Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শিলিংয়ের পাথুরে বন: যে বনে রয়েছে সবুজের পরিবর্তে পাথর

চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ইউনান প্রদেশের রাজধানী শহরটির নাম কুনমিং। কুনমিং শহরটিতে শীত বা গ্রীষ্ম কোনোটিই  খুব তীব্রভাবে পড়ে না বলে একে চির বসন্তের শহরও বলা হয়ে থাকে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬,২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত শহরটি আজ হতে প্রায় ২,৪০০ বছরের পুরনো। এই কুনমিং শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শিলিং শহরে রয়েছে প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়, যার নাম ‘স্টোন ফরেস্ট’ বা ‘পাথুরে বন’। বন বলা হলেও এতে কিন্তু সবুজের আধিক্য তেমন নেই। সেই স্থান দখল করে রয়েছে বিশাল বিশাল গগনচুম্বী পাথর।

দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা পাথুরে বনের একটি দৃশ্য; Source: 4hdwallpapers.com

প্রকৃতির আপন খেয়ালে তৈরি হয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যের এই পাথুরে বন। বনটি প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে। বনটিতে বিভিন্ন উচ্চতার ও বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য পাথর মাথা উঁচু করে বৃক্ষের স্তম্ভের আদলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাথরগুলোর অবস্থানের ক্ষেত্রেও বেশ বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। কিছু পাথর আছে চ্যাপ্টা, কিছু গোল, কিছু আবার পশুপাখি বা মানুষের অবয়বের সাথে অনেকটাই মিলে যায়।

হাতি আকৃতির পাথুরে বনের একটি বিশাল আকৃতির পাথর; Source: cookingintongues.com

স্টোন ফরেস্ট’ বা পাথুরে বন মূলত সাতটি অঞ্চল নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই সাতটি অঞ্চল হলো লিজিজিং স্টোন ফরেস্ট, নাইগু স্টোন ফরেস্ট, ঝিয়ুন গুহা, চ্যাং হ্রদ, ইউ হ্রদ, ডাডি জলপ্রপাত ও কিফেং গুহা। ২০০৭ সালে ইউনেস্কো এই বনের দুটি অংশ ‘নাইগু স্টোন ফরেস্ট’ এবং ‘সুজেগি ভিলেজ’-কে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ইউনেস্কোর কাছ থেকে এই স্বীকৃতি স্টোন ফরেস্টের নাম চারদিকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। সেই থেকে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের জন্যে অন্যতম এক আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে চীনের এই পাথুরে বন।

চীনের শিলিংয়ে পাথুরে বন দেখতে বহু পর্যটকের ভিড়; Source: travelblog.gabrielaaufreisen.de

এই বনের উৎপত্তি নিয়ে অনেক ধরনের গবেষণা হয়ে আসছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বছরে আগে এই বনটির জন্ম হয়। ভাবতে নিশ্চয়ই অবাক লাগছে, এতো বছর আগে কীভাবে এই বনের সৃষ্টি হতে পারে। এই বনটির আবিষ্কার নিয়ে স্থানীয়ভাবে বেশ কাল্পনিক একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে, যা স্থানীয়রা খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে থাকেন। প্রচলিত গল্পটি তৈরি হয়েছে স্থানীয় এক মেয়েকে নিয়ে। অনেক বছর আগে এই অঞ্চলে আশিমা নামে এক সুন্দরী মেয়ে বাস করতো। মেয়েটি ছিল ‘সানি’ বা ‘উই’ আদিবাসী সম্প্রদায়ের। তার সৌন্দর্যে গ্রামের সকলেই ছিল মুগ্ধ। গ্রামের লোকেরা আশিমার জন্যে একধরনের গর্ববোধ করতো।

আশিমা একদিন ঘুরতে বের হয় পাশের রাজ্যে। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় সে রাজ্যের এক যুবকের সাথে। যুবকটির আচার ব্যবহার আশিমাকে খুব মুগ্ধ করে। এরপর কিছুদিন তারা নিয়মিত দেখা করতে থাকে। ধীরে ধীরে তারা প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যুবকটি একদিন আশিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এই  অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবে আশিমার কাছে যেন পৃথিবীর সকল সুখ একসাথে ধরা দেয়। কিন্তু তখনো আশিমার জানা ছিল না বিধাতার তার জন্য অন্য কিছু চিন্তা করে রেখেছেন।

পাথুরে বনের স্মৃতিফলক; Source: thewanderingjuan.net

আশিমা যখন তাদের প্রেমের কথা তার পরিবারের কাছে বলে তখনই ঘটে বিপত্তি। তাদের প্রেমের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান আশিমার বাবা। তারা কোনোভাবেই মেয়েকে অন্য রাজ্যের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয় না। মেয়ের বাবা-মা এবং গ্রামের প্রতিবেশীরা নানাভাবে মেয়েকে বোঝাতে লাগল ছেলেটিকে ভুলে যেতে। কিন্তু আশিমা কিছুতেই তার মনের মানুষটির কথা  ভুলতে পারে না।

ছেলেটির সাথে দেখা না করার জন্যে সব সময় চোখে চোখে রাখা হতো আশিমাকে। আশিমা কল্পনাও করতে পারেনি তার সাথে এমনটা হতে পারে। আপনজনের কাছ থেকে এমন কষ্ট পেয়ে সারাদিন ধরে শুধু কাঁদতে থাকত আশিমা। এদিকে তার প্রেমিকের সাথে দেখা করারো কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না আশিমা। ধীরে ধীরে নিজের জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকে সে। তার প্রেমিককেই যে সে মনে মনে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিল। অন্য কাউকে সে ঐ স্থান কোনোভাবেই দিতে পারবে না। তাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না আশিমা। সৃষ্টিকর্তার কাছে তখন তার দিন-রাত একটাই চাওয়া- তার শরীরকে যেন একটি প্রাণহীন পাথরে পরিণত করে দেয়া হয়। একটা সময় সৃষ্টিকর্তা আশিমার বুকভরা ক্রন্দনরত প্রার্থনা গ্রহণ করা নেন। কাঁদতে কাঁদতেই আশিমা একসময় পাথর হয়ে যায়। তবে সে-ই কেবল পাথর হয়ে যায়নি। তার পাশে পাশে গড়ে উঠতে থাকে হাজার পাথরের সারি, যেন ক্রন্দনরত আশিমাকে বলছে, তুমি একা নও আশিমা, আমরাও আছি তোমার সাথে।

শিলিং পাথুরে বনের আশিমা পাথর; Source: blackeagleflights.blogspot.com

গল্পটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও মজার ব্যাপার হলো পাথুরে এই বনে এখনো আশিমার নামে একটি উঁচু পাথরস্তম্ভ চোখে পড়ে। কিছুটা দূর থেকে পাথর স্তম্ভটি হঠাৎ দেখলে মনে হবে একজন তরুণী মাথায় রুমাল পেঁচিয়ে পিঠে বাঁশের ঝুড়ি নিয়ে লম্বালম্বিভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেক বছর ২৪ জুন ‘উই’ সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা আশিমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একধরনের আলোর উৎসবের আয়োজন করে। উৎসবটি স্থানীয়ভাবে টর্চ বা আলোক উৎসব নামে পরিচিত। বিভিন্ন ধরনের লোক নৃত্য, কুস্তি প্রতিযোগিতা, ষাঁড়ের যুদ্ধ, পুতুল নাচ, সিংহ নাচ ইত্যাদি এই উৎসবের মূল আকর্ষণ।

তবে বিজ্ঞানীরা আঞ্চলিক এই কথিত গল্পের কোনো ভিত্তি খুঁজে পাননি। স্বাভাবিকভাবেই পাথুরে বনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি তার কাল্পনিক গল্প থেকে অনেকটাই ভিন্ন। ধারণা করা হয়, কোটি কোটি বছর আগে শিলিংয়ের এই অঞ্চলে ছিল মস্ত বড় এক সাগর। সেই সাগরের নিচে ধীরে ধীরে অনেক চুনাপাথর জমতে থাকে। সময়ের অববাহিকায় চুনাপাথরগুলো বড় হতে হতে একসময় উঁচু হতে থাকে এবং একসময় পাথুরে বনের সৃষ্টি করে। আকার আকৃতিতে পাথরগুলো মোটেও দেখতে একই রকম নয়। কিছু কিছু পাথর কয়েক মিটারের হলেও অনেক পাথর আছে লম্বায় প্রায় ৪০ মিটার পর্যন্ত উঁচু।

চুনাপাথরের সারি আকার আকৃতিতে বেড়ে উঠে পাথুরে বনের সৃষ্টি; Source: stoneforest.com

বনটি দেখতে ধূসর মনে হলেও যখন বৃষ্টি হয়ে পাথরের শরীর ভিজে যায়, তখন পুরো বনে এক কালচে খয়েরী রঙের আভা ছড়িয়ে যায়। তখন বনটির সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সুন্দরের পাশাপাশি এখানকার একেকটি পাথরে ছড়িয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। বনটির চারপাশ ঘুরিয়ে দেখানোর জন্যে পর্যটকদের জন্য আছে আধুনিক বৈদ্যুতিক ট্রেনের সুবিধা। তবে চাইলে পাথরগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘোরা যায় পুরো বন। সেক্ষেত্রে সাথে থাকতে হবে হাঁটার জন্যে সহায়ক জুতো, ছাতা এবং ক্যামেরা। হেঁটে হেঁটে যদি বনের চারপাশটা ঘোরা যায় তখনই মূলত বনের সৌন্দর্য ধরা পড়ে হাজার গুণে। তখন পাথরগুলোকে অনেকটাই জীবন্ত মনে হয়। হাজার হাজার বছর ধরে পাথুরে প্রাণ নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই পাথুরে বন শুধু যেন এক বন নয়, দর্শনার্থীদের চোখে এ যেন প্রকৃতির এক আজব খেয়াল।

ফিচার ইমেজ: 4hdwallpapers.com

Related Articles