স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই রয়েছে পৃথিবীর এসব দৃষ্টিনন্দন জায়গা। বিশ্বাস হচ্ছে না তো? চলুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক সেই জায়গাগুলো।
হালস্টাট, অস্ট্রিয়া
পাহাড়ের ঢালুতে নীল রঙের হ্রদ পরিবেষ্টিত অপূর্ব সুন্দর কিছু ঘর বাড়ি রয়েছে, যেখানে ভেসে ওঠে আল্পসের প্রতিচ্ছবি। সেখানে ঠাঁই করে নিয়েছে উজ্জ্বল ও চকচকে কিছু রাজহাঁস। সেখানকার জনসংখ্যা এক হাজারের বেশি হবে না। যেহেতু হালস্টাট অনিন্দ্য আল্পস পর্বত এবং হালস্টাটের সমুদ্র হ্রদের মাঝামাঝি একটি সরু পথ দিয়ে গিয়েছে, তাই এর অবস্থান খুবই অনন্য। ১৯৯৭ সালে এই জায়গাটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড কালচারাল হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সিমিয়ান-লা-রোটান্ড, প্রভিন্স ফ্রান্স
বহুদিন ক্লান্ত থাকার পর লম্বা এক ছুটিতে আরাম আয়েশে কাটাতে চাচ্ছেন? তাহলে এটি হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্যস্থল। নীল আকাশ, ল্যাভেন্ডারের (এক জাতীয় সুগন্ধি গাছ) মাঠ, আল্পস পর্বতমালা, ভূমধ্যসাগরীয় খাবারদাবার, প্রাচীন সব সঙ্গীত নিয়ে আয়োজন করা সামার ফেস্টিভ্যাল এবং প্রভিন্স (ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ইতালির সীমান্তে অবস্থিত এক অঞ্চল) এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আপনাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের রাজ্যে। তবে সেখানকার মূল আকর্ষণ হলো ‘সাশাউ দে এগোল্ট’ নামের দুর্গটি, যা ১২ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিলো। এই দুর্গের ভেতর থাকা দু’কোণা পিরামিড ঘূর্ণন যন্ত্রের নামানুসারে এই শহরটির নামকরণ করা হয়েছে।
রেইনবো ভিলেজ, তাইচাং, তাইওয়ান
তাইওয়ানের তাইচুং শহরের সীমান্তে একটি সামরিক বন্দোবস্ত ছিলো, যা অবশেষে এই শহরের প্রায় সবগুলো আবাসিক স্থান ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিলো। সেখানকার কর্তৃপক্ষ সেই বাড়িগুলো ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও ৮৬ বছর বয়সী এক প্রবীণ সেনাপতি তার ঘর রক্ষা করার জন্য দেয়ালে বিভিন্ন রকম চরিত্র এবং নকশা এঁকে রাখেন। বর্তমান সময়ে এটি তাইওয়ানের সর্বাধিক পর্যটক ভ্রমণের গন্তব্যগুলোর মধ্যে একটি।
মারসাক্সলক, মাল্টা
মারসাক্সলক হলো মাল্টা দ্বীপে অবস্থিত জেলেদের একটি রঙিন গ্রাম। এই বন্দরে কোনো ধরনের ঝড়ঝাপ্টা হয় না। আর তাই পানির খুব কাছাকাছি হলুদ রঙের বেলেপাথর বা বালুশিলা দিয়ে তৈরি করা বাড়িগুলো অনায়াসে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে যাতায়াতের জন্য মাত্র দুটি গলিপথ রয়েছে। একটি হলো গাড়ি এবং অন্যটি পথচারীদের চলাচলের জন্য। মারসাক্সলকের মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। সেখানকার প্রায় সবাই নিজেদের নিকট আত্মীয়-স্বজন, যেমন- পিতা, দাদা-নানাদের মতোই জেলে হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন।
ফ্লোটিং আইল্যান্ডস অব তিতিকাকা, বলিভিয়া, পেরু
পেরু ও বলিভিয়ার সীমান্তে তিতিকাকা হ্রদে উরু নামের এক আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তিতিকাকা হ্রদে অবস্থিত এই জায়গাটি মূলত ৪২টি ভাসমান দ্বীপের ওপর রয়েছে। উরু আদিবাসীরা নিজ হাতে বোনা বেত দিয়েই এই দ্বীপগুলো তৈরি করেছে। সেই একই উপাদান দিয়ে তারা মাছ ধরার জন্য নৌকা বানায়। সভ্যতা থেকে দূরবর্তী হওয়া সত্ত্বেও সেখানে সৌর প্যানেলের দেখা মেলে, যার মাধ্যমে সেখানকার স্থানীয় লোকেরা টেলিভিশন দেখতে পায়।
আলবেরোবেলো, ইতালি
কংক্রিটের কুঁড়েঘর আর সেগুলোর নজরকাড়া নকশার জন্য বিখ্যাত এই জায়গাটি। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে এই স্থানটি জায়গা করে নিয়েছে। সেখানকার গম্বুজাকৃতির আবাসিক বাগানবাড়িগুলো চুনাপাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো শুষ্ক স্থাপত্যের দেয়াল বিশিষ্ট ভবনের অনন্য উদাহরণ। ল্যাটিন শব্দ ‘ট্রুলা’ অর্থাৎ গম্বুজ থেকে এই শহরটির নামকরণ করা হয়েছে।
মনসান্তো, পর্তুগাল
মনসান্তো একটি ছোট পরিসরের আবাসিক এলাকা, যা ‘পর্তুগালের সর্বাধিক পর্তুগিজ গ্রাম’ নামে পরিচিত। স্থানীয় প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী, “কেউ বুঝতেই পারবে না যে, মনসান্তোতে একটি ঘর থেকে পাথর জন্ম নেয় নাকি পাথর থেকে একটি ঘরের জন্ম হয়।” এই স্থানটির পরতে পরতে স্থানীয় স্থাপত্যের অনন্যতা ফুটে ওঠে। পাথর বা নুড়িগুলো কয়েকটি ঘরের দেয়াল এবং ছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশাল গ্রানাইট পাথরের নিচে লাল টালি দিয়ে তৈরি ছাদে লুকানো ছোট্ট ঘর এবং সরু রাস্তাগুলো দেখলে মনে হয় যেন বেশ শক্তি সম্পন্ন মানুষজন পাথর খোদাই করে এগুলো তৈরি করেছে। সেখানে কিছু কিছু গ্রানাইট পাথরের ঘরগুলো নাকি ১৬ শতাব্দীতে তৈরি!
উচিসার, তুর্কি
এই এলাকায় বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। কিন্তু উচিসারের জনবসতি সবচাইতে বেশি। শহরের বাসিন্দাদের অধিকাংশই এই গ্রামে বসবাস করেন। সেখানে রয়েছে বেশ খানিকটা আধুনিকতার ছোঁয়া এবং এটি একটি বিখ্যাত প্রাকৃতিক বিস্ময়। এখনো অনেকে সেখানকার বিখ্যাত পাথরগুলোর ভেতরে বসবাস করতে পছন্দ করে। পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে যে নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায় তার সৌন্দর্য বাস্তবে না দেখলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়! ১৯৮৫ সালে এই জায়গাটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে জায়গা করে নিয়েছে।
লংজি রাইস ট্যারেসেস, চীন
এই ধান ক্ষেতটিকে চীনের অধিবাসীরা তাদের দেশের সবচাইতে সুন্দর প্রাকৃতিক স্থান বলে মনে করে। স্থানীয় লোকেরা এটিকে ‘দ্য ট্যারেসেস অব দ্য ড্রাগনস ব্যাকবোন’ বা ড্রাগনের মেরুদণ্ডের সিঁড়ি বলে থাকে। এটি পিং অ্যান এর সুন্দর একটি রঙিন গ্রামে অবস্থিত। সিঁড়ির মতো করে তৈরি করা এই পুরো ধান ক্ষেতটি তৈরি করতে যেমন সময় লেগেছিলো তেমনি পরিশ্রমও হয়েছিলো প্রচুর! এটি অধিষ্ঠিত করা হয় ১২ শতাব্দী থেকে এবং নির্মাণ করা হয় ১,১০০ মি. উঁচু পাহাড়ের ঢালে। এটি তৈরিতে শ্রমিকদের হাজারো পরিশ্রম ও ঝক্কি পোহাতে হলেও কেউ পিছপা হয়নি। যেহেতু তাদের পরিবার ও সন্তানদের জন্য এর মাধ্যমে উপার্জন করা ছাড়া তাদের অন্য কোনো উপায় খোলা ছিলো না। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই কাজটি করতে হয়েছিলো। এছাড়াও বেঁচে থাকার জন্য পাহাড়ে ঘরবাড়ি তৈরি করেই বসবাসের সুযোগটা তৈরি করে নিতে হতো।
পারিয়াঙ্গন, ইন্দোনেশিয়া
পশ্চিম সুমাত্রার এই গ্রামটির দুর্গের ওপর রয়েছে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মেরাপি। এই আগ্নেয়গিরিটি সেখানকার বৃহত্তম প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে একটি। পারিয়াঙ্গন গ্রামটিকে মিনাংকাবাউদের (পশ্চিম সুমাত্রার আদিবাসী গোষ্ঠী) সবচাইতে প্রাচীন গ্রাম বলে ধারণা করা হয়। তাই সেখানে গিয়ে উৎসুক পর্যটকেরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। এছাড়াও সেখানে দেখা মিলবে ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়ির। সেগুলোর মধ্যে বেত-কঞ্চির দেয়াল দিয়ে তৈরি কিছু কিছু বাড়ি ৩০০ বছর পুরানো। এছাড়াও রয়েছে উনিশ শতকে তৈরি করা সুন্দর একটি মসজিদ।
ফিশিং ভিলেজ সিউয়্যা ভ্যান, ভিয়েতনাম
মাছ ধরার জন্য পুরো একটি গ্রাম বরাদ্দ! আর সেই সুদৃশ্য গ্রামটির নাম সিউয়্যা ভ্যান, যা হা লং উপসাগরে অবস্থিত। ভাসমান মাছ ধরার ব্যতিক্রমধর্মী এই গ্রামটি বিশ্বে যতগুলো মাছ ধরার বড় গ্রাম রয়েছে সেগুলোর মধ্যে একটি। সেখানে শুধুমাত্র নৌকা দিয়েই যাতায়াত করা যায়। যেহেতু এই গ্রামের বাসিন্দা শুধুমাত্র জেলেরাই, তাই দক্ষিণ চীন সাগরের মনোমুগ্ধকর আকর্ষণীয় সবকিছু সেখানে দেখার সুযোগ থাকে। এই গ্রামের সবাই ভেলার তৈরি সুন্দর ঘরগুলোতে থাকে। এছাড়া সেখানে একটি স্কুলও রয়েছে।
বিবুরি, ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ডের এই গ্রামটির অসাধারণ সৌন্দর্যে পর্যটকরা অনুপ্রেরণা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই মূলত বেড়াতে যান। আর এই গ্রামটি বিশেষ করে এ কারণেই বিখ্যাত! প্রায় এক হাজার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এই গ্রামটি। সেখানকার প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প, মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি ও শহরের কোলাহল, যানজট ও গাড়ি-ঘোড়ামুক্ত পরিবেশ আপনার মনে হবে যেন ১১ শতকের একটি আবহ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ‘স্টারডাস্ট’ সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ করা হয়েছিলো। বিশ্বনন্দিত কাল্পনিক চরিত্র মিস মার্পেলের সিনেমাগুলোর চিত্রও সেখানেই ধারণ করা হয়েছিলো।
ফিচার ইমেজ: houstoniamag.com