মশলা; নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে হরেক বর্ণ-গন্ধ-আকৃতিসমৃদ্ধ বেশ কিছু খাদ্য উপাদানের চিত্র। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত একটি জাদুকরী উপাদান এই মশলা। বাঙালির ঘরে ঘরে এমন কোনো হেঁসেল নেই যেখানে হরেক রকমের মশলা পাওয়া যাবে না। মাছ, মাংস, শাকসবজির প্রকারভেদ অনুযায়ী বাঙালি গৃহবধূরা বেছে নেন নানা প্রকারের মশলা। এই মশলাগুলো শুধু খাবারের স্বাদই বাড়ায় না, খাবারকে সমৃদ্ধ করে বিভিন্ন পুষ্টিগুণেও। চলুন একনজরে ইতিহাসের পাতা থেকে জেনে আসি মশলার ইতিহাস সম্পর্কে।
ইতিহাসে মশলার আধিপত্য
সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্ভিদের শেকড়বাকড় শুকিয়ে তা ব্যবহার করে আসছে। কালক্রমে সেই ব্যবহারকেই মানুষ নিজের প্রয়োজনের তাগিদে বদলে নিয়েছে নানা রূপে। একসময় দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যের একটি একচেটিয়া অংশ হিসেবে রাজত্ব করেছিল বিভিন্ন জাতের সুগন্ধী মশলা ও মশলাজাত দ্রব্যাদি। প্রাচীন মিশর, ভারতসহ প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সভ্যতা ও অঞ্চলে রান্নাবান্না, খাদ্য সংরক্ষণ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নৈবেদ্য, মৃতদেহ সৎকার, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা, রূপচর্চা প্রভৃতি কাজে ব্যবহৃত হতো বিভিন্ন মশলা। এছাড়াও বাইবেলসহ বিভিন্ন চীনা প্রবাদ ও ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীতে মশলার ব্যবহার ও গুণাগুণ সম্পর্কে রচিত আছে নানা মুখরোচক কাহিনী।
বাইবেলে কথিত আছে, রাজা সলোমন (হযরত সোলায়মান আ.) নাকি গানে গানে জাফরান ও দারুচিনির গুণাগুণ ব্যক্ত করতেন। এছাড়াও আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে রানী শেবা জেরুজালেম ভ্রমণের সময় রাজা সলোমনকে অঢেল স্বর্ণ, মণিমাণিক্য ছাড়াও অনেক দামী সুগন্ধী মশলা উপহার দেন বলে জানা যায়।
প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসাব্যবস্থায় পেঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতা, মেথি, মৌরি, গোলমরিচসহ আরো নানা মশলার আধিপত্য ছিল। তৎকালীন মিশরীয়রা পেঁয়াজ, রসুনসহ অন্যান্য কাঁচা মশলাকে সুস্বাস্থ্য, সুদৃঢ় মনোবল এবং আদর্শ খাদ্যাভ্যাসের প্রতীক বলে মনে করত। এমনকি ফারাওদের পিরামিডে তাদের কফিনের কাছে এসব মশলা রেখে দেয়া হতো বলেও শোনা গিয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, পরবর্তী জীবনের পূর্ণতা ও দীর্ঘায়ু লাভই নাকি এসব মশলা ব্যবহারের অন্যতম কারণ। এছাড়া, মিশরীয়দের দৈনন্দিন খাবারে এলাচি ও দারুচিনি ছিল অপরিহার্য, যা আসত সুদূর ইথিওপিয়া থেকে।
এছাড়াও বিভিন্ন চীনা প্রবাদ ও মিথোলজিতেও রয়েছে মশলার দারুণ সব আখ্যান। খ্রিস্টপূর্ব ২৭ শতকে বিখ্যাত চৈনিক আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ শেং নুং তার ক্লাসিক হারবাল (Classic Herbal) নামক বইয়ে লিখে যান একশোরও বেশি ঔষধি গুণসমৃদ্ধ মশলার কথা। এসবের মাঝে অন্যতম ছিল ক্যাসিয়া (cassia) নামক দারুচিনি গোত্রের মশলা, যা চীনা ভাষায় কুয়েই (kwei) নামে পরিচিত। কালক্রমে দক্ষিণ চীনের কুয়েলিন নামক প্রদেশে ক্যাসিয়া সমৃদ্ধ একটি গোটা জঙ্গলই আবিষ্কার করেন নৃতত্ত্ববিদরা।
ইন্দোনেশিয়ার সুবৃহৎ মলুক্কাস দ্বীপ ছিল প্রাচীন যুগে চীনের মশলা যোগানের ভান্ডার। এজন্য এই দ্বীপকে ইংরেজিতে Spice island-ও বলা হয়ে থাকে। এই মলুক্কাস দ্বীপ থেকে সমুদ্রপথে চীনে পৌঁছত জায়ফল, জয়ত্রী, লবঙ্গসহ আরো কিছু আয়ুর্বেদিক গুণসমৃদ্ধ মশলা। তৎকালীন চীনা রাজসভায় সম্রাটদের সাথে কথোপকথনের সময় প্রত্যেক সভাসদেরই মুখে লবঙ্গ পুরে থাকার নিয়ম ছিল। এছাড়াও খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্রপথের মাধ্যমে তাজা আদা সরবরাহ করা হতো, যার উদ্দেশ্য ছিল তাজা খাবার সংরক্ষণ ও স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ।
মশলার ইতিহাসের সাতকাহন শোনাতে গেলে সবচেয়ে দাপুটে ভূমিকা পালন করবে প্রাচীন ভারতই। প্রাচীন ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ রন্ধনশৈলীর কথা আমাদের কারোই অজানা নয়। সেই রন্ধনকার্যে রুচিশীল ভূমিকা পালন করেছে বেশ কিছু নামীদামী মশলা। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৮ম শতকে বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ এড়াতে দারুচিনি ও হলুদ ব্যবহার করতেন চিকিৎসকেরা। এছাড়াও ভূতপ্রেত কিংবা বিভিন্ন অশুভ ছায়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে সাদা সরষে, গোলমরিচসহ বিভিন্ন তীব্র সুগন্ধী মশলার ব্যবহারের কথাও শোনা যায়। কাটাছেঁড়া, শূলবেদনাসহ ত্বকের বিভিন্ন সংক্রমণ এড়াতে তৎকালীন ভারতীয়রা এলাচ, হলুদ, দারুচিনি, সরষে, গোলমরিচ, আদাসহ বেশ কিছু মশলা ব্যবহার করতেন। আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞদের মতে, লবঙ্গ ও এলাচ দিয়ে পান মুড়িয়ে খেলে তা হজমসহ বিপাকক্রিয়ায় বেশ সাহায্য করে; আর মশলার এই প্রচলন সুদূর ভারতবর্ষ থেকেই এসেছে বলেও ধারণা করা হয়।
চৈনিক ও ভারতীয় সভ্যতার পাশাপাশি মশলার রাজত্বে পিছিয়ে নেই মেসোপটেমিয়া সভ্যতাও। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা এ সভ্যতার বুকেই জন্ম নিয়েছে তিল, তিসি, থাইম, জাফরান, পোস্তদানা, তারামৌরির মতো দারুণ সব মশলা। কথিত আছে, তিলের তেলের প্রচলন শুরু হয় এ সভ্যতা থেকেই। এছাড়াও আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকেই পারস্যে পেঁয়াজ, এককোষী পেঁয়াজ, রসুনের বেশ ফলন হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন পারস্যের অধিবাসীরা লিলি, গোলাপ, জাফরান, ধনে ইত্যাদি শস্য থেকে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এসেনশিয়াল তেল বানাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতাও মশলার ব্যবহারে বেশ সমৃদ্ধশালী ছিল। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ভূখণ্ড দারুচিনি, ক্যাসিয়া, জাফরান, মরিচ, আদাসহ ইত্যাদি মশলাচাষে বেশ উর্বর থাকায় সেখানে এসবের ফলন হতো বেশ। গ্রীকরা পাউরুটিসহ অন্যান্য গমজাত খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতে পোস্তদানা ব্যবহার করত। তাছাড়াও ভিনেগার বা সাদা সিরকার সস প্রস্তুতে মৌরি এবং মাংস রান্নায় ব্যবহৃত হতো পুদিনাপাতা। ওয়াইন বা মদ প্রস্তুতে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার কথা না বললেই নয়! সেক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতো ধনে ও পার্সলে পাতার কুচি। ভোজসভায় অযাচিত মাতলামি এড়ানোর জন্যে গ্রিকরা মার্জোরাম (marjoram) নামক একধরনের মশলাজাতীয় পাতার মুকুট পরিধান করতেন বলে জানা যায়। উদ্ভিদবিদ্যার জনক হিসেবে পরিচিত বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক থিওফ্রাস্টাস তার রচিত দুটি বইয়ে ৬০০টিরও বেশি মশলা ও উপকারী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের কথা লিখে গেছেন।
মধ্য ইউরোপে মশলা ছিল খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য জিনিসপত্র আদানপ্রদানের অন্যতম ধারক ও বাহক। কথিত আছে, এক পাউন্ড জাফরানের মূল্য ধরা হতো একটি ঘোড়ার সমমূল্যের! এমনকি এক পাউন্ড জায়ফলের মূল্য ছিল সাতটি দুধেল গাভির সমান। বিয়েতে উপঢৌকন ও যৌতুক হিসেবে বিবাহিত দম্পতিরা মরিচ, জাফরানের মতো অন্যান্য দামী মশলা উপহার পেতেন। এমনকি বাড়িওয়ালারা বাড়ি ভাড়ায় অর্থের বদলে গুণে নিতেন গোলমরিচের দানাও।
খ্রিস্টীয় ১০৯৫ অব্দে ক্রুসেডের আগমনের পর আদানপ্রদানের এই প্রথা মধ্যযুগীয় ইউরোপে যেন আরো সহজলভ্য রূপ ধারণ করে। এর ফলশ্রুতিতে বাজারে কমে যায় এশীয় মশলার দাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইংরেজরা ভোলেনি মশলার গুণাগুণ ও ব্যবহারের কথা। প্রতিটি বাগানেই চাষ হতো আদা, রসুন, পেঁয়াজের মতো ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন মশলা। এছাড়াও জাফরান, পোস্তদানা, দারুচিনি, এলাচ ইত্যাদি মশলা বাজে দুর্গন্ধ দূর করতে, পোকামাকড়ের সংক্রমণ প্রতিরোধসহ নানা ভেষজ কাজে ব্যবহার করত ইংরেজরা।
ধর্মীয় বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকেও নিয়ন্ত্রিত হতো মশলার ব্যবহার। সেক্ষেত্রে চার্চ এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয় পালন করত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ধর্মীয় আরাধনায় নৈবেদ্য হিসেবে ব্যবহৃত ওয়াইনে থাকত ধনিয়া, জাফরান, লবঙ্গসহ আরো বেশ কিছু মশলা। এছাড়াও বিভিন্ন অপদেবতার প্রভাব এড়াতে ইংরেজরা দরজার সামনে ঝুলিয়ে রাখত রসুন, শুকনো মরিচের মালা ইত্যাদি। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এতসব কুসংস্কারের ভীড়েও ব্রিটিশ সভ্যতার একটি প্রধান বাহক হিসেবে ভূমিকা পালন করে এসব মশলা।
সিলফিয়াম (silphium): একটি বিলুপ্তপ্রায় মশলা
প্রাচীন রোমান সভ্যতায় এককালে বেশ আধিপত্য বিস্তার করা একটি বিলুপ্তপ্রায় মশলা সিলফিয়াম। শুনলে অবাক হবেন, এই মশলাটি আজ বিলুপ্ত হলেও এককালে ব্যবহৃত হতো দেদারসে, বিশেষ করে উচ্চশ্রেণীয় ও উচ্চবংশীয় রোমানদের বহুল ব্যবহারের কারণেই তৎকালীন অর্থনৈতিক মন্দাভাব আনতে দেয়নি এই সিলফিয়াম। তরকারিতে মশলা হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়াও সুগন্ধিদ্রব্য হিসেবে এর ছিল বেশ সুনাম। তাছাড়াও গর্ভনিরোধক হিসেবে সিলফিয়ামের নির্যাস গ্রহণ করতেন গ্রিক ও রোমান নারীরা। পৌরাণিক কাহিনীমতে, গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর সন্তুষ্টির পুরষ্কারস্বরূপ তিনি পৃথিবীতে এই ফুল পাঠান। সিলফিয়ামের বিলুপ্তির সঠিক কারণ জানা না গেলেও নৃতত্ত্ববিদরা এটুকু ধারণা করেছেন যে, এর বিলুপ্তির মূলে রয়েছে অতিরিক্ত গবাদি পশুর চারণ এবং একইসাথে অনুর্বর জমিতে এর ঘন ঘন চাষের প্রচেষ্টা।
শেষ কথা
পরিশেষে এটুকুই বলতে হয় যে, বর্তমান যুগে মশলার আধিপত্য প্রাচীন যুগের চেয়ে কম নয়। বরং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষবলে প্রতিনিয়তই আবিষ্কৃত হচ্ছে বিভিন্ন মশলার গুণাগুণ ও উপকারী সব তথ্য। দুঃখের বিষয়, বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাবে কালের আবর্তে আমরা হারাতে বসেছি বেশ কিছু উপকারী মশলা ও ভেষজ উপাদান। তবে আশা করা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার মতো পুরো বিশ্বে মশলার গুণাগুণ নিয়ে আরো অনেক গবেষণা চালাবেন বিজ্ঞানীরা।