতিটি ছবিই দুই বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পার করেছে, এবং সেই পাঁচটি দুই বিলিয়নের গণ্ডি পার করা ছবির মধ্যে তিনটিতেই আছেন সালদানা। অসামান্য অর্জন, তাই না?
তবে হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত অ্যাভেঞ্জার্সের চারটি ছবিই রয়েছে শীর্ষ দশ ব্যবসাসফল ছবির তালিকায়, এবং সেই চারটি ছবিতেই অভিনয়ের সুবাদে, দারুণ একটি রেকর্ড রয়েছে রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, ক্রিস ইভান্স, ক্রিস হেমসওয়ার্থ, স্কারলেট জোহানসন এবং মার্ক রাফালোর নামের পাশেও। তারা প্রত্যেকেই অভিনয় করেছেন সর্বকালের সর্বোচ্চ দশ ব্যবসাসফল ছবির মধ্যে চারটিতে।
কিন্তু তারপরও, সালদানা ও প্র্যাটের অর্জনটা আরো বেশি ঈর্ষণীয় এ কারণে যে, তারা তাদের রেকর্ডটি গড়েছেন আলাদা দুটি স্টুডিওর আলাদা দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। অ্যাভেঞ্জার্সের ছবি দুটি মার্ভেল স্টুডিওজের হলেও অ্যাভাটার ছবিটি ছিল লাইটস্টর্ম এন্টারটেইনমেন্টের, এবং জুরাসিক ওয়ার্ল্ড ছিল ইউনিভার্সাল পিকচার্সের।
এদিকে সালদানার জন্য সুখবর হলো, সামনেই মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তার অ্যাভাটার ২ ও গার্ডিয়ানস অব দ্য গ্যালাক্সি ভলিউম ৩ ছবি দুটি। এর মধ্যে গার্ডিয়ানস অব দ্য গ্যালাক্সি ভলিউম ৩ হয়তো এক বিলিয়নের সীমানা পেরিয়েই থেমে যাবে, তবে অ্যাভাটার ২-এর সামনে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে আরো একবার দুই বিলিয়নের মাইলফলক স্পর্শের। সেক্ষেত্রে সালদানার নামের পাশে থাকবে দুই বিলিয়ন ডলার পেরোনো চার-চারটি ছবি, যে রেকর্ড হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কেউই ভাঙতে পারবে না। আর হ্যাঁ, চারটি অ্যাভেঞ্জার্স ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে যারা শীর্ষ দশের মধ্যে চারটি ছবির মালিক, তাদের পাশেও নাম লেখাবেন সালদানা, এবং তা-ও আরো বেশি উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে।
মাত্র গত গ্রীষ্মেই, অ্যাভাটার ছবিতে নেতিরি এবং মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সে গামোরা চরিত্রে অভিনয় করা সালদানা হলিউড ওয়াক অব ফেমে জিতেছিলেন স্টার অ্যাওয়ার্ড। সেখানে তার লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা বিষয়ক বক্তৃতাটি হৃদয় জয় করে নিয়েছিল সকলের। তিনি বলেছিলেন,
স্বপ্ন দেখা কেবল প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপটি হলো: হাতা গুটিয়ে কঠোর পরিশ্রম শুরু করা, এবং সেই পরিশ্রমে নিজের সকল আবেগ, ধৈর্য ও অধ্যবসায় ঢেলে দেয়া। আপনি হয়তো বারবার ব্যর্থ হবেন, কিন্তু তবু আপনাকে এগিয়ে চলতে হবে। শুরুতেই আপনি সাফল্য পাবেন না। বারবার হোঁচট খাবেন, তবু চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
আমি শিখেছি কীভাবে নিজের কাজকে ভালোবাসা যায়, এবং কীভাবে ভালোবাসার কাজকে নিজের করে নেয়া যায়। এটিই আমার মূলমন্ত্র। বার্গার কিংয়ের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু হয়েছিল আমার। এরপর করেছিলাম ল’ অ্যান্ড অর্ডার এপিসোডিক। সেখান থেকে একটি ব্যালে ছবি, এবং তারপর একে একে একজন জলদস্যু সাজা, আইএনএস অফিসার হওয়া, এন্টারপ্রাইজের জেনোলজিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। পরবর্তীতে আমি হয়েছি একজন এলিয়েন ওয়ারিয়র, কিংবা বলা ভালো, অনেকগুলো এলিয়েন ওয়ারিয়র।
এরপর তিনি কথা বলেন সায়েন্স ফিকশন জনরা নিয়েও। কারণ এই জনরার কাছে যে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই জনরা তাকে আজকের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভে অপরিসীম সাহায্য করেছে। গার্ডিয়ানস ও অ্যাভাটার তো আছেই, পাশাপাশি তিনি অভিনয় করেছেন জে জে আব্রামের স্টার ট্রেক ফ্র্যাঞ্চাইজিতেও। তাই তো অনেকের কাছে তিনি ‘সাই-ফাই প্রিন্সেস’-ও বটে।
সায়েন্স ফিকশন হলো এমন একটি জগত, যেখানে আমার মতো একজন অকল্পনীয় ব্যক্তিকে কল্পনার যোগ্য করে তুলেছেন জে জে আব্রাম থেকে শুরু করে জেমস ক্যামেরন কিংবা জেমস গানের মতো নির্মাতারা। আমি সত্যিই এই জনরায় নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছি। এই জনরায় আমি কেবলই কারো কন্যা, কারো স্ত্রী কিংবা কারো প্রেমিকার ভূমিকায় সীমাবদ্ধ থাকিনি। এখানে আমি নিজেকে উপস্থাপন করেছি সাহসী ও শক্তিশালী হিসেবে। আমি একজন যোদ্ধা হয়েছি, এবং কাহিনীর সাথে প্রাসঙ্গিকতাও লাভ করেছি। আমি গর্বিত যে নিজের জন্য আমি এই পথ বেছে নিয়েছি, এবং একঘেয়ে হয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছি।
নিজের ব্যাপারে এমন আত্মবিশ্বাস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা বরাবরই পোষণ করে এসেছেন সালদানা। এন্ডগেম মুক্তির পর প্রথম সপ্তাহান্তেই যখন বিশ্বব্যাপী ছবিটি ১.২ বিলিয়ন ডলার আয় করে ফেলে, ভ্যারাইটির কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে নিজের স্বপ্নের কথা তিনি খুলে বলেন কোনোরকম দ্বিধা না রেখেই। তিনি বলেন, এন্ডগেম যদি আয়ের দিক থেকে অ্যাভাটারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তাহলে নাকি তিনি হয়ে উঠবেন গিনেস বুকে নাম তোলার যোগ্য দাবিদার। কারণ তিনি যে অসাধ্য সাধন করবেন, তা যে আর কেউই করতে পারেনি!
সত্যিই তা-ই। আজকাল নতুন কোনো ছবি এলেই সেটি কয় মিলিয়ন (কিংবা বিলিয়ন) আয় করল, কাকে কাকে পেছনে ফেলল, নতুন কোন ইতিহাস গড়ল- এসব নিয়ে মেতে ওঠে চলচ্চিত্রপ্রেমী সকলে। ভাবখানা এমন যেন বক্স অফিসই সাফল্যের চূড়ান্ত মাপকাঠি। আর যদি তা-ই হয়ে থাকে, সেই মাপকাঠি অনুযায়ী সালদানার চেয়ে সফল যে এই মুহূর্তে আর কেউই নেই।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/