বিশ্বের সবগুলো শহরই একটি আরেকটি থেকে একেবারেই আলাদা। কিন্তু কিছু শহর আছে যেগুলোর বাস্তবে উপস্থিতি আশ্চর্য করে দেওয়ার মতো। চলুন জানা যাক সেসব শহরের কথা।
যে শহরে মরে যাওয়া মানা
সাভালবার, লংইয়ারবানের শহরটি পৃথিবীর সবচাইতে উত্তর দিকে অবস্থিত জনবসতিগুলোর মধ্যে একটি। এখানকার সরকারী বা আনুষ্ঠানিক নিয়ম অনুযায়ী, কোনো মানুষের এই শহরে মরে যাওয়া মানা! বিষয়টি আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি। যদিও সেখানে একটি গোরস্থান রয়েছে, তবে বিগত ৭০ বছর ধরে এখানে কাউকে দাফন করা হয় না। এর কারণ হলো, এলাকাটি এতোটাই ঠাণ্ডা যে, তা মৃতদেহগুলোকে নিঃশেষিত হতে বাধা দেয়, যার কারণে মৃতদেহের প্রতি বন্য পশুদের আকর্ষণ বেড়ে যায়। তাই সেখানকার মৃতপ্রায় মানুষদেরকে যত দ্রুত সম্ভব নরওয়ের মূলভূমিতে স্থানান্তর করা হয়।
দুই দেশের এক শহর
বুসেনগেনইয়াম হোকারহেন শহরটি একই সাথে জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডের অংশ। অর্থনৈতিকভাবে জায়গাটি সুইজারল্যান্ডের অংশ এবং প্রশাসনিকভাবে জার্মানির! এটিই জার্মানির একমাত্র শহর, যেখানে সুইস ফ্রাংক প্রধান মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এই শহরটির আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে-
- এর রয়েছে দুটি পোস্ট কোড: একটি সুইজারল্যান্ড ও অন্যটি জার্মানির।
- এই শহরের অধিবাসীরা দুই দেশেরই ফোন নম্বর ব্যবহার করে।
- এফসি বুসেনগেইন হলো জার্মানির একমাত্র দল, যা সুইস চ্যাম্পিয়ানশিপে খেলে।
শহর নাকি নরক!
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে গেলেই পৃথিবীর বুকে দেখা মিলবে নরকের! এই শহরটির নামের উৎপত্তি অনিশ্চিত। নিজেদের শহরের এরকম নারকীয় ভাবমূর্তি সেখানকার বাসিন্দারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বজায় রেখেছেন। সেখানে গিয়ে পর্যটকেরা অধীর আগ্রহে ‘ওয়েলকাম টু হেল’ লেখা বোর্ডের সামনে ছবি তুলে এবং স্থানীয় উপহার সামগ্রীর দোকানগুলো থেকে ৬.৬৬ ডলার দিয়ে একটি ওয়ারেন্টি দলিল কিনে নেয়, যার মাধ্যমে নরকে ১ বর্গ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা নিশ্চিত করে রাখা হয়।
অস্ট্রিয়ার গ্রাম, কিন্তু চীনে অবস্থিত
শহরটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। চীনের লোকেরা অবিকল যেকোনো কিছু বানিয়ে ফেলাতে যে দারুণ পটু, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না! তবে তাই বলে গোটা একটি শহরই বানিয়ে ফেলবে, সেটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও মেনে নিতে হবে। কারণ এই অসাধ্য কাজটিও তারা সাধন করেছে! দেশের গণ্ডি না পেরিয়েই দেশের ভেতরেই তারা গড়ে নিয়েছে অবিকল অস্ট্রিয়ার দৃষ্টিনন্দন গ্রাম হালস্টাট। প্রথমে গির্জাটি তৈরি করা হয়েছিলো এবং তারপর রাস্তা, যা দেখতে অবিকল অস্ট্রিয়ার হালস্টাট গ্রামের মতো। যা-ই হোক, চায়নার হালস্টাটের আবাসনের দরদাম অস্ট্রিয়ার আসল হালস্টাটের আবাসনের চাইতে তুলনামূলকভাবে কম।
দ্য লাস্ট ফ্রি সিটি
স্ল্যাব সিটি নামে ক্যালিফোর্নিয়ার শহরটির বাসিন্দারা মূলত ভবঘুরে, অবসরপ্রাপ্ত এবং সেসব লোকজন, যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সেখানকার বাসিন্দারা ট্রেইলার (এক ধরনের মিনিবাস যেখানে থাকার সুব্যবস্থা আছে) এবং ভালো মানের কুঁড়েঘরে থাকে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, সেখানে কোনো পানি, বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই এবং কোনো বসতিরই নেই কোনো ঠিকানা। কর, শুল্ক এমনকি সার্বজনীন উপযোগিতাও নেই সেখানে। এই সবকিছু শুনে নিশ্চয়ই সেখানে থাকার বিষয়টি আপনার কাছে অসম্ভব এবং কষ্টকর মনে হচ্ছে! কিন্তু সেখানে যারাই গিয়েছে বা থাকে, তাদের কাছে জায়গাটি থাকার জন্য বেশ আরামদায়ক মনে হয়েছে। স্ল্যাবারের বাসিন্দারা তাদের শহরকে বলে থাকে ‘দ্য লাস্ট ফ্রি প্লেস ইন আমেরিকা’।
গুহার শহর
মাতমাতা হলো তিউনিসিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত একটি শহর, যেখানে এখন পর্যন্ত ভূগর্ভে যাযাবর প্রকৃতির মানুষের বসবাস রয়েছে। ১৯৭০ সালের দিকে সেখানে মাটির উপরে বসতবাড়ি তৈরি করা হয়েছিলো। তবে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা ভূগর্ভে থাকা ঐতিহ্যবাহী ঘরগুলোতেই থাকা পছন্দ করে। ‘স্টার ওয়ার্স’ সিনেমাটি দেখে থাকলে এই জায়গাটির সঙ্গে অবশ্য আগে থেকে পরিচিতি থাকার কথা! সেখানে লুক স্কাইওয়াকারের যে বাসাটি দেখানো হয়, সেটিই এই জায়গা।
এক ছাদের নিচেই শহরের গণ্ডি
১৪ তলা বিশিষ্ট একটি ভবনই গোটা একটি শহর! স্বপ্নে নয়, বাস্তবেই আছে এমন আজব এক শহর। আলাস্কায় অবস্থিত এই শহরটির নাম হুইটিআর। একই ছাদের নিচে একটি শহর, তাই এতে কোনো সুবিধা নেই বলে ধারণা করে নিলে ভুল হবে! কারণ ১৪ তলা ভবনের এই শহরে রয়েছে সব ধরনের দোকানপাট, পুলিশ ফাঁড়ি, হাসপাতাল ও গির্জা। এই শহরটি গড়ার পেছনে উদ্দেশ্য ছিলো আর্থিকভাবে একে সচল রাখা। কারণ সেখানকার পরিবেশ প্রায় সারা বছরই বেশ শীতল থাকে। এই শহরে জনসংখ্যা মাত্র ২২০ জন।
নীলাভ শহর
দেয়াল, দরজা এমনকি সিঁড়িও নীল রঙের! নানান শেডের নীলের ছটায় যেন এক অপূর্ব রূপে সাজানো মরক্কোর শেফশেওন শহরটি! পুরো শহরটি এরকম নীল রঙ হওয়ার পেছনে যে মতবাদটি রয়েছে তা হলো, শহরটিকে নীল রঙে সাজিয়েছে সেখানে বসবাসকারী ইহুদীরা। কারণ নীল রঙটি তাদের কাছে পবিত্র! যদিও সেখান থেকে ইহুদীরা অনেক আগে চলে গিয়েছে, তবুও সেই ঐতিহ্য বহাল আছে আজও!
এলিয়েনদের শহর
১৯৪৭ সালে নিউ মেক্সিকোর রসওয়াল শহরের কাছেই একটি ইউএফও (আনআইডেনটিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট) ক্রাশের ঘটনা ঘটে বলে দাবি করা হয়। বিষয়টি আদৌ কী ছিলো, তা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছে আজ অবধি। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে রসওয়াল শহরটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেখানে এলিয়েনের থিমে আয়োজন করা হয়ে থাকে নানা রকম অনুষ্ঠান। এমনকি সেখানকার স্থানীয় ম্যাকডোনাল্ডসের দোকানগুলোও এলিয়েনের ছবি দিয়ে সাজানো থাকে।
সমুদ্রের মাঝে শহর
‘নেফট ডাসলারি’ বা ‘অয়েল রকস্’ হলো আজারবাইজানের একটি বাণিজ্যিক শহর। এই শহরটি উন্মুক্ত সমুদ্রের মাঝে একটি ধাতুর প্ল্যাটফর্মের উপর অবস্থিত। এর নিচে তেলের একটি খনিও রয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, শহরটিতে নেই কোনো বাসিন্দা। সময়ভেদে সেখানে প্রায় দুই হাজারের মতো লোকজন আসে কাজ করার জন্য। সেখানে কয়েক মাস কাজ করে আবার ফিরে যায়।
এক পাথরের শহর
বিশাল আকৃতির আগ্নেয়গিরিজাত শিলা! আর তার নিচেই বিস্তৃত একটি শহর। যেখানে জনসংখ্যা মাত্র তিন হাজার জন। অকল্পনীয় মনে হলেও, বাস্তবেই স্পেনে দেখা মিলবে এমন এক অদ্ভুত শহরের। সেটেনিল ডি লাস বডেগাস নামের এই শহরটি সারা পৃথিবীর পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এই শহরটি তৈরি করা হয়েছে পাহাড়ের নিচ কেটে। মূলত বৈরি আবহাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতেই এমনটি করা হয়েছে! এই শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মাথার উপর আকাশ নয়, দেখতে পাবেন পাথর। মনে হতে পারে যে, পাথরগুলো টপ করে এসে মাথার উপর পরবে, কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী এই পাথরগুলো একইভাবে রয়েছে মাথার উপর।
যে শহরে জীবিত মানুষের চাইতে মৃত মানুষের সংখ্যা বেশি
ক্যালিফোর্নিয়ার কোলমা নামের শহরে রয়েছে মোট ১৭টি সমাধিস্থল! সেখানে প্রতি এক হাজার জন মৃত মানুষের বিপরীতে রয়েছে মাত্র একজন জীবিত মানুষ। এমনটি হওয়ার কারণ হলো যে, এক সময় কর্তৃপক্ষের রায়ে স্যান ফ্রান্সিসকোর সবকয়টি সমাধিস্থল সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। আর সেসব সমাধিস্থলের মৃতদেহগুলোও এখানে নিয়ে যাওয়ার পর পুনরায় দাফন করা হয়। পূর্বে এই শহরটির বাসিন্দা ছিলো সমাধি খননকারী, মালী ও স্মারক প্রস্তুতকারকেরা। তবে পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের দিকে অন্যান্য পেশার লোকজনও সেখানে বসতি গড়ে তোলে। এই শহরের এই সময়ের মূলমন্ত্র হলো- ‘ইট ইজ গ্রেট টু বি অ্যালাইভ ইন কোলমা’!