‘মানসিক অসুস্থতা’ কথাটি শুনলে বাংলাদেশের মানুষ বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ ঘৃণায় মুখ বাঁকায়, কেউ অবজ্ঞায় নাক সিটকায়, আবার কেউবা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। মানসিক অসুস্থতা সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশে তীব্র লজ্জা আর আতঙ্কের একটি ব্যাপার। কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হলো মানে সে যেন বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেললো যার কলঙ্ক তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রতি এদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি রীতিমতো অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং আঁতকে ওঠার মতো। এখানে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের ‘পাগল’ মনে করা হয়।
কিন্তু কেন? কী দোষ তাদের? তাদের দোষ একটাই। তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। অথচ অসুস্থতার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় যেকোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মানসিক রোগ জ্বর, সর্দি, যক্ষ্মা, টাইফয়েড বা ক্যান্সারের মতোই একটি রোগ। সমস্যা হলো, এদেশের মানুষ মানসিক রোগকে কোনো রোগ বলেই মনে করে না। তাই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের রোগীও মনে করে না যে তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাবে। তাহলে তারা কী মনে করে? এই সম্পর্কে দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত।
মতবাদ-১: তারা পাগল।
মতবাদ-২: দেশীয় নাটক-সিনেমার বদৌলতে সম্ভবত মানুষের এই ধারণা হয়েছে যে, তারা ইচ্ছাকৃত মানসিক রোগী হয়েছেন। কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। সেই উদ্দেশ্য পূরণ হলেই তারা ‘ভান’ ছেড়ে ভালো হয়ে যাবে।
এহেন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যারা মানসিক রোগের শিকার তারা তীব্র অসহায় বোধ করেন এবং নিদারুণ মনোকষ্টের শিকার হন। আর অসুস্থদের পরিবার তাদেরকে নিয়ে তীব্র লজ্জা ও হীনম্মন্যতায় ভোগেন এবং তথাকথিত সমাজে তাদের সম্মান বজায় রাখতে অসুস্থতার বিষয়টি বেমালুম চেপে যান। ফলে বেশিরভাগ রোগীর কপালেই ভাল চিকিৎসা জোটে না। এভাবে একশ্রেণীর মানুষের প্রতি অপর শ্রেণীর মানুষের শুধুমাত্র একটি রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে নির্যাতনের কারণ মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। এই লেখাটি মানসিক রোগ সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশের পথে একটি ক্ষুদ্র চেষ্টার অংশ মাত্র। মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে হলে প্রথমেই জানতে হবে কোন অবস্থাকে আমরা মানসিক রোগ বলবো।
মানসিক রোগ কী
মানসিক রোগ হচ্ছে মনের অসুখ। শরীর ও মন নিয়েই মানুষ। মানুষের শরীরের যেমন অসুখ হয়, মনেরও তেমনি অসুখ হয়। শরীরের অসুখ আমরা সহজেই মেনে নিই। কিন্তু মনেরও অসুখ হবে- ব্যাপারটা আমরা ঠিক মানতে পারি না। আমরা মানতে পারি বা না পারি, মনের যে অসুখ হয় এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। এই মনের অসুখের স্বরুপ কী? আমরা ঠিক কোন অবস্থাকে মনের অসুখ বলবো?
কোনো মানুষের চিন্তা ও আচরণে হালকা থেকে মাঝারি বা তীব্র ধরনের সমস্যা হওয়ার কারণে যদি তার নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হয়, তিনি যদি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলেন, এই অবস্থাটিকে আমরা মানসিক অসুস্থতা বলতে পারি। এই অবস্থায় মানুষটি তার চিন্তা ও আবেগের ভারসাম্য রক্ষা করতে হিমশিম খান বা হারিয়ে ফেলেন। আপনার চিরপরিচিত মানুষটি হয়ে যান অন্য কোনো মানুষ। মানসিক রোগ হলে অভ্যাস, ব্যক্তিত্ব, মেজাজ, চিন্তা সবকিছুই প্রভাবিত হয়। সবকিছুতেই পরিবর্তন আসে। এই পর্যন্ত প্রায় দুইশরও বেশি ধরনের মানসিক রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে ডিপ্রেসন, এংজাইটি ডিসঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার প্রভৃতি সবচেয়ে বেশি ঘটতে দেখা যায়। মানসিক রোগ শারীরিক ও আবেগীয় দিককেও প্রভাবিত করে।
মানসিক রোগ কেন হয়?
অতিরিক্ত মানসিক চাপ, প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতা, জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার প্রভাব প্রভৃতি কারণে সাধারণত মানসিক রোগ হতে দেখা যায়। এছাড়া জিনগত কারণে এবং শরীরের জৈবরাসায়নিক ভারসাম্যহীনতাকে মানসিক রোগের জন্য দায়ী ভাবা হয়।
মানসিক রোগের উপসর্গ
বিভিন্ন রোগের উপসর্গ বিভিন্ন রকমের হয়। তবে সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক, কিশোর-তরুণ, বৃদ্ধদের নিচের উপসর্গগুলো দেখা যেতে পারে।
– চিন্তাভাবনায় সমস্যা
– দীর্ঘদিন হতাশায় ভোগা
– মন-মেজাজের দ্রুত পরিবর্তন
– অতিরিক্ত ভয় ও দুশ্চিন্তা
– সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
– খাদ্যগ্রহণ ও ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন
– তীব্র রাগ
– ভুল, অদ্ভুতুড়ে বিশ্বাস (delusion)
– ভুল দেখা, ভুল শোনা (hallucination)
– দৈনন্দিন জীবনের খেই হারিয়ে ফেলা
– আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা
শিশুদের ক্ষেত্রে
– স্কুলের ফলাফলে আকস্মিক পরিবর্তন
– অনেক চেষ্টা করেও ভাল ফলাফল করতে না পারা
– খাদ্য ও ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন
– অতিরিক্ত চাঞ্চল্য বা নিথর হয়ে যাওয়া
– ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখা
– খুব বেশি রাগারাগি করা
মানসিক রোগের চিকিৎসা
আপনার যদি মানসিক রোগ হয় তাহলে কী করবেন? চমকে গেলেন তো? খুবই স্বাভাবিক। আমাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ধারণা প্রচলিত আছে যে ‘আমার কখনো মানসিক রোগ হবে না। আমি এবং আমার প্রিয় মানুষগুলো এই বিদঘুটে রোগগুলো থেকে পুরোপুরি নিরাপদ’। অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানানো যাচ্ছে যে এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আপনি বা আপনার কাছের কেউই যেকোনো সময় যেকোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। এতে লজ্জার কিছু নাই। এটা কোনো দুর্বলতাও নয়। তাই আপনার মধ্যে যদি কখনো মানসিক রোগের উপসর্গগুলো দেখা দেয় তাহলে প্রথমেই যা করবেন তা হলো সকল উন্নাসিকতা ঝেড়ে ফেলে মেনে নিন যে, আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তারপর বিশ্বস্ত কারো সাথে পরামর্শ করতে পারেন, কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আপনার জন্য ভাল হবে। তারপর সোজা তার চেম্বারে যাবেন।
তিনি ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিলে ওষুধ খাবেন। যা করতে বলবেন সেই কাজগুলো গুরুত্বের সাথে করবেন। এছাড়া দক্ষ কোনো সাইকোলজিস্টের সান্নিধ্যে সাইকোথেরাপি নেয়াও দারুণ উপকারী। আপনার চিকিৎসা কী হবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করে আপনার রোগের তীব্রতার উপর। তীব্রতা বেশি হলে সাধারণত ওষুধ দেয়া হয়।
আর ওষুধ লিখেন মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ। সাইকোলজিস্টরা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করে থাকেন। তারা চিকিৎসা করেন কথা বলে বা আলোচনা করে আপনার সমস্যা সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে চিকিৎসা নেওয়া – সবই গুরুতর লজ্জা এবং অপরাধের কাজ। এই ঘটনাগুলো ঘটলে আপনাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে। পরিবারের সহযোগিতাও হয়ত সবসময় পাওয়া যাবে না। সেজন্য হতাশ হবেন না, নিজের সমস্যাকে অবহেলা করবেন না।
বিশ্বাস করুন, আপনি যদি সমস্যা ক্ষুদ্র থাকতে চিকিৎসা গ্রহণ না করেন, তাহলে রোগের তীব্রতা অবশ্যই বেড়ে যাবে। তখন সমাজ, পরিবার কাউকেই পাশে পাবেন না। কেউ কেউ হয়তো সহযোগিতাপ্রবণ পরিবার পেয়ে থাকেন, তবে বেশিরভাগই ততটা সৌভাগ্যবান নন। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর কথা বললে একশ্রেণীর মানুষ ক্ষেপে যান। তাদের প্রতিক্রিয়া, ‘হ্যাঁ, আমি কি পাগল হয়েছি যে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবো?’ তাদের কাছে মানসিক রোগ মানেই পাগল হওয়া।
তাহলে পাগল হওয়া কাকে বলে? মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলা, ছেঁড়া জামাকাপড় পড়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। আর সাইকিয়াট্রিস্ট মানে এদের ধরে বেঁধে রেখে যারা চিকিৎসা করেন। এমন ভাবনা যাদের, তাদের জানা উচিত, মানসিক রোগ মানেই পাগল হওয়া না। মানসিক রোগ মানসিক চিন্তা ও আচরণে এমন কিছু পরিবর্তন যা ব্যক্তির ক্ষতি করছে। এই ক্ষতি ঠেকাতে সাইকিয়াট্রিস্ট ব্যক্তিকে সহযোগিতা করেন। আমাদের দেশে আরেকটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, ধর্ম মেনে চললে মানসিক রোগ হয় না। কিন্তু মানসিক রোগ ধার্মিক-অধার্মিক মেনে হয় না।
যদিও ধার্মিক লোকদের মানসিক সেবা নেয়ার প্রবণতা থাকে। আপনি যখন মানসিকভাবে সুস্থ তখন ধর্ম মেনে চললে আরো ভাল থাকতে পারবেন। কিন্তু যখন অসুস্থ হয়ে পড়বেন তখন ধর্মীয় বিধিবিধান মানার মতো অবস্থাই থাকে না। সেই অবস্থায় অবশ্যই আপনি ধর্ম মানার চেষ্টা করবেন। তবে রোগের জন্য চিকিৎসাও নিতে হবে।
মানসিক রোগ সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা
হতাশা
প্রিয় কারো মৃত্যু, চাকরি হারানো, সম্পর্কচ্ছেদ, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাওয়া খুব কষ্টকর। এতে আমরা ভেঙে পড়ি, কষ্ট পাই, দিনের অনেকটা সময় মন খারাপ করে বসে থাকি। কিন্তু কোনো ঘটনায় তীব্র আঘাত পাওয়াজনিত শোক বা শুধুই মন খারাপকে হতাশা বা ডিপ্রেশন বলে না। ডিপ্রেশন তখনই বলা যাবে যখন একইসাথে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র মন খারাপ থাকবে, আপনি তীব্র হীনমন্যতায় ভুগবেন, এককালের প্রিয় ও পছন্দের কাজেও মনোযোগ দিতে পারবেন না, সবকিছু অসহ্য লাগবে, জীবনটা অর্থহীন মনে হবে, আত্মহত্যার চিন্তা করবেন, এমনকি সেই চেষ্টাও করবেন। হতাশায় আক্রান্ত ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস অসম্ভব কমে যায়। ফলে তিনি দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজগুলোও করতে পারেন না।
এ অবস্থায় পরিবারের লোকজন হয়তো তাকে অলস, অকর্মার ধাড়ী, ঢং করছে প্রভৃতি নানা তিক্ত কথা বলবেন। অযাচিত উপদেশ দিবেন, বোঝাবেন। কিন্তু এতেও আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হবে না। এই ‘হালকা’ ডোজ কাজ করছে না বলে তারা কঠিন অ্যাকশনে যাবেন। হয়তো বিরক্ত হয়ে রাগারাগি করবেন তারা, গালাগাল করবেন। কিন্তু এরা একবারও ভাববেন না এই লোকটি কিছুদিন আগেও ভাল ছিল, পরিশ্রমী ছিল।
এখন হঠাৎ পরিবর্তন হলো কেন? তারা বকাবকি করে আর জ্ঞান দিয়ে দুনিয়া উদ্ধার করতে চান, একবারও ভাবেন না যে তিনি মানসিকভাবে রোগগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারেন। আপনি যদি এমন অবস্থার শিকার হন বা এমন অবস্থা দেখে থাকেন তাহলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন বা দিন। ভেবে দেখুন, আক্রান্ত ব্যক্তি এমনিতেই তীব্র মনোকষ্টে ভোগেন, পরিবারের লোকজনের খারাপ আচরণ তাকে কতটা কষ্ট দেবে। এ অবস্থায় তিনি হয়তো সামগ্রিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন।
পরিবারের সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ একান্ত জরুরী। একজনকে নিরীহ মানুষকে স্রেফ রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণে মেরে ফেলার অধিকার অবশ্যই কারোর নেই।
এংজাইটি ডিসঅর্ডার
এংজাইটি ডিজঅর্ডার বেশ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। জেনারালাইজড এংজাইটি ডিজঅর্ডার, সোশ্যাল এংজাইটি ডিজঅর্ডার, প্যানিক ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার প্রভৃতি সব রোগই এংজাইটি ডিজঅর্ডারের মধ্যে পড়ে। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের ব্যাপ্তি বেশ বড়। তাই এটা নিয়ে আলাদা আলোচনা থাকবে। তো এংজাইটি ডিজঅর্ডার কথাটা শুনলে সাধারণ মানুষ মনে করে দুশ্চিন্তা করা, যেটা চেষ্টা করলেই দূর করা যাবে।
আক্রান্ত ব্যক্তি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন বা ভয় পাচ্ছেন। দুশ্চিন্তা বা ভয় তো জীবনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। তাই হয়তো অনেকে ভাবেন, আমিও দুশ্চিন্তা করি, আমিও ভয় পাই। এটাকে এত পাত্তা দেয়ার কী আছে। তারা বোঝেন না, ভয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক, দুশ্চিন্তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ভয় বা দুশ্চিন্তা মাত্রা ছাড়ালে তা বিপদের কারণ হয়। তখন সেটা আর স্বাভাবিকভাবে ঝেড়ে ফেলা যায় না, সেটা হয়ে পড়ে একটা মেডিক্যাল ক্রাইসিস। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে।
এংজাইটি ডিজঅর্ডারের বেশ কিছু শারীরীক উপসর্গও দেখা যায়। যেমন- মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, মাথা থেকে গরম ভাপ ওঠা, হাত-পা কাঁপা, ঘেমে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হতে পারে হার্ট ডিজিজ। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিছুই ধরা পড়লো না। তখন বুঝতে হবে এটা প্যানিক ডিজঅর্ডার। তখন আর কার্ডিওলজিস্টের চেম্বারে ঘোরাঘুরি না করে সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে যেতে হবে। আবার কেউ সামাজিক পরিবেশে মিশতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না। তাকে বকাঝকা না করে ডাক্তার দেখানো অপরিহার্য। চিকিৎসায় এই রোগগুলো সেরে যায়। তাই দয়া করে এরকম অবস্থাগুলোকে অবহেলা করবেন না। অবশ্যই চিকিৎসা নিন।
অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার
Obsessive Compulsive Disorder (OCD) শুচিবায়ু নামেই বেশি পরিচিত। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সবচেয়ে পরিচিত উপসর্গ হচ্ছে ব্যক্তিকে একই কাজ বার বার করতে দেখা যায়। যেমন- বার বার হাত ধোয়া। এই রোগটির দুটি অংশ রয়েছে।
অবসেশন এবং কম্পালশন। তীব্র অস্বস্তিকর একটি চিন্তা যা ব্যক্তি কোনোভাবেই মনে করতে চান না সেটা বার বার মাথায় আসতে থাকে। একে বলা হয় অবসেশন। অস্বস্তিকর চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে বা স্বস্তি পেতে ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো কাজ বার বার করতে থাকে। আচরণের এই পুনরাবৃত্তিকে বলা হয় কম্পালশন। এতে সাময়িকভাবে স্বস্তি পাওয়া যায়, কিন্তু এতে রোগটা আরও বেড়ে যায়।
ওসিডি বেশ কয়েক রকমের হয়। কেউ বারবার কিছু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার রাখতে চান, কারো মাথায় ধর্মীয় বিষয়ে বাজে চিন্তা আসে, কেউবা তীব্র অস্বস্তিকর যৌন চিন্তায় বিপর্যস্ত হন। একইসাথে একাধিক প্রকারের ওসিডিতেও কেউ কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। প্রত্যেকটি পরিস্থিতিই সমান কষ্টকর এবং বিরক্তিকর। একটা কাজ দু’বার করতে হলে বা বাজে কোনো চিন্তা মাথায় আসলে কতটা খারাপ লাগে তা তো আমরা সবাই জানি। সেখানে প্রতিটি মুহূর্তে, দিনের পর দিন, এমনকি বছরের পর বছর কষ্টদায়ক চিন্তাভাবনায় জর্জরিত হওয়া বা একই আচরণের পুনরাবৃত্তি যে কতটা কষ্টকর আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
অথচ এই মানুষগুলোকে তথাকথিত ‘সুস্থ’ মানুষগুলো হাসাহাসি করে, টিটকারি মারে। পরিবারের লোকজনও না বুঝে কখনো কখনো বকাঝকা করেন, খারাপ আচরণ করেন তাদের সাথে। এখানে লক্ষ্যণীয়, তারা ইচ্ছা করে এমন করেন না। তারা এমনটা করতে বাধ্য হন। তাই আপনি তাদের সাথে নির্দয় আচরণ করার আগে একটু ভাবুন। অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিকে আবার বলতে শোনা যায়, ‘অবসেশন তো সব মানুষের আছে’। অবশ্যই অবসেশন সব মানুষের আছে, তবে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার সব মানুষের নেই।
চিন্তার পুনরাবৃত্তি স্বাভাবিক। তবে এতে সব মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হন না বা এতে সাড়া দিয়ে একই আচরণ বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে যান না। এটা একটা ক্লিনিক্যাল অবস্থার নাম। এই অবস্থায় ব্যক্তিকে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হয়। কেউবা আবার বলে থাকেন, ‘এটা তো খুব বেশি চিন্তার কিছু না’। এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। যে বছরের পর বছর তীব্র ওসিডিতে ভুগছে তার কত ক্ষতি হচ্ছে এটা কে দেখবে? তার দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে, সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, পারিবারে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে, পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, স্বাভাবিক জীবন বলে কিছুই থাকছে না।
এরপরও কি তারা বলবেন, এটা চিন্তার কিছু না? ওসিডি আক্রান্ত রোগীর যথোপযুক্ত চিকিৎসা যেমন জরুরি তেমনি জরুরি পরিবারের আন্তরিক সহযোগিতাও। চিকিৎসায় ওসিডি ভাল হয়। তাই আপনি বা আপনার কাছের কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন। তবে ওসিডিতে কাউন্সেলিংই বেশী উপকারী। সেক্ষেত্রে সাইকোলজিস্ট দেখান।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া
স্কিৎজোফ্রেনিয়ার জটিলতম মানসিক রোগগুলোর একটা। ভুল বিশ্বাস, ভুলভাল দেখা, গায়েবী আওয়াজ শোনা, নিজেকে আঘাত করা ইত্যাদি এই রোগের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কাল্পনিক এক জগতে বাস করেন। তাই তার চিন্তা ও আচরণে ভিন্নতা খুবই প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এদেরকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়। এই রোগীদেরই মূলত ‘পাগল’ বলা হয়। তবে বেশিরভাগ রোগীরই সমস্যা নির্দিষ্ট হয়ে থাকে এবং তারা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন নন। ভাল চিকিৎসা করলে স্কিৎজোফ্রেনিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
বাংলাদেশে মানসিক রোগের হালচাল
বাংলাদেশের মানুষ এখনো মানসিক রোগের স্বরুপ এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নয়। অথচ দেশের প্রায় ১৬ ভাগ মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। এদিকে বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা খুবই করুণ।
এত বিপুল জনসংখ্যার বিপরীতে মাত্র একটি সরকারী মানসিক হাসপাতাল রয়েছে, পাবনার হেমায়েতপুরে। এই হাসপাতালটিতে শয্যাসংখ্যা অপ্রতুল, মাত্র ৫০০। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে মোট বাজেটের মাত্র ০.৫% মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ। বেসরকারী উদ্দোগে কিছু কাজ হচ্ছে, তবে সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সরকারী ও বেসরকারী সংগঠনগুলোকে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত।
যেকোনো অসুস্থতা থেকে মুক্তিলাভের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। মানসিক অসুস্থতাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমাদের প্রয়োজন মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে এসে এই সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানলাভ করা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটানো। আমাদের উচিত মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সবধরনের সমর্থন দেওয়া। তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা না করে সহানুভূতিশীল আচরণ করা এবং তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
ভাবুন তো, জীবন খুবই অনিশ্চিত। হতে পারে একদিন আপনিও মানসিক রোগে আক্রান্ত হবেন। তখন যেন আপনার পরিবেশ-প্রতিবেশ আপনার অনুকূলে থাকে এজন্য হলেও আপনার এই কাজগুলো করা উচিত।
ফিচার ইমেজ – Chennai Memes