দুই সদ্য পরিচিত হওয়া ভদ্রলোক আলাপ করছেন। কথায় কথায় এক ভদ্রলোক জানালেন, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করেছেন।
অপর ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, ‘ও আচ্ছা! রাশিয়ায়?’
প্রথমজন বললেন, ‘না।’
দ্বিতীয়জন বললেন, ‘ও বুঝেছি। সোভিয়েত রাশিয়ায়!’
প্রথমজন বললেন, ‘না, ভাই। আমি পড়াশোনা করেছি সোভিয়েত ইউনিয়নের বাকুতে।’
দ্বিতীয়জন একটু বিভ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘ঐ একই তো হলো!’
আসলে এক্ষেত্রে একটু বিভ্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাদের ইতিহাস বা ভূগোল নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই, তাদের জন্য ‘রাশিয়া’, ‘সোভিয়েত রাশিয়া’, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’– সব একই দেশ। শুধু তাদের জন্য না, বাস্তবে দেখা যায়, অনেক বড় বড় বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত এই তিনটি নামকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু কার্যত এই তিনটি নাম দিয়ে সম্পূর্ণ পৃথক তিনটি রাষ্ট্রকে বুঝায়, এবং এই তিনটিকে এক করে ফেললে অনেক সময় বড় ধরনের বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে। চলুন, এই তিনটি নাম কেন এক নয়, সে প্রসঙ্গে জেনে নেয়া যাক।
বর্তমান রাশিয়ার যে ভূখণ্ড, সেটি অন্তত এক হাজার বছর আগে থেকে ‘রাশিয়া’ নামেই পরিচিত ছিল, এবং সেখানে অবস্থিত প্রাচীন রাষ্ট্রগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘রুশ খাগানাত’ বা ‘কিয়েভান রুশ’ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর আগে দেশটির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়া ছিল না। ১৫৪৭ সালে প্রথম বারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রটির নামকরণ করা হয় রাশিয়া, এবং তখন থেকে সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্রটির আনুষ্ঠানিক নামে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে। এই বিবর্তন লক্ষ্য করলেই রাশিয়ার নাম নিয়ে এই বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, প্রতিটি রাষ্ট্রেরই একটি আনুষ্ঠানিক/অফিসিয়াল/ফরমাল নাম থাকে, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে সেই নামটি ব্যবহার না করে নামটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হয়। যেমন: বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক নাম হচ্ছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ (People’s Republic of Bangladesh)। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আমরা এই পুরো নামটি ব্যবহার না করে সংক্ষেপে ‘বাংলাদেশ’ নামটি ব্যবহার করে থাকি।
অনুরূপভাবে, ১৫৪৭ সাল থেকে রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক নামে নানান পরিবর্তন এসেছে, এবং এই পরিবর্তন থেকেই দেশটির নাম নিয়ে যত বিভ্রান্তির সৃষ্টি। এই বিবর্তনটি নিম্নরূপ:
(১) রুশ জারতন্ত্র: ১৫৪৭ সালের ১৬ জানুয়ারি মস্কোর গ্র্যান্ড প্রিন্স চতুর্থ ইভান (যিনি ইতিহাসে ‘ভয়ঙ্কর ইভান’ বা ‘ইভান দ্য টেরিবল’ নামেই সমধিক পরিচিত) নিজেকে ‘সমগ্র রাশিয়ার জার’ (Tsar of All Russia) ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশটির আনুষ্ঠানিক নাম হয় ‘রুশ জারতন্ত্র’ (Tsardom of Russia)। ১৫৪৭ থেকে ১৭২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২৫ বছর এটিই ছিল দেশটির আনুষ্ঠানিক নাম, কিন্তু এ সময় সংক্ষেপে দেশটিকে ‘রাশিয়া’ নামেই ডাকা হতো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সময়ে রাশিয়ার শাসকদের উপাধি ছিল ‘জার’। রোমান একনায়ক জুলিয়াস সিজারের নাম থেকে ‘জার’ শব্দটির উৎপত্তি। রাশিয়ার শাসকরা নিজেদেরকে বাইজান্টাইন/পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটদের উত্তরসূরী হিসেবে বিবেচনা করতেন, এবং এজন্যই চতুর্থ ইভান এই উপাধি গ্রহণ করেন।
(২) রুশ সাম্রাজ্য: ১৭২১ সালের ২ নভেম্বর রাশিয়ার জার প্রথম পিওতর (যিনি ইতিহাসে ‘মহান পিটার’ বা ‘পিটার দ্য গ্রেট’ হিসেবেই বেশি পরিচিত) নিজেকে ‘সমগ্র রাশিয়ার সম্রাট’ (Emperor of All Russia) ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশটির আনুষ্ঠানিক নাম হয় ‘রুশ সাম্রাজ্য’ (Russian Empire)। ১৭২১ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯৫ বছর এটিই ছিল দেশটির আনুষ্ঠানিক নাম, কিন্তু এই সময়েও দেশটিকে সংক্ষেপে ‘রাশিয়া’ নামেই অভিহিত করা হত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৭২১ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার শাসকদের আনুষ্ঠানিক উপাধি ছিল ‘সম্রাট’ (Emperor)। কিন্তু সাধারণভাবে এই সময়ের শাসকদেরকেও ‘জার’ হিসেবেই অভিহিত করা হয়ে থাকে।
(৩) রুশ প্রজাতন্ত্র: ১৯১৭ সালের ১৫ মার্চ রাশিয়ার তদানীন্তন রাজধানী পেত্রোগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) সংঘটিত একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ রুশ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর মধ্য দিয়ে কার্যত রুশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। ১৯১৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ‘রুশ অস্থায়ী সরকার’ (Russian Provisional Government) নামক একটি সরকার থেকে রাশিয়ার শাসনকার্য পরিচালনা করে। ১৯১৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কার্যত রাশিয়ার কোনো আনুষ্ঠানিক নাম ছিল না।
১৯১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক নামকরণ করা হয় ‘রুশ প্রজাতন্ত্র’ (Russian Republic)। কিন্তু এই নামটি স্থায়ী হয়নি। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এই নামটি কার্যকরী ছিল। উল্লেখ্য, ১৯১৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিকে সংক্ষেপে ‘রাশিয়া’ নামেই ডাকা হতো।
(৪) নামবিহীন সময়: ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ‘রুশ অস্থায়ী সরকার’কে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯১৮ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত দেশটির কোনো আনুষ্ঠানিক নাম ছিল না। এ সময় বিভিন্ন নথিপত্রে বলশেভিকরা তাদের দেশকে ‘রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র’ (Russian Soviet Republic), ‘রুশ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ (Russian Socialist Republic) প্রভৃতি নামে অভিহিত করত, কিন্তু এর কোনোটিই আনুষ্ঠানিক নাম ছিল না। উল্লেখ্য, বলশেভিক সরকার নিজেদেরকে ‘সোভিয়েত সরকার’ নামে অভিহিত করত, এবং সেই অনুসারে এই সময়ে দেশটিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সংক্ষেপে ‘সোভিয়েত রাশিয়া’ বলা হতো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রুশ ভাষায় ‘সোভিয়েত’ শব্দের অর্থ ‘পরিষদ’ বা ‘সভা’। ‘রুশ অস্থায়ী সরকারে’র সংক্ষিপ্ত শাসনামলে রাশিয়া জুড়ে শ্রমিক ও সৈনিকরা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে, এবং এই প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ বা সভাগুলোই ‘সোভিয়েত’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। এই পরিষদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবান ছিল রাজধানী পেত্রোগ্রাদে অবস্থিত ‘পেত্রোগ্রাদ শ্রমিক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত’ (Petrograd Soviet of Workers’ and Soldiers’ Deputies)। বলশেভিকরা ক্রমশ এই সোভিয়েতগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে, এবং পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের বলশেভিক সদস্যরাই ১৯১৭ সালের নভেম্বরের বিপ্লব/অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল। যেহেতু বলশেভিকদের ক্ষমতার উৎস ছিল এই সোভিয়েতগুলো, সেহেতু তারা নিজেদের সরকারকে ‘সোভিয়েত সরকার’ নামে অভিহিত করত।
(৫) রুশ সমাজতান্ত্রিক ফেডারেটিভ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র: ১৯১৮ সালের ১৯ জুলাই সোভিয়েত সরকার দেশটির আনুষ্ঠানিক নামকরণ করে ‘রুশ সমাজতান্ত্রিক ফেডারেটিভ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র’ (Russian Socialist Federative Soviet Republic)। ১৯১৮ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮ বছর এই নাম বহাল ছিল। এ সময়ে সংক্ষেপে রাষ্ট্রটিকে ‘সোভিয়েত রাশিয়া’ নামে অভিহিত করা হতো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯১৭ সালের মার্চে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকেই সাম্রাজ্যের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু–অধ্যুষিত প্রান্তিক অঞ্চলগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে শুরু করে। এজন্য যখন ‘সোভিয়েত রাশিয়া’ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন রাষ্ট্রটির সীমানা ছিল রুশ সাম্রাজ্যের সীমানার চেয়ে ছোট, এবং ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, আজারবাইজানসহ প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চল সোভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
কিন্তু ১৯২২ সালের মধ্যে বলশেভিকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এর ফলে ইউক্রেন, বাইলোরাশিয়া (বর্তমান বেলারুশ), জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ছিল, কিন্তু যেহেতু সোভিয়েত রাশিয়া এবং এই প্রজাতন্ত্রগুলো উভয়েই বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল, সেহেতু তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া ও অন্য বলশেভিক প্রজাতন্ত্রগুলো একটি ফেডারেশনের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর মধ্য দিয়ে স্থাপিত হয় ‘সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রসমূহের ইউনিয়ন’ (Union of Socialist Soviet Republics), যেটি সংক্ষেপে ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ নামে পরিচিতি অর্জন করে।
অর্থাৎ, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ ছিল মূলত বিভিন্ন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি ফেডারেশন, এবং এই ফেডারেশনের একটি সদস্য ছিল ‘সোভিয়েত রাশিয়া’। সোভিয়েত রাশিয়া ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অংশ। পরবর্তীতে ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ ফেডারেশনটিতে মোট ১৫টি প্রজাতন্ত্র ছিল, এবং এগুলোর মধ্যে একটি প্রজাতন্ত্র ছিল ‘সোভিয়েত রাশিয়া’। সামগ্রিকভাবে, সোভিয়েত রাশিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল দুইটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রশাসনিক বিভাগ, কিন্তু সমার্থক নয়।
(৬) রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র: ১৯৩৬ সালের ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন সংবিধান গৃহীত হয়, এবং সংবিধান অনুযায়ী ফেডারেশনের ও ফেডারেশনের অন্তর্গত প্রজাতন্ত্রগুলোর নামে পরিবর্তন আনা হয়। তাদের নামের ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘সোভিয়েত’ শব্দ দুইটিকে একে অপরের সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে ‘রুশ সমাজতান্ত্রিক ফেডারেটিভ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র’ পরিণত হয় ‘রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে’ (Russian Soviet Federative Socialist Republic)। ১৯৩৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৫ বছর এই নামটি বহাল থাকে। অবশ্য এই সময়েও প্রজাতন্ত্রটি সংক্ষেপে ‘সোভিয়েত রাশিয়া’ নামে পরিচিত ছিল।
উল্লেখ্য, একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক নামও পরিবর্তন করা হয়। এটির নাম ‘সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রসমূহের ইউনিয়ন’ থেকে ‘সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের ইউনিয়নে’ (Union of Soviet Socialist Republics) রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু সংক্ষেপে এটি ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ নামেই পরিচিত হতে থাকে।
(৭) রুশ ফেডারেশন: ১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত তিনটি প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত রাশিয়া, সোভিয়েত ইউক্রেন এবং সোভিয়েত বাইলোরাশিয়া একত্র হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া তাদের নাম পরিবর্তন করে, এবং দেশটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘রুশ ফেডারেশন’ (Russian Federation)। এটিই বর্তমানে সংক্ষেপে ‘রাশিয়া’ নামে পরিচিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাকি প্রজাতন্ত্রগুলো আগেই নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল, সুতরাং ২৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
এই হচ্ছে সংক্ষেপে রাশিয়ার নাম পরিবর্তনের ইতিহাস। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া, সোভিয়েত রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন– এই নামগুলোর মধ্যেকার পার্থক্য স্পষ্ট হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই পার্থক্যগুলো সহজেই বোধগম্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ নিয়মিতভাবে এই নামগুলোকে নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে। এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে দুইটি কারণ প্রণিধানযোগ্য।
প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত রাশিয়া আর রাশিয়া– এই তিনটি নামকে সমার্থক হিসেবে পরিচিত করার জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে ইংরেজিভাষী প্রচার মাধ্যম। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইংরেজি ভাষার প্রচারমাধ্যমগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে বুঝানোর জন্য যথেচ্ছভাবে ‘সোভিয়েত রাশিয়া’ ও ‘রাশিয়া’ শব্দদ্বয়কে ব্যবহার করেছে। এর ফলে ইংরেজি মাধ্যম থেকে জ্ঞান অর্জনকারী জনসাধারণের মধ্যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, এই নাম তিনটি দিয়ে কার্যত একই রাষ্ট্রকে বুঝায়। কিন্তু কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, আর সোভিয়েত রাশিয়া ছিল সেই রাষ্ট্রের একটি অংশ। আর রাশিয়া বলতে বুঝানো হয় বলশেভিক বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী রাশিয়াকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরবর্তীতে সময়ের রাশিয়াকে।
এখনো ইংরেজিভাষী প্রচার মাধ্যমে এই তিনটি নামকে এক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, ফলে এই বিভ্রান্তি বজায় থেকেই যাচ্ছে। (এবং বাংলাদেশে যেহেতু আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি সম্পর্কে জানার মূল মাধ্যম ইংরেজি, সেহেতু এখানেও এই বিভ্রান্তি ব্যাপকভাবে প্রচলিত)।
এবং দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাষ্ট্র (successor state) হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এর ফলে বহির্বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের যত সম্পদ ছিল, রাশিয়া সেগুলোর মালিকানা লাভ করেছে। অনুরূপভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত বৈদেশিক ঋণ শোধ করার দায়িত্বও রাশিয়া গ্রহণ করেছে। তদুপরি, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী আসনটিও রাশিয়াকে দেয়া হয়েছে। এজন্য অনেকেই রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে এক মনে করেন। কিন্তু রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের আইনগত উত্তরসূরী হলেও কার্যত তারা দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক রাষ্ট্র।
এজন্য, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বাকুতে পড়াশোনা করেছেন, তিনি সোভিয়েত রাশিয়া বা রাশিয়ায় পড়াশোনা করেছেন, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। কারণ বাকু বর্তমানে রাশিয়ার বাইরে, আর এটি কখনো সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল না, এটি ছিল সোভিয়েত আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত!