১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করার মধ্যে দিয়ে সূচনা ঘটে মোঘল সাম্রাজ্যের। তারপর তিনশ বছরের শাসনামলে তারা ভারতীয় উপমহাদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন নানা স্থাপত্যে। মোঘল স্থাপত্যের প্রথম বিকাশ ঘটে সম্রাট আকবরের আমলে। তবে তা পূর্ণতা লাভ করে ‘প্রিন্স অব বিল্ডার্স’ খ্যাত শাহজাহানের আমলে। তাদের একেকটি স্থাপত্য ছিল ক্ষমতার একেকটি উৎস। স্থাপত্যগুলোর অনির্বচনীয় সৌন্দর্য, আভিজাত্য ও আশ্চর্য শৈল্পিকতা এক মহান সাম্রাজ্যের সাথে এগুলোর সম্পর্কেই প্রকাশ করে।
মোঘল স্থাপত্যেশৈলীতে পারসিক, তুর্কি ও ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। পারস্য, আফগান, মধ্য এশিয়ার স্থপতিরা তাদের প্রতিভার সবটুকুই ঢেলে দিয়েছেন যেন স্থাপত্যগুলো নির্মাণে। বিশালাকার গম্বুজ, সরু মিনার, সুসজ্জিত প্রবেশপথ, সূক্ষ্ম কারুকাজ এসব স্থাপত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ষোল-সতের শতকের এই স্থাপত্যগুলো অসংখ্য কবি সাহিত্যিকের সৃষ্টিতে অণুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আজও ভারতের বুকে মোঘল আমলের সেই রাজকীয় প্রাসাদ ও সমাধিসৌধগুলো বর্তমান। আজকের আলোচনায় থাকছে ভারতের সেরা কিছু মোঘল স্থাপত্যের কথা।
তাজমহল
যমুনার পূর্ব তীরে অবস্থিত সমাধিসৌধ তাজমহল সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত ও পরিচিত মোঘল স্থাপত্য। কবির ভাষায় “কালের কপোলে একবিন্দু জল”। মানবীয় প্রেমকে অনুভূতির গন্ডি ছাড়িয়ে চিরঅম্লান এক অবয়বে রুপ দেয়ার সফল প্রচেষ্টা তাজমহল। শ্বেতমর্মর পাথরে খোদিত এক কাব্য যেন এই সৌধটি। ১৬৩২ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিশ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে নির্মিত হয় সৌধটি। উস্তাদ আহমেদ লাহিরি ছিলেন তাজমহলের প্রধান স্থপতি। প্রবেশপথ, বাগান, মসজিদ, জাওয়াব আর সমাধিসৌধ নিয়ে গঠিত তাজমহল।
মাঝখানে চৌকো বেদীর উপর স্থাপিত শ্বেতমর্মর পাথরে তৈরি মূল সমাধিসৌধটি। সমাধির মাথায় সুউচ্চ গম্বুজটি ২৪০ মিটার উঁচু। কেন্দ্রীয় ভবন থেকে দূরে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে চারটি মিনার। বাগানের দুই কোণে মূল ভবনের সাথে একই অক্ষে নির্মিত দুটি স্থাপনা- মসজিদ ও জাওয়াব। বাগানটি অন্যান্য মোঘল বাগানের মতোই। পানির উৎস দ্বারা চার ভাগে বিভক্ত। সমাধির দক্ষিণে লাল পাথরে তৈরি দোতলা সমান উঁচু প্রশস্ত প্রবেশপথ। তাজমহলের অনবদ্য হওয়ার কারণ এর নিখুঁত প্রতিসাম্য। এছাড়া কালার কনট্রাস্ট্র, আলোক বিভ্রম প্রভৃতি উপাদানের সার্থক প্রয়োগ একে অনন্য করেছে। তাজমহল এর মার্বেল পাথরে মোড়া বহির্ভাগের জন্য বিশ্বনন্দিত হলেও এর অভ্যন্তীরণ সজ্জার সৌন্দর্যের কথা না বললে অবিচার করা হবে। ভেতরে রয়েছে ক্যালিগ্রাফি ও পিয়েত্রা দুরার অসাধারণ কারুকাজ। নানারকম পাথরের জ্যামিতিক ও ফুলেল নকশা ।
তাজমহল ক্ষণে ক্ষণে রঙ পরিবর্তনের জন্য বিখ্যাত। সূর্যোদয়ের পর গোলাপি, দুপুরে সাদা, সন্ধ্যায় সোনালি। জোৎস্নোবিধৌত রজনীতে সবচেয়ে মোহনীয়। তাজমহলের পথে অলসপায়ে হাঁটার সময়, জলাধারে বিম্বিত সমাধিসোধের ছবি দেখার সময় আপনি হয়তো উপলব্ধি করতে পারবেন শাহজাহানের প্রেমকে।
লাল কেল্লা
মোঘল সাম্রাজ্যের আভিজাত্য গায়ে জড়িয়ে তিনশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে লাল কেল্লা। মোঘল সম্রাট শাহজাহান আগ্রা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এজন্য যমুনা নদীর তীরে একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৩২ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়া এই প্রাসাদের নাম দেন তিনি ‘কিল্লা-ই-মুবারক’। ২৫৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই স্থাপত্যে মিশেল ঘটেছে পারস্য, হিন্দু ও ইসলামী স্থাপত্যরীতির। দুর্গের দীর্ঘ দেয়াল লাল পাথরে তৈরি। দুর্গের কিছু অংশেও লাল রঙের বেলেপাথরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
অবশিষ্ট অংশে ব্যবহৃত হয়েছে মার্বেল। লাল দেয়ালই এর সৌন্দর্যের সবটুকু নয়, ভেতরে প্রাসাদ, জাদুঘর ও অন্যান্য দর্শনীয় জিনিস আছে। লালকেল্লার সাজসজ্জায় আভিজাত্য নিয়ে এসেছিল ময়ুর সিংহাসন ও কোহিনুর। দুটি প্রবেশপথ কেল্লার- দিল্লি গেট ও লাহোর গেট। কেল্লার ভেতরে রয়েছে দিওয়ান-ই-আম নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। এখানে দাঁড়িয়ে সম্রাট জনসাধারণের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। এখান থেকে নহবতখানা দেখা যায়। নানা উপলক্ষে এখানে আয়োজিত হত নাচ-গানের আসর। দিওয়ান-ই-খাসে ছিল ময়ুর সিংহাসন।
সর্বদক্ষিণের প্যাভিলিয়নগুলো হেরেম- রঙমহল ও মমতাজ মহল। মমতাজ মহল এখন মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে মোঘল আমলের নানা নিদর্শন- কার্পেট, পর্দা, তলোয়ার প্রভৃতি প্রদর্শিত হয়েছে। লালকেল্লা ছিল মোঘল সম্রাটদের রাজকীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্র। মোঘলদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষের প্রতীক। এখনও ভারতের রাজনীতিতে লালকেল্লার ভূমিকা আছে। প্রতিবছর ভারতের স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন করা হয় লাল কেল্লায়। শাহাজাহানের পর আরো দু’শো বছর এটি মোঘল সম্রাটদের বাসস্থান ছিল। দিল্লির রোদ ঝলমলে আকাশের পটভূমিতে দুর্ভেদ্য লালকেল্লা মোঘলদের শক্তিমত্তাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ফতেহপুর সিক্রি
আগ্রা থেকে ৩৭ কি.মি. দূরে অবস্থিত লাল বেলেপাথরে নির্মিত শহর এটি। আকবর একবার সিক্রিতে আসেন সেলিম চিশতির সাথে দেখা করতে। সেলিম চিশতি তখন মোঘল রাজপরিবারে একজন উত্তরাধিকার আগমনের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। সেটা সত্যি হলে আকবর এখানে রাজধানী নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। আকবরের সহনশীল ধর্মীয় চেতনা ও সাহিত্যে আগ্রহের প্রতিফলন ঘটেছে এর স্থাপত্যে।
ফতেহপুর সিক্রিতে হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। ১১ কি.মি. দেয়াল ঘেরা এই শহরে অসংখ্য প্রবেশপথ রয়েছে। রাজপ্রাসাদের শুরুতেই রয়েছে দিওয়ান-ই আম। চারকোণা চত্বর ঘিরে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু আশ্রম। ডানদিকে একটি দোতলা ভবনে দিওয়ান-ই-খাস। দিওয়ান-ই-খাসের বামে ট্রেজারি। এখানে খেলাধুলার আয়োজন হতো। বামের কোণে সম্রাটের ব্যক্তিগত প্রাসাদ দৌলত-খানা-ই-খাস। প্রাসাদের নিচতলায় দুটি প্রধান কক্ষ। একটিতে আকবরের বিশাল লাইব্রেরি ছিল।
শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাসাদ ছিল সম্রাটের রাজপুত স্ত্রী জোধা বাইয়ের প্রাসাদ। শহরে জামে মসজিদও রয়েছে। জ্যামিতিক আকৃতির মসজিদের পাশেই হাওয়া মহল। মসজিদের দক্ষিণে অবস্থিত দেয়ালে ৫৫ মিটার উঁচু প্রবেশপথ ‘বুলন্দ দরওয়াজা’। ১৩ মিটার উঁচু সিঁড়ি এর আভিজাত্য বাড়িয়েছে। শহরের বাতাসে যেন অদ্ভুত এক রহস্যময়তা মিশে আছে। পরিত্যক্ত এই মোঘল রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ পর্যটকদের আগ্রহের জায়গা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় লাল আকাশের পটভূমিতে গম্বুজগুলোর রহস্যময় ছায়া বহু শিল্পীর অনুপ্রেরণা বা পর্যটকের বিস্ময়মাখা চাহনির উৎস।
হুমায়ুনের সমাধি
দ্বিতীয় মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের স্মৃতিকে জীবন্ত রাখতে নির্মিত হয় এই দৃষ্টিনন্দন সমাধিসৌধটি। হুমায়ুনের সৌধকে বলা যায় প্রথম পরিপূর্ণ মোঘল স্থাপত্য। হুমায়ুনের মৃত্যুর নয় বছর পর ১৫৬৫ সালে এটি নির্মিত হয়। নির্মাণ করেন হুমায়ুনের বিধবা স্ত্রী বেগা বেগম। পার্সিয়ান, তুর্কি ও ভারতীয় স্থাপত্যরীতির মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায় সৌধটিতে।
বিশাল বাগানের বাগানের কেন্দ্রে স্থাপিত হয় সমাধিসৌধ। কেন্দ্রীয় ভবনটি বেলেপাথরে তৈরি প্রতিসম একটি ভবন। ভবনের মাথায় দুটি গম্বুজ। প্রবেশমুখে দোতলা সমান উঁচু প্রবেশপথ। সমাধি কমপ্লেক্সে আছে সমাধি, মসজিদ ও বসবাসের জন্য আলাদা ভবন।
আগ্রা দুর্গ
তাজমহল থেকে ২.৫ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত দেয়ালঘেরা শহর আগ্রা দুর্গ। দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের আগপর্যন্ত এটাই ছিল মোঘলদের প্রধান বাসস্থান। দুর্গটি মূলত ছিল ইব্রাহিম লোদির। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয়ের পর বাবর এই দুর্গে বসবাস শুরু করেন। ১৫৩০ সালে তার ছেলে হুমায়ুনের অভিষেক হয় এই দুর্গে। শের শাহ সুরির কাছে হুমায়ুন পরাজিত হবার পর দুর্গটি সুরি সাম্রাজ্যের হস্তগত হয়। ১৫৫০ সালে হুমায়ুন এটি পুনরুদ্ধার করেন।
আকবরের রাজধানীও প্রথমে ছিল আগ্রায়, এই দুর্গকেন্দ্রিক। আকবর লাল বেলেপাথর দিয়ে দুর্গটি পুনর্নির্মাণ করেন। তবে দুর্গটি বর্তমান চেহারাপ্রাপ্ত হয়েছে শাহজাহানের আমলে। শাহজাহান জীবনের শেষ সময়ে অবশ্য এই দুর্গে বন্দী ছিলেন। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে জিতে আহমাদ শাহ দুররানি মারাঠাদের কাছ থেকে এটি দখল করেন। পরে মারাঠারা আবার দুর্গ পুর্নদখল করে। কিন্তু আঠার শতকে ব্রিটিশদের কাছে আবার দুর্গ হারায় মারাঠারা। সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই দুর্গে যুদ্ধ হয়। খাস মহল, দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই-খাস, মোতি মসজিদের মতো বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর স্থাপনা আছে দুর্গ-প্রাচীরের অভ্যন্তরে।
দিল্লি জামে মসজিদ
ভারতের অন্যতম বৃহত্তম এই মসজিদটি মোঘলদের ধর্মানুরাগের প্রতিনিধিত্ব করে। পুরোনো দিল্লিতে অবস্থিত এই মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৬৪৪ সালে। পাঁচ হাজার শ্রমিকের পরিশ্রমের ফসল এটি।
শাহজাহানের আমলে মোঘল স্থাপত্যেশৈলীর যে চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই মসজিদটি। মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রার্থনাকক্ষ পঁচিশ হাজর মুসল্লী ধারণ করতে পারে। চারপাশে চারটি সরু মিনার আকাশ ছুঁয়েছে। প্রার্থনাকক্ষের মাথায় তিনটি সাদা গম্বুজ। মসজিদের সামনে রয়েছে ধনুকাকৃতির ফটক ও প্রশস্ত সিঁড়ি।
বিবি কা মাকবারা
আওরঙ্গবাদ শহরে অবস্থিত মোঘলদের স্থাপিত ভালোবাসার আরেক নিদর্শন বিবি কা মাকবারা। গঠনগতভাবে অন্য নিদর্শন তাজমহলের সাথে মিল আছে এর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুটো স্থাপনাই দুজন নারীর স্মরণে নির্মিত এবং দুজন নারীই শেষ প্রতাপশালী মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে সম্পর্কিত। তাজমহল নির্মিত হয় তার মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আর বিবি কা মাকবারা তার স্ত্রীর জন্য।
আওরঙ্গজেব প্রথম তার স্ত্রী দিরিলিস বেগমের (রাবেয়া দুররানি) স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে এই সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন। দিরিলিস বেগম ছিলেন পারস্যের সাফবী রাজবংশের রাজকন্যা। তিনি পঞ্চম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তার মৃত্যুতে বিরহকাতর সম্রাট সমাধিসৌধ বানানোর কথা ভাবেন। অন্যান্য মোঘল সমাধিসৌধের মতো এরও আছে চারবাগ রীতির বাগান। মূল ভবনের উপরের সাদা গম্বুজটি ফুলেল নকশায় সজ্জিত। দেয়ালজুড়ে রয়েছে নিখুঁত প্লাস্টার ও স্টাকোর সজ্জা। পশ্চিমে রয়েছে মসজিদ আর দক্ষিণে প্রবেশপথ।
আকবরের সমাধি
প্রভাবশালী মোঘল সম্রাট আকবরের সমাধি অবস্থিত আগ্রার উপকন্ঠে। তিনি জীবিত থাকাকালেই তার সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন, ১৬০৫-১৮ সালে । তার ছেলে জাহাঙ্গীর পরে সাদা ও লাল মার্বেল পাথরের আবরণী যোগ করেন।
দেয়ালঘেরা বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সমাধিসৌধটি। প্রত্যেক দেয়ালে আছে একটি করে প্রবেশপথ। তিনতলা পিরামিডের আকৃতিতে গড়ে তোলা হয়েছে মূল ভবনটি। গম্বুজের অনুপস্থিতি থাকলেও অন্যান্য উপাদান বলে দেয় ভবনটি ইসলামী স্থাপত্যরীতির।