মিশুক রহমান এবং ঐন্দ্রিলা নাহার পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আট বছর আগে। কিন্তু বিয়ের অনেকদিন পেরিয়ে গেলেও তারা সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি। অবশেষে বিধাতা তাদের দিকে মুখ তুলে চাইলেন। বিয়ের ১০ বছরের মাথায় তাদের কোল জুড়ে এলো প্রথম সন্তান সুজন। ফুটফুটে ছেলের দিকে তাকিয়ে দুজনে আনন্দে বিভোর হয়ে যান। তাদের খুশির জোয়ার বাঁধ মানে না।
সুস্থ সবলভাবেই বেড়ে উঠতে থাকে সুজন। অতি শান্তশিষ্ট শিশু সে। খুব বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করে না। খাবার খাইয়ে দিলে চুপচাপ শুয়ে থাকে। আস্তে আস্তে উঠে বসতে শেখে সুজন। একসময় হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করে। হাত ধরে উঠিয়ে দিলে দাঁড়াতেও পারে। কিন্তু কেন জানি কথা বলার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। ছোট বাচ্চাদের সামনে বাবা-মায়েরা বিভিন্ন রকম মজার শব্দ করে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। মিশুক-ঐন্দ্রিলাও যে এমনটা করেন না, তা নয়। কিন্তু তাতেও সুজনের মুখে কোনো কথা নেই। অথচ আদর-যত্নের কোনো ত্রুটি নেই।
তারা সাগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন সুজনের মুখে প্রথম বোল ফুটবে? এক বছর পার হয়ে গেলো, তবুও কথা ফুটলো না সুজনের। অবশেষে ১৫ মাসে গিয়ে প্রথম শব্দ উচ্চারণ করলো সুজন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সবাই। কিন্তু দিন দিন আরো কিছু সমস্যা প্রকট হতে থাকলো। বিশেষ প্রয়োজন না হলে সে একেবারেই কথা বলে না। মা-বাবা ছাড়া বাইরের কারো সামনে টুঁ শব্দটিও করবে না। পারতপক্ষে তাদের সামনে বেরোয়ই না। সারাক্ষণ আপন মনে থাকে। মা-বাবা দুজনই হয়তো ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছেন, তবুও তার হুঁশ নেই। আর কী ভীষণ একরোখা! যা পছন্দ হবে তা চাই-ই চাই। না দিলে আঁচড়ে কামড়ে একশেষ করে দেয়।
একদিন এক আত্মীয় তাদের বাসায় এসে সুজনকে দেখে উপদেশ দিলেন, হয়তো সুজনের বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। তাকে নিয়ে একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার কথাও বললেন তিনি। মিশুক এবং ঐন্দ্রিলা খানিকটা ইতস্তত করলেও শেষমেশ সুজনকে নিয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে উপস্থিত হলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষায় ধরা পড়লো সুজন অটিজমে আক্রান্ত! সে একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু।
দুজন একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। তবে ডাক্তারের কথা শুনে আবার আশার আলো দেখলেন তারা! ডাক্তার জানালেন, সুজনকে বিশেষভাবে লালন করতে হবে। তাহলেই অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে সে! সঠিক পরিচর্যায় অটিজম আক্রান্তরা অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠে। এখন আপনাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, এই অটিজম আসলে কী? আর কিভাবে বেড়ে উঠলে সুজন তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে? সেই প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হবে সামনের অনুচ্ছেদগুলোতে।
অটিজম কী?
অটিজম একটিমাত্র রোগ নয়, বরং এটি একধরনের সমষ্টিগত সমস্যা যাকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটি এমন একগুচ্ছ সমস্যা যেখানে শিশুর সামাজিক দক্ষতায় ঘাটতি থাকে। শিশুটি একরোখা মনোভাব সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং একটি কাজ বারবার করতে থাকে। সে অন্যদের সাথে ভাব বিনিময়ে সাধারণত অনাগ্রহী থাকে। অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের জগতেই ডুবে থাকে সে।
এদের কয়েকটি ধরনে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো-
- অটিস্টিক ডিজঅর্ডার (Autistic Disorder)- এটি ‘ক্লাসিক অটিজম’ নামেও পরিচিত। ক্লাসিক অটিজম হলো অটিজমের সবথেকে সাধারণ ধরন। ক্লাসিক অটিজমে আক্রান্তদের মূলত ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। তারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। অনেক সময় তারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে।
- এসপারগার সিন্ড্রোম (Asperger Syndrome)- এটি অপেক্ষাকৃত মৃদু শ্রেণীর অটিজম। এদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা থাকে না। এরা কথা বলতে পারে। এমনকি এরা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যোগাযোগও করতে সক্ষম।
- পারভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার (Pervasive Developmental Disorder)- একে ‘এটিপিক্যাল’ অটিজম’ বলা হয়। ‘এটিপিক্যাল’ শব্দটি দ্বারা বোঝায় এমন কিছু, যা সহজে পাওয়া যায় না বা খাপছাড়া গোছের। যাদের মধ্যে অটিস্টিক ডিজঅর্ডার এবং এসপারগার সিন্ড্রোম- উভয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তারা এর অন্তর্গত।
কারণ
বিজ্ঞানীদের ধারণা, অটিজম রোগটি জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, পরিবেশগত কিছু বিষয় অটিজমের জন্য দায়ী। এই মুহুর্তে এই দুয়ের মিলিত ফলাফলকে অটিজমের পেছনের মূল হোতা হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। এই ধারণা অনুযায়ী, সেসব শিশুরাই মূলত অটিজমে আক্রান্ত হয়, যারা জেনেটিক্যালি অটিজমের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন রিস্ক ফ্যাক্টরের দ্বারা প্রভাবিত। এই রিস্ক ফ্যাক্টরের প্রভাব আবার শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও হতে পারে, আবার শিশুটি মাতৃগর্ভে থাকাকালীনও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ-
- গর্ভবস্থায় যদি মা কোনো ধরনের এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করে। মনে রাখবেন, গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সময়।
- গর্ভবতী মা যদি অপুষ্টিতে ভোগেন। বিশেষত ফলিক এসিড বা ভিটামিন বি-১২ এর অভাব এক্ষেত্রে বেশি বিপদজনক।
- মা বাবার বয়সও কিছু ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, অধিক বয়সে সন্তান জন্মদান।
- শিশু যদি জন্মকালীন জটিলতায় আক্রান্ত হয়। যেমন, কম ওজন কিংবা রক্তশূন্যতা!
- অটিজমের পেছনে কারণ হিসেবে রাসায়নিক বিষাক্ত পদার্থ খুবই ভয়াবহ। এর মধ্যে ধাতব বর্জ্য এবং কীটনাশক দুই-ই সমানভাবে দায়ী।
সুতরাং, এই সকল অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় এড়িয়ে চললে অটিজমের ঝুঁকি আমরা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারি।
বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ
যত দ্রুত অটিজম শনাক্ত করা যায়, ততই মঙ্গল। কারণ কম বয়সে আমাদের মস্তিষ্কের প্লাস্টিসিটি বা নমনীয়তা বেশি থাকে। যদিও সাধারণত দুই বছরের আগে অটিজম শনাক্ত করা বেশ কষ্টকর। কারণ শুরুতে শিশুর আচার আচরণ স্বাভাবিক থাকে। অন্য সকল বাচ্চার মতোই শারীরিক বিকাশ হতে থাকে। ১২-১৮ মাসের ভেতর কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু হয়। আর অটিজমের বিশেষ লক্ষণগুলো ২-৩ বছর যেতে না যেতেই ক্রমশ ফুটে উঠতে শুরু করে। ১৮ মাসের ভেতরে অটিজম শনাক্ত করা গেলে পর্যাপ্ত চিকিৎসার মাধ্যমে মস্তিষ্কের প্লাস্টিসিটি ব্যবহার করে মস্তিষ্ককে নতুনভাবে খাপ খাইয়ে নিতে প্রস্তুত করা যায়।
অটিজমের একেবারে প্রথম দিককার লক্ষণ আসলে অস্বাভাবিক কোনো বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ নয়। বরং বলা যেতে পারে, এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যই হলো স্বাভাবিক কার্যকলাপের অনুপস্থিতি। ফলে এগুলো বুঝে ওঠা প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ এ পর্যায়ে শিশুটি চুপচাপ, স্থির, শান্ত-শিষ্ট থাকে, যা অনেক সময় একটি ‘লক্ষী বাচ্চা’র বৈশিষ্ট্য হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়।
এ সময়ে একটি ‘শঙ্কাচিহ্ন’ এর তালিকা করা হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে Developmental Red Flags বা সন্তান বেড়ে ওঠাকালীন বিপদসীমা। এই প্যারামিটার দ্বারা নিম্নোক্ত সময়ে যদি উল্লেখিত ঘটনা না ঘটতে থাকে, তবে আপনার সন্তানকে একজন শিশুবিশেষজ্ঞের নিকট নিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
- ৬ মাস- মুখজোড়া হাসি কিংবা হাসিহাসি মুখ। সুড়সুড়ি দিলে হাসা।
- ৯ মাস- এদিক ওদিক বিভিন্ন শব্দ উৎসের দিকে ঘুরে তাকানো, মুখে বিভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ পাওয়া।
- ১২ মাস- অস্ফুটস্বরে অনবরত কথা বলা বা আধো আধো বোল ফোটা।
- ১৬ মাস- বিভিন্ন জিনিসের নাম, যেমন, মা-বাবা বা অন্যান্য শব্দ বলতে শেখা।
- ২৪ মাস- পূর্ণবাক্য বলতে শেখা।
আমেরিকার The Centers for Disease Control and Prevention (CDC) এর হিসাব মতে, সেই দেশে প্রতি ৬৮ জন মানুষের ভেতরে একজনের অটিজমে আক্রান্ত। পুরুষের ক্ষেত্রে তা আরো বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৪২ জনে একজন। নারীর ক্ষেত্রে কিছুটা কম প্রতি ১৮৯ জনে একজন। এক-তৃতীয়াংশ অটিজম আক্রান্ত শিশুরা কথা বলতে অক্ষম। সমপরিমাণ শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা থেকে ভুগতে হয়। অটিস্টিক শিশুরা কয়েক ধরনের শারীরিক সমস্যায় ক্রমাগত ভুগতে থাকে। এদের মধ্যে পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, খিঁচুনি, ঘুমের ব্যাঘাত, অমনোযোগীতা, অতিচাঞ্চল্য, উদ্বিগ্নতা বা বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়া অন্যতম।
চিকিৎসা
অটিজম এমন একটি অসুস্থতা, মোটা দাগে যার কোনো প্রতিকার নেই। তবে কিছু চিকিৎসা এবং থেরাপির সাহায্যে অটিস্টিক শিশুর জীবন অনেকটাই স্বাভাবিক করে তোলা যায়। অটিজম মোকাবেলায় সফলতা নির্ভর করে, কত দ্রুত রোগটি ধরা পড়ছে তার উপর। প্রাথমিক অবস্থায় অটিজম নির্ণয় করতে পারলে নিবিড় পরিচর্যা, স্কুল ভিত্তিক শিক্ষণ পদ্ধতি এবং যথাযথ ঔষধের মাধ্যমে অটিজমকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অটিজম নিয়ে বহু কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে আমাদের সমাজে। অনেকে একে জিন-ভুতের কীর্তি মনে করে ওঝা-কবিরাজকে দিয়ে ঝাড়ফুঁকের বন্দোবস্ত করে থাকে, যা শিশুটির ভবিষ্যতকে শুধু আরো জটিল আর কঠিন করে তোলে। অটিজম সম্পর্কে সচেতনতাই পারে এর করাল গ্রাস থেকে আমাদের দূরে রাখতে।
Feature Image: cbc.ca