হ্রদটির দৃশ্য সত্যিই অত্যন্ত চমৎকার। হ্রদটির আশেপাশে যে অঞ্চলগুলো রয়েছে, সেগুলোও অত্যন্ত মনোরম। আপনি যদি সেখানে সপরিবারে ছুটির দিন কাটাতে যান, খরচ পড়বে খুবই কম। কিন্তু একটি ছোট্ট সমস্যা রয়েছে। যদি হ্রদটির কাছাকাছি এক ঘণ্টার বেশি সময় কাটান, তাহলে মৃত্যু অবধারিত বলেই ধরে নেয়া যায়।
না, হ্রদ থেকে কোনো রূপকথার কোনো জলদানব উঠে এসে আপনাকে হ্রদের গহীনে টেনে নিয়ে যাবে না। কিংবা হ্রদটিতে মাংসাশী পিরানহা মাছও নেই, যারা আপনাকে ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু এসব কিছু না থাকা সত্ত্বেও হ্রদটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিজ্ঞানীরা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হ্রদটির নাম হচ্ছে– কারাচাই হ্রদ (Озеро Карачай)।
কিপচাক বা উত্তর–পশ্চিম তুর্কি ভাষাগুলোতে ‘কারাচাই’ শব্দটির অর্থ ‘কালো পানি’। অবশ্য কারাচাই হ্রদটির পানির বর্ণ প্রকৃতপক্ষে কালো ছিল না। হ্রদটি বর্তমান রুশ ফেডারেশনের উরাল পর্বতমালা অঞ্চলে অবস্থিত চেলিয়াবিনস্ক প্রদেশের অন্তর্গত ওজিয়োরস্ক শহরের নিকটে অবস্থিত। পূর্ব রাশিয়ায় অবস্থিত ক্ষুদ্র এই হ্রদটি থেকে অনতিদূরে কাজাখস্তানের সীমান্ত রয়েছে।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে হ্রদটি রুশ ভূগোলবিশারদদের কাছে পরিচিত ছিল। এ সময় মাঝে মাঝেই হ্রদটিতে পানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিত এবং এর ফলে হ্রদটি প্রায়ই শুকিয়ে যেত। এজন্য প্রায়শই মানচিত্রে এর উল্লেখ থাকতো না।
১৯৪৫ সালের আগস্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওপরে দুইটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে এবং এর ফলে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুইটি ধ্বংস হয়ে যায়। প্রত্যুত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিজস্ব পারমাণবিক বোমা প্রকল্প শুরু করে। পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের জন্য সোভিয়েত স্পাইমাস্টার লাভ্রেন্তি বেরিয়ার তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যে এবং দ্রুতগতিতে ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে ওজিয়োরস্ক শহরে ‘মায়াক’ প্লুটোনিয়াম উৎপাদন কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়। এটি বর্তমানে ‘মায়াক উৎপাদন সংস্থা’ (Производственное объединение «Маяк») নামে পরিচিত।
মায়াক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তম পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর একটি। এটির অবস্থানের কারণে ওজিয়োরস্ক শহরটিকে সোভিয়েত সরকার একটি নিষিদ্ধ বা ‘আবদ্ধ নগরী’ (closed city) হিসেবে ঘোষণা করে। এটিকে ‘চেলিয়াবিনস্ক–৪০’ সাংকেতিক নাম প্রদান করা হয়। শহরটিতে বিদেশিদের প্রবেশ তো নিষিদ্ধ ছিলই, এমনকি শহরটির বাইরে থেকে আসা কোনো সোভিয়েত নাগরিকও বিশেষ অনুমতিপত্র ছাড়া শহরটিতে প্রবেশ করতে পারত না।
১৯৪০–এর দশকের শেষ দিক থেকে মায়াক পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রকৌশলীরা সেখানকার পারমাণবিক চুল্লিকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য নিকটবর্তী কিজিলতাশ হ্রদের পানি ব্যবহার করত এবং এর ফলে শীঘ্রই হ্রদটির পানি দূষিত হয়ে পড়ে। কারাচাই হ্রদটি মায়াক পারমাণবিক কেন্দ্রের অধিকতর নিকটবর্তী হওয়ায় প্রকৌশলীরা সেখানকার পানিই এই কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু হ্রদটি ক্ষুদ্র হওয়ায় সেটির পানির পরিমাণ এই কাজের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না।
এজন্য কারাচাই হ্রদকে মায়াকের প্রকৌশলীরা অন্য একটি কাজে ব্যবহার করে। মায়াক কেন্দ্রের পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণাগার ভর্তি হয়ে গেলে তারা কেন্দ্রটির পারমাণবিক বর্জ্য কারাচাই হ্রদে নিক্ষেপ করতে শুরু করে। হ্রদটিকে তারা ‘ভি–৯ জলাধার’ সাংকেতিক নাম প্রদান করে। কারাচাই হ্রদটি যেহেতু অন্য কোনো জলাশয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না, তাই মায়াকে কর্মরত প্রকৌশলীদের ধারণা ছিল, হ্রদটিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বর্জ্য অনির্দিষ্টকালের জন্য সেখানেই পড়ে থাকবে এবং এর ফলে অন্য কিছুর কোনো ক্ষতি হবে না।
কিন্তু তাদের এই আশা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণিত হয়। বস্তুত এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তীব্র পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোনো মূল্যে তারা পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে চাইছিল। সামরিক নিরাপত্তার প্রতি তাদের সর্বোচ্চ গুরুত্বের কারণে এসব সামরিক প্রকল্পের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে মারাত্মক পরিবেশগত ক্ষতি হতে পারে, এই বিষয়টি অনুধাবন করা ক্রেমলিনের অধিকর্তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর ফলে কারাচাই হ্রদসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান মারাত্মক পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
১৯৫০–এর দশক জুড়ে সোভিয়েত প্রকৌশলীরা কারাচাই হ্রদে পারমাণবিক বর্জ্য নিক্ষেপ অব্যাহত রাখে। ১৯৬০–এর দশকে খরার ফলে হ্রদটির বেশকিছু অংশ স্থায়ীভাবে শুকিয়ে যায়। এর ফলে ১৯৫১ সালে যেখানে হ্রদটির আয়তন ছিল ০.৫ বর্গ কি.মি., ১৯৯৩ সালে সেটি হ্রাস পেয়ে মাত্র ০.১৫ বর্গ কি.মি.তে পরিণত হয়। এর ফলে হ্রদটিতে নিক্ষিপ্ত সিজিয়াম–১৩৭ এবং স্ট্রোন্টিয়াম–৯০ এর মতো তেজষ্ক্রিয় পদার্থ প্রকৃতিতে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
ক্রমাগত পারমাণবিক বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে হ্রদটিতে ৩.৪ মিটার গভীরে যে পরিমাণ পলি জমে আছে, তার পুরোটাই উচ্চমাত্রার তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য। এই বর্জ্য কোনোক্রমে ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ একটি দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিল এবং ১৯৬৭ সালে ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটে। সে বছর প্রবল বাতাসের ফলে হ্রদটির শুষ্ক অংশ থেকে বিপজ্জনক তেজষ্ক্রিয় ধূলি চারপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে আশেপাশের প্রায় ২,৭০০ বর্গ কি.মি. বিস্তৃত অঞ্চলের হাজার হাজার অধিবাসী তেজষ্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী, এর ফলে আশেপাশের অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে ক্যান্সারের হার ২১ শতাংশ, জন্মগত বিকলাঙ্গতার হার ২৫ শতাংশ এবং লিউকেমিয়ার হার ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই ঘটনার পর সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে এবং তারা হ্রদটিকে আবদ্ধ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা হ্রদটি থেকে তেজষ্ক্রিয় পদার্থ আর যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ‘সার্কোফ্যাগাস’ (sarcophagus) বা ‘পাথরের শবাধার’ পদ্ধতি অবলম্বন করে। এর অর্থ হচ্ছে বড় বড় পাথর বা কংক্রিটের টুকরো দিয়ে হ্রদটিকে পূর্ণ করে ফেলা। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে প্রায় ১০,০০০ কংক্রিটের টুকরো দিয়ে হ্রদটিকে ভরাট করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
১৯৯০ সালে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের কারাচাই হ্রদটিকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের অনুমতি প্রদান করা হয়। তারা জানান যে, হ্রদটি থেকে গামা রশ্মি নির্গমনের পরিমাণ প্রায় ৬০০ রন্টজেন। অন্যভাবে বলা যায়, হ্রদটির পানি থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয়তার পরিমাণ প্রায় ১২ কোটি (বা ১২০ মিলিয়ন) কুরি (curie), যা চেরনোবিল থেকে নির্গত তেজষ্ক্রিয়তার প্রায় দ্বিগুণ। পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা জানান যে, কোনো মানুষ এই হ্রদটির পাশে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করলে তেজষ্ক্রিয়তার কারণে তার মৃত্যু নিশ্চিত!
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালে রুশ রাষ্ট্রপতি বোরিস ইয়েলৎসিন একটি অধ্যাদেশ জারি করে ওজিয়োরস্ক শহরটিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করেন এবং এর ফলে কারাচাই হ্রদের দুর্যোগের সম্পর্কে রুশ জনসাধারণ প্রথমবারের মতো বিস্তারিত জানতে পারে। তখনো হ্রদটির তেজষ্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণের কাজ চলছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তখন পর্যন্ত ‘পারমাণবিক বর্জ্য নিষ্কাশন কেন্দ্র’ হিসেবে হ্রদটিকে ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করা হয়নি। অবশেষে ২০০৩ সালে এই অনুমতি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করা হয়।
কারাচাই হ্রদে যে তেজষ্ক্রিয় পদার্থ রয়েছে, সেসব শত শত বছর অক্ষতভাবে সেখানে থাকতে পারে। রুশ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুল পরিমাণ তেজষ্ক্রিয় পদার্থ হ্রদটি থেকে উত্তোলন করে অন্য কোথাও স্থানান্তর করাও অত্যন্ত বিপজ্জনক, এজন্য এই বর্জ্য হ্রদটিতেই রাখা উচিত।
মায়াক উৎপাদন সংস্থার মহাপরিচালকের উপদেষ্টা ইউরি মোর্কভের মতে, রাশিয়াসহ বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রেরই পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। এজন্য হ্রদটির পরিস্থিতি নিয়মিত ও বিস্তৃতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত হ্রদটি থেকে নির্গত গামা রশ্মির পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে; বাতাসে চাপের মাত্রা নিরীক্ষণ করতে হবে; হ্রদটির চারপাশের রেডিওনিউক্লাইডের ঘনত্ব পরীক্ষা করতে হবে এবং বিভিন্ন ঋতুতে হ্রদটির নিচে ভূমির চলমানতা পরীক্ষা করতে হবে। এজন্য নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ অত্যাবশ্যক।
২০০০–এর দশকে হ্রদটিতে কংক্রিট ও বালির নতুন স্তর যোগ করা হয় এবং ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর এই কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়। ভবিষ্যতে অঞ্চলটি ঘাস এবং ঝোঁপঝাড় দিয়ে পূর্ণ করে ফেলা হবে, যাতে হ্রদটিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বর্জ্য চিরতরে মাটির নিচে ঢাকা পড়ে যায়। অবশ্য সেখানে গাছ লাগানো নিষিদ্ধ, কারণ এর ফলে কংক্রিটের ব্লকের ক্ষতি হতে পারে। রুশ বিশেষজ্ঞরা কারাচাই হ্রদের দূষণের ফলাফল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীনে রয়েছে বলেই মনে করেন। তাদের মতে, এখন এমনকি ঘূর্ণিঝড় হলেও আর হ্রদটি থেকে তেজষ্ক্রিয় পদার্থ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে না।
এককালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত স্থান কারাচাই হ্রদের দূষণের ফলাফল হয়তো বর্তমানে সত্যিই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা সৃষ্টি না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কারাচাই হ্রদের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতির উৎপত্তি হতেই থাকবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী রাষ্ট্রগুলোর জন্য পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন এবং টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি।