পৃথিবীতে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেগুলোকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি জায়গা এমনও রয়েছে যেগুলো অনেকটাই উপেক্ষিত। সেগুলোর মধ্যে ২০টি জায়গা নিয়ে চলুন জেনে নিই আজ।
কোকোস আইল্যান্ড, কোস্টা রিকা
কোস্টা রিকার ঠিক উপকূলের শেষ প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরে রয়েছে কোকোস আইল্যান্ড। সেখানেখানে রয়েছে গ্রীষ্মপ্রধান একটি রেইনফরেস্ট। বস্তুত, বন-জঙ্গলের গা ঘেঁষে যাওয়া এটাই একমাত্র আইল্যান্ড, যার গ্রীষ্মপ্রধান রেইনফরেস্ট ব্যতিক্রমী এক আবহ সৃষ্টি করে। চারপাশে ঘিরে থাকা জলে রয়েছে এর চাইতেও বেশি বিস্ময়কর কিছু! এখানকার ডুবুরিদের মতে, জায়গাটি চমৎকার হওয়ার পেছনে কারণ হলো সেখানে থাকা হাঙ্গর, ডলফিন ও রে।
স্টাডেনিকা মনাস্ট্রি, সার্বিয়া
এই মনাস্ট্রি বা আশ্রমটি সার্বিয়ার মনাস্ট্রিগুলোর মধ্যে সবচাইতে সনাতন ও বড়। আশ্রমটি সাদা রঙের মার্বেল পাথরের দুটো গির্জার সমন্বয়ে তৈরি। একটি হলো রাজার, আর অন্যটি কুমারীর গির্জা। স্টাডেনিকা আজও দাঁড়িয়ে আছে মধ্যযুগীয় স্বর্ণ সময়ের সাক্ষী হয়ে। সার্বিয়ার প্রথম রাজার সমাধি রয়েছে এখানে। এর ভেতরে পুরোটাই মনোরম বাইজান্টাইন চিত্রকর্মে ঘেরা।
সেইন্ট কিল্ডা, স্কটল্যান্ড
সেইন্ট কিল্ডার হেব্রিডিস আইল্যান্ডের বহির্ভাগে ১৯৩০ সালেই অধিবাসীরা শেষবারের মতো সেখানে বসবাস করে। কারণ সেই জায়গাটি ছিলো বেশ প্রত্যন্ত এক অঞ্চল এবং মানুষের জন্য সেখানে থাকাটাও ছিলো অনেক দুঃসাধ্য। এখন এই সম্পূর্ণ জায়গাটি সামুদ্রিক পাখির বসবাসের জায়গায় পরিণত হয়েছে। এক কথায় বলা চলে, ইউরোপে সামুদ্রিক পাখিদের বসবাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই জায়গাটি। বর্তমানে সেইন্ট কিল্ডার এই জায়গাটি জাতীয় তহবিলের পক্ষ থেকে কর্মরত কয়েকজন সংরক্ষণকারীর দল ও স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা সুরক্ষিত রয়েছে।
মাযাগান, মরক্কো
ইতিমধ্যেই মরক্কো পর্যটকদের আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। প্রায় সবাই সেখানকার বিখ্যাত কিছু চিত্রকর্মের নাম শুনেছেন। সেই চিত্রকর্মগুলোর কয়েকটি হলো- ম্যারাকেশ, ফেয ও ইসসাউরিয়া। ক্যাসাব্লাঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিমে ৯০ কি.মি. দূরে অবস্থিত মাযাগান জায়গাটি ঐতিহাসিক দিক থেকে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মূলত পর্তুগীজদের হাতেই তৈরি হয়েছিলো মাযাগান। পরবর্তীতে ১৭৬৯ সালে মরক্কোর অধিবাসীদের কাছে জায়গাটি হস্তান্তর করা হয়। আজ মাযাগান এমন একটি জায়গা যাকে পর্তুগাল ও মরক্কোর স্থাপত্যশিল্পের বিশেষ নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়।
লুম্বিনি, নেপাল
নেপালের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এই জায়গাটি গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। বর্তমানে জায়গাটিতে পূর্বনির্মিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে ঘিরে আছে নির্মাণাধীন কিছু মন্দির আর চাষাবাদরত কিছু বাগান। যেহেতু গৌতম বুদ্ধ তার ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত সময় কাটিয়েছিলেন লুম্বিনিতে, সেহেতু ইতিমধ্যেই জায়গাটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। তবে যেহেতু এখানে প্রতি বছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী বা গৌতম বুদ্ধের ভক্তরা এসে জমায়েত হন, সেহেতু এখানে পরিবর্ধনের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে।
তুব্বাতাহা প্রবাল প্রাচীর, ফিলিপাইনস্
একে ডুবুরিদের স্বর্গ বললে ভুল হবে না! তুব্বাতাহা প্রবাল প্রাচীরের জন্য পালওয়ানে পুয়ের্তো প্রিন্সেসা শহরের পশ্চিম-উত্তর পাশ সামুদ্রিক জীবনের পরিপূর্ণতায় ভরে উঠেছে। এখানে আপনি দেখতে পাবেন রঙ-বেরঙের প্রবাল, হ্যামারহেড হাঙ্গর, হকস্বিল ও গ্রিনবিল কচ্ছপ। ভিন্ন এই প্রবাল প্রাচীরটি দেখতে আপনাকে যেতে হবে বাসাবো নৌকাতে করে।
বুখারা, উজবেকিস্তান
রেশমের মতো নিদারুণ মোলায়েম এই শহরটি ২০০০ বছরেরও বেশি পুরানো। এই শহরে এমন অনেক মিনার, স্তম্ভ ও দালান-কোঠা রয়েছে যেগুলোর একেকটিকেই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই সবগুলো একসাথে মিলে যে বিশুদ্ধতা বা অখণ্ডতা রয়েছে তা সত্যিই চমকপ্রদ। তবে এখানকার সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ ও জনপ্রিয় জায়গাটি হলো ইসমাইল সামানির সমাধি, যিনি ছিলেন মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব।
ভলক্যানোস অব কামচাটকা, রাশিয়া
রাশিয়ার উত্তর দিকে কামচাটকা অঞ্চলের আগ্নেয়গিরিগুলোকে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরতম আগ্নেয়গিরির মধ্যে গণনা করা হয়। তবুও খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই এই আগ্নেয়গিরিগুলোর কথা জানে। এর একটি বড় কারণ হতে পারে, এগুলোর কারণে বিশেষ কোনো ধ্বংসাত্মক ঘটনা কখনোই ঘটেনি, যদিও এগুলোর মধ্যে কয়েকটি এখনও কার্যকর অবস্থায় রয়েছে। এই অঞ্চলটি নানান ধরনের বন্যপ্রাণী, যেমন- সামুদ্রিক চিল, সামুদ্রিক ভোঁদড় ও অতিথি বাজপাখি দিয়ে ঘেরা থাকে।
ভ্রেডেফোরট ডোম, সাউথ আফ্রিকা
জোহানেসবার্গের ১২০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমের এই তারকা ক্ষতটি শুধুমাত্র সবচাইতে পুরাতনই নয়, বরং সবচাইতে বড়ও! ২,০২৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে বিশাল এক উল্কা পৃথিবীর বুকে এসে পড়লে ঠিক এই জায়গায় বিশাল এক গর্ত হয়ে যায়। আর এই বিশাল গর্ত পুরো ১৯০ কি.মি. জায়গা জুড়ে রয়েছে। এই গর্ত বহু বছর আগের উল্কা পতনের বিধ্বংসী অবস্থার সাক্ষী হয়ে আছে। পর্যটকরা বেশ আগ্রহ নিয়ে গর্তটির গভীরতা দেখতে আসেন।
ডাইনোসর প্রভিন্সিয়াল পার্ক, কানাডা
আলবার্টায় অবস্থিত এই ব্যাডল্যান্ড পার্কটিতে রয়েছে বিশ্বের সবচাইতে বেশি ডাইনোসরের হাড় ও জীবাশ্ম। এর নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রচণ্ড শীতের সময় জায়গাটি বরফে ঢেকে যায়। বিলুয়া উপবন থেকে জায়গাটি ধীরে ধীরে শুষ্ক, পাথুরে জায়গায় পরিণত হয়। এভাবেই এই জায়গাটি বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন সরীসৃপ সংরক্ষণের সবচাইতে উপযুক্ত জায়গা হয়ে উঠেছে।
আইগাই, গ্রিস
গ্রিস যে প্রাচীন সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দিয়ে ঘেরা, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ নেই! গ্রিসের উত্তরে অবস্থিত এই প্রাচীন শহর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান, কিন্তু অনেকটাই উপেক্ষিত। জায়গাটি মেসিডোনিয়া রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রথম শহর। এই প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক শহরে রয়েছে মোজাইকের অসাধারণ কাজে ঘেরা একটি বিশাল প্রাসাদ। আর রয়েছে বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এক সমাধিস্থল, যেখানে আছে ৩০০ এরও অধিক সমাধি।
রহতাস্ ফোর্ট, পাকিস্তান
১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি এই দুর্গটি পাকিস্তানের উত্তর দিকে ঝেলুম শহরের আশেপাশেই অবস্থিত। দুর্গটি মুসলিম সেনাবাহিনীর স্থাপত্য শিল্পগুলোর মধ্যে প্রথম দিককার নিদর্শন। পুরো দুর্গ ঘিরে আছে ৪ কি.মি. দেয়াল। এত বিশাল দেয়ালের কারণে এই ঐশ্বর্যমন্ডিত দুর্গটির সম্পূর্ণ পরিমাপ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
শিবাম, ইয়েমেন
শিবামের আরেকটি নাম হলো ‘ম্যানহাটন অব ডেজার্ট’। এ জায়গাটি যে শুধু বেমানান তা কিন্তু নয়, বরং বিশাল বড়ও বটে! এখানে রয়েছে দৃঢ় প্রাচীরে ঘেরা বিশাল উঁচু দালানকোঠা। দক্ষিণ আরবীয় মালভূমির মধ্যখানে এই দালানকোঠাগুলো দাঁড়িয়ে আছে বহু পুরানো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি এ দালানগুলো বানানো হয়েছে সম্পূর্ণ সূর্যের আলোয় শুকানো কাদা দিয়ে।
চায়না ড্যানজিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম চায়না
এখানে আসলে বোঝার উপায় নেই যে, পৃথিবীতে আসলেও এতটা সুন্দর জায়গা আছে, নাকি এটি শিল্পীর রঙ তুলিতে আঁকা। এখানকার আবহাওয়া কারণেই গিরিখাত, ঝর্ণা ও গুহাগুলো আজব আকার ধারণ করে। আর এখানকার পাথরগুলোও সেজেছে দারুণ সব রঙে। যেমন- বাদামী, কমলা, গোলাপি ও অ্যাপ্রিকট। রঙিন এসব পাথর ২৪ মিলিয়ন বছর ধরে পড়ে থাকা খনিজ পদার্থ এবং বালি-পাথরের কারণে তৈরি হয়েছে।