হারিয়ে যাওয়া ১০০ বছর আগের দেশগুলো

প্রাচীন সাম্রাজ্যের পতন থেকে শুরু করে নতুন দেশের আত্মপ্রকাশ কিংবা স্থানের নাম পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব মানচিত্র প্রতিনিয়তই বদল হচ্ছে। আমরা যদি ১০০ বছর আগের মানচিত্রের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে বর্তমানের সাথে বেশিরভাগ জিনিসেরই অমিল পাওয়া যাবে। এই সময়ের ব্যাবধানে অনেক দেশ যেমন গঠিত হয়েছে, তেমনি অনেক দেশ আবার মানচিত্র থেকে হারিয়েও গিয়েছে। চলুন দেখে আসা যাক এমন কিছু দেশ, যেগুলো ১০০ বছর আগে বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের জানান দিলেও এখন আর নেই।

যুগোস্লাভিয়া

প্রায় ১০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের বর্ডার লাইনগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ঠিক সেই সময়ে ১৯১৮ সালে ইউরোপের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে একটি দেশ গঠিত হয়, যুগোস্লাভিয়া। মূলত তৎকালীন সময়ে একে সার্বিয়ান, ক্রোয়াট এবং স্লোভেনিয়ানদের রাজ্য হিসেবে গণ্য করা হতো, যার দরুন সংস্কৃতি, শিল্প–সাহিত্যে বৈচিত্র্য ছিলো পুরো দেশ জুড়ে। তার পাশাপাশি জাতিগত বিদ্বেষ ছিলো একে অপরের সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কমিউনিস্ট নেতাদের প্রচেষ্টায় সব জাতি এক হলেও ১৯৯০ এর দিকে পুরোপুরি ভেঙে যায় যুগোস্লাভিয়া। একে একে জন্ম নেয় স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, মন্টেনেগ্রো, কসোভো এবং মেসেডোনিয়া।

যুগোস্লাভিয়া; Image Source: Slovenian Explorer

তিব্বত

আধ্যাত্মিক ও শান্তিপূর্ণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছাড়াও তিব্বত জনপ্রিয় নোবেল জয়ী নেতা দালাই লামার জন্য। তিব্বত ভারতের উত্তর–পশ্চিমের একটি অংশ। মূলত ১৯১২ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিব্বত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিলো। তবে ১৯৫০ সালের শেষের দিকে চাইনিজ লিবারেশন আর্মি তিব্বত দখল করতে আসলে তিব্বত তাদের ১৭ দফা দাবি উত্থান করে। সেই দাবিগুলো মেনে নেওয়ার বিনিময়ে তিব্বত চীনের অন্তর্গত হয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালে দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী স্বায়ত্বশাসিতভাবে তিব্বত চীনের একটি অংশে পরিণত হয়।

তিব্বত; Image Source: Youtube

নিউট্রাল মরেসনেট

নিউট্রাল মরেসনেট নামে দেশের কথা বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি। প্রায় এক বর্গ মাইলের ছোট্ট এই দেশটির অস্তিত্ব ছিলো ১৮১৬ সালের দিকে। জিংকের খনির প্রাচুর্যতায় ডাচ ও প্রুসিয়ানরা একে ব্যবহারের জন্য আলাদা জাতিতে পরিণত করে, যাতে করে উভয় দেশেরই এই নতুন ভূখন্ডটিতে প্রবেশাধিকার থাকে। নতুন তৈরিকৃত এই ছোট্ট দেশটির নিজস্ব পতাকা, মুদ্রা ছাড়াও এস্পেরান্তো নামে একটি আলাদা ভাষাও ছিলো। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শিকার হয়ে পরে এই দেশটি বেলজিয়ামের একটি অংশে পরিণত হয়। তারপরও বর্তমান স্থানীয়রা প্রতিবছর নিউট্রাল মরেসনেটের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসবের সাথে পালন করে।

নিউট্রাল মরেসনেট; Image Source: Wikiloc

নিউফাউন্ডল্যান্ড

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালে সর্বপ্রথম ভাইকিংরা তাবু গাড়ে বর্তমানে নিউফাউন্ডল্যান্ড নামে পরিচিত এই দ্বীপটিতে। আঠারো শতকের শুরুর দিকে উত্তর আমেরিকার উত্তর–পূর্বে অবস্থিত এই দ্বীপটি ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্গত ছিলো। ব্রিটিশ কলোনি থেকে মুক্ত হয়ে ১৯০৭ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত এটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো।

সেই সময় দ্বীপটির মূল অর্থনৈতিক খাত ছিলো মাছ আহরণ। কিন্তু ১৯৩০ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক খাতে বিপর্যয় আসলে দেশটির লোকজন স্বেচ্ছায় ব্রিটিশদের কলোনাইজেশনে ফিরে যেতে চায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জনগণের ভোটাভুটির মাধ্যমে কানাডার সাথে যুক্ত হয় দ্বীপটি। ১৯৪৯ সালে এটি স্থায়ীভাবে কানাডার প্রদেশ হয়ে যায়। বর্তমানে নিউফাউন্ডল্যান্ডকে অনেকে ল্যাব্রাডর নামেও চিনে থাকে।

নিউফাউন্ডল্যান্ড; Image Source: Expedia

আবিসিনিয়া

আবিসিনিয়া প্রায় ১০০ বছর আগের ইথিওপিয়াকে দেওয়া ব্রিটিশদের একটি নাম। উনিশ শতকের দিকে ইতালি প্রথম এটি দখল করতে চায়। কিন্তু আবিসিনিয়ার সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। মূলত আবিসিনিয়া কখনোই কলোনাইজেশনে ছিলো না এবং আফ্রিকার গুটিকয়েক স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিলো। ১৯৩০ সালে মুসোলিনি কিছুটা দখল করলেও আবিসিনিয়ার অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি তখনও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ দ্বারা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি হয় ইথিওপিয়া। আবিসিনিয়াকে ইথিওপিয়াতে রুপ দিয়ে স্বাধীন ভূখন্ড হিসেবে ঘোষণা করা হয় একে। উল্লেখ্য, সবচেয়ে প্রাচীন মানুষের ফসিল পাওয়া যায় এই ইথিওপিয়াতেই।

আবিসিনিয়া; Image Source: Pinterest

চেকোস্লোভাকিয়া

পূর্ব ইউরোপে অস্ট্রো–হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯১৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার আত্মপ্রকাশ হয়। ঐতিহাসিক এলাকা মোরাভিয়া, স্লোভাকিয়া এবং বোহেমিয়া নিয়ে তৈরি হয় দেশটি। নাৎসি বাহিনী দ্বারা অধিকৃত এই চেকোস্লোভাকিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের চালিকাশক্তি ছিলো। ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে যায়। জন্ম নেয় চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

চেকোস্লোভাকিয়া; Image Source: Czech Explorer

সেইলন

দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে বড় দ্বীপ হিসেবে পরিচিত শ্রীলংকা। তবে ১৯৭২ সালের আগপর্যন্ত এই দ্বীপের নাম ছিলো সেইলন। যখন পুরো ভারতবর্ষ ব্রিটিশ কলোনাইজেশনে ছিলো, তখন বহিরাগতরাই একে সেইলন নামে ডাকতো। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের উপনিবেশের পর ১৯৭২ সালে ইউরোপীয়দের দেওয়া নাম পরিবর্তন করে ফেলে দ্বীপটি। শ্রীলংকা নামে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

সেইলন; Image Source: Getty Image

বাসুতোল্যান্ড

ব্রিটেন থেকে ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা লাভ করা দেশ লেসোথো উনিশ শতকের দিকে যুক্ত জাতি হিসেবে বাসুতোল্যান্ড হিসেবে পরিচিত ছিলো। রাজা প্রথম মোশোশোর অধীনে পরিচালিত ছিলো দেশটি। বহিরাগতদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে ব্রিটিশদের সাহায্য চান রাজা।

সেই ঘটনার জেরে কয়েক যুগ ব্রিটিশদের অধীনেই ছিলো বাসুতোল্যান্ড। পরবর্তীতে বাসুতোল্যান্ড ভেঙে লেসোথোসহ দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি প্রদেশে রুপ নেয়। মূলত বাসুতোল্যান্ড পুরো দেশটাই ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার ভেতরে। পৃথিবীতে মাত্র তিনটি দেশই অন্য আরেকটি দেশ দ্বারা পুরোপুরি আবদ্ধ। অন্য দুটি হলো ভ্যাটিকান সিটি এবং স্যান মারিনো। তবে বাসুতোল্যান্ডের রাজ পরিবার পরিক্রমায় লেসোথোতে এখনো রাজপরিবার বিরাজমান। দেশটির শাসনব্যবস্থাও রাজতন্ত্র।

বাসুতোল্যান্ড; Image Source: Eye See Africa

সিকিম

হিমালয় পর্বতের ছোট এলাকা হিসেবে সিকিম পরিচিত হলেও এটি একটি স্বাধীন রাজতন্ত্র ছিলো। ১৬৪২ থেকে ১৯৫০ সালে ভারতের আশ্রিত রাজ্য হওয়ার আগপর্যন্ত সিকিম ছিলো সার্বভৌম। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে এটি ভারতের একটি প্রদেশে রুপ নেয়। ভূটান, তিব্বত ও নেপালের সীমান্তে থাকা সিকিমকে স্থানীয়রা ঈশ্বরের বাড়ি বলে সম্বোধন করে।

সিকিম; Image Source: Times of India

পারস্য

পৃথিবীর কিছু প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে অন্যতম একটি হলো পারস্য সভ্যতা। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের নাম শুনলে পার্সিয়ার ছবি ভেসে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে রাজা দ্বিতীয় সাইরাস গড়ে তোলেন পারস্য সাম্রাজ্য। এরপর বহুবার নিজেদের সাম্রাজ্য বাঁচাতে যুদ্ধ করা এই দেশটি ১৯৩৫ সালের আগপর্যন্ত পারস্য নামেই পরিচিত ছিলো। ১৯৩৫ সালে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকেই এর নাম পরিবর্তন করা হয়, বর্তমানে যা ইরান নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে পারস্যের সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ইরানে এখনো জীবন্ত। আমেরিকার সাথে শিথিল রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ এটি।

পারস্য; Image Source: Trip to Persia

সিয়াম

শত শত দ্বীপ নিয়ে গড়া থাইল্যান্ড এককালে পরিচিত ছিলো সিয়াম নামে। সংস্কৃত শব্দ সাইয়াম থেকে সিয়াম শব্দটি আসে। ১৮৫১ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত শাসন করা রাজা মংকুত তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলটিকে সিয়াম নামকরণ করেন। অবশেষে রাজতন্ত্র আসার পর ১৯৩৯ সালে সিয়াম পরিবর্তন করে এশিয়ার এই দেশটিকে থাইল্যান্ড নামকরণ করা হয়।

থাইল্যান্ড; Image Source: Youtube

প্রুসিয়া

১৯৪৭ সালের আগে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপে প্রুসিয়া নামের এই রাষ্ট্রটি বিদ্যমান ছিলো, যা বর্তমানে জার্মানি এবং পোল্যান্ড নামে দুটি দেশে বিভক্ত। ১৮ শতকের দিকে প্রুসিয়া অনেক রাজ্য দখল করলেও উনিশ শতকের শুরুর দিকে সেগুলো হারাতে শুরু করে। ১৮৭১ সালে ফ্রাংকো-প্রুসিয়ান যুদ্ধ জেতার পর এই সাম্রাজ্যটি জার্মানি নামে আত্মপ্রকাশ শুরু করে। যদিও সেই সময় প্রুসিয়া জার্মানির একটি প্রদেশ হিসেবে টিকে ছিলো। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে বাধ্য করা হয় পোল্যান্ডকে মুক্ত করে দিতে, যাতে প্রুসিয়া প্রদেশের কিছু অংশ ছিলো। পরবর্তীতে পোল্যান্ড স্বাধীনতা লাভের পর বিশ্ব মানচিত্র থেকে প্রুসিয়া পুরোপুরি মুছে যায়।

প্রুসিয়া; Image Source: Huffingtonpost

জাঞ্জিবার

আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের একটি দ্বীপ হচ্ছে জাঞ্জিবার। একটা সময় এলাকাটি বাণিজ্যিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এবং উনিশ শতকের সুলতানী শাসনের অধীনে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই ছিলো। তবে কিছু সময়ের মধ্যেই ১৮৯০ সালে তা ব্রিটিশদের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। যদিও সুলতানদের শাসন ব্যাবস্থা ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত টিকে ছিলো। অ্যাংলো-জাঞ্জিবার যুদ্ধের পর ১৯৬৩ সালে সুলতানী ব্যবস্থা উঠিয়ে এখানে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই সাথে জাঞ্জিবার তাঞ্জানিয়ার একটি অংশ হিসেবে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্খ কিলিমাঞ্জারো এখানেই অবস্থিত।

জাঞ্জিবার; Image Source: Intrepid Travel

This article is about the amazing islands around the world. Necessary references are hyperlinked in the article. 

Feature Image : Forbes

Related Articles

Exit mobile version