২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকের কথা। তখন চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাসের প্রকোপের ব্যাপারে জানা যায়। এরপর তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশ-দেশান্তরে। ইতিমধ্যে আমরা এ মহামারির তৃতীয় বছরে প্রবেশ করেছি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারির সময় ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: কোভিড-১৯ মহামারির পরে কি অন্য কোনো মহামারি হানা দেবে?
আলজেরীয় ঔপন্যাসিক আলবেয়ার ক্যমুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের কথা মনে আছে? সেখানে লেখক সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, “মহামারির জীবাণুরা মরে না, ওত পেতে থাকে কেবল আমাদের চোখের আড়ালে, সুযোগ পেলে আবার ফিরে ফিরে হানা দেয়।” এ কথা যে সত্য তার প্রমাণ মেলে ইতিহাস ঘাটলে। তাই কোভিড-পরবর্তী সময়ে আরেকটি মহামারি যে পৃথিবীতে আঘাত হানবে না, সেই কথা বলা যায় না। তবে সম্প্রতি টেডএক্স-এর এক বক্তৃতায় মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেন, “আমাদের সঠিক পদক্ষেপই কোভিড-১৯ কে পৃথিবীর সর্বশেষ মহামারি বানাতে পারে।” এক্ষেত্রে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। ‘উই ক্যান মেইক কোভিড-১৯ দ্য লাস্ট প্যানডেমিক’ শীর্ষক সেই বক্তৃতার পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
৬৪ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে রোমের বেশিরভাগ এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে সম্রাট অগাস্টাস এমন কিছু করেন, যা রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি। তিনি একটি স্থায়ী দমকল বাহিনী গড়ে তোলেন। আগুন নেভানোর কাজে তারা এমন বালতি ব্যবহার করতো (বালতির ছবি দেখিয়ে)। সম্রাট বুঝতে পেরেছিলেন, বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এ কাজে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন। কারণ, একজনের বাড়িতে আগুন লাগলে তা আশেপাশে থাকা সকলের বাড়ির জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
গত কয়েক বছরে আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি তা ভয়াবহ বৈশ্বিক অগ্নিকাণ্ডের মতোই ছিল। কোভিড মহামারি লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। তবে এখন থেকে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলে আমরা পরবর্তী মহামারি রুখতে পারব। সর্বোপরি, কোভিড কতটা ভয়ানক ছিল, তা বলা মুশকিল। তবে এ সময়ে ধনী-গরীবের মধ্যে স্বাস্থ্যবৈষম্য বেড়েছে। কারো জীবনযাপনের মান নির্ভর করে তার আয়, জাতিগত পরিচয় ও বসবাসের সামগ্রিক পরিবেশের উপর। তাই আমাদের উচিত এমন এক পৃথিবী গড়ে তোলা যেখানে প্রত্যেকেই স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনশীল জীবনযাপন করতে পারবে। সেখানকার জনজীবন কোভিড-পরবর্তী বিপর্যয়ের ব্যাপারে আশঙ্কামুক্ত থাকবে।
২০১৫ সালের কথা। তখন এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে অন্যদের মতো আমিও বলেছিলাম, আমরা মহামারির জন্য প্রস্তুত নই; সংক্রামক ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত। কিন্তু অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হচ্ছে, মানুষ তখন সেটি আমলে নেয়নি। সত্যি বলতে, বক্তৃতাটি অনেক মানুষ শুনেছে। তবে তাদের মধ্যে প্রায় নব্বই শতাংশরেই সেটা শুনতে খুব দেরি হয়ে গেছে।
তো, আমি মনে করি, এখন বিষয়টি খুব পরিষ্কার। মহামারির এই সময়ে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। আদতে, কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার ঐ সময়ে অনেক কিছু করা হয়েছে, আবার অনেক কিছুই করা হয়নি। তাই আমি মনে করি, মহামারির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান এখন আমাদের কাছে আছে। কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে কোভিড-১৯ পৃথিবীর সর্বশেষ মহামারি হতে পারে। সেই পদক্ষেপগুলো কী হতে পারে? পদক্ষেপগুলো কীভাবে নেওয়া যেতে পারে?
রোমানদের কথায় ফেরা যাক। দেখা যাক, তারা কী করেছিল। ভেবে দেখুন, সময়ের সাথে সাথে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে আমরা কীভাবে এগিয়েছি। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করা আসলে একটি বিস্তৃত ব্যাপার। এ কাজে ভালো অর্থায়নের দরকার হয়। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেমন, এখনই যদি অ্যালার্ম বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এখানকার সবাই জানে যে আমাদের শান্তভাবে জড়ো হয়ে বাইরে যেতে হবে, এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা জানি, সাহায্য আসবে। কারণ, আমাদের প্রচুর অনুশীলনকারী ও প্রশিক্ষিত দমকলকর্মী আছে। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ৩,৭০,০০০ পূর্ণকালীন দমকলকর্মী আছে। আমি আনুমানিক যে সংখ্যাটি বললাম, বাস্তবে দমকলকর্মীর সংখ্যা এর থেকে বেশিও হতে পারে। আগুন নেভানোর কাজে দমকলকর্মীদের জন্য সেখানে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থাও করা আছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় নয় মিলিয়ন ফায়ার হাইড্রেন্ট (অগ্নিজনিত দুর্ঘটনা রোধে রাস্তার ধারে স্থাপিত একধরনের পানির কল, যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়) আছে। মহামারি প্রতিরোধের বেলায়ও আমাদের অনুরূপ বিনিয়োগ, অনুশীলন ও সিস্টেমের প্রয়োজন হবে।
সিনেমার পর্দায় সচরাচর এমন মহামারির দৃশ্য দেখা যায়। সেখানে মহামারি প্রতিরোধের যে কৌশলসমূহ দেখানো হয় তাতে আমি বরাবরই মুগ্ধ হই। এখন একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। এটা বেশ উপভোগ্য (একটি সিনেমার ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে)। এক্ষেত্রে আমরা সঙ্গীত উপেক্ষা করে যেতে পারি, তবে এখানে মূলত যা ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, একটি অঞ্চলে রোগের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই আক্রান্ত স্থানে একদল চিকিৎসক পৌঁছে গেছেন। আক্রান্ত স্থানে পৌঁছানোর জন্য তাদের হেলিকপ্টার রয়েছে। তারা সেখানে পৌঁছে সঠিক সরঞ্জামও হাতে পেয়েছেন। আসলে কোথাও কোনো রোগের প্রকোপ দেখা গেলে এমনটি ঘটাই কাম্য।
তবে সিনেমার মতো বাস্তবে আমাদের কোনো জনবল নেই, হাতে সঠিক চিকিৎসা সরঞ্জামও নেই। নিম্ন আয়ের কোনো দেশে এ ধরনের কোনো প্রকোপ দেখা দিলে, সেখানে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে পৌঁছাতেই কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। সিনেমায় দেখা সত্ত্বেও, এমন বিপর্যয় রোধে আমাদের কাছে কোনো পেশাদার বাহিনী নেই। সুতরাং, আমাদের নতুন করে একটি পেশাদার বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। জার্ম (GERM) নামে এ বাহিনীর নামকরণের কাজ সারা যেতে পারে। জার্ম (GERM) গ্লোবাল এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড মোবিলাইজেশন (Global Epidemic Response and Mobilization) এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
জার্ম কর্মীরা সার্বক্ষণিকভাবে অর্পিত কাজে নিয়োজিত থাকবে। মহামারি প্রতিরোধ করাই হবে তাদের প্রধান কাজ। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এ বাহিনী গঠিত হবে। এতে থাকবেন এপিডেমিওলজিস্ট, ডেটা সায়েন্টিস্ট, লজিস্টিক বিশেষজ্ঞগণ। তবে বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞান থাকাটাই তাদের কাজের জন্য পর্যাপ্ত হবে না। যোগাযোগ ও কূটনৈতিক দক্ষতাও তাদের থাকতে হবে। এ বাহিনীর জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে। বাহিনীতে থাকা ৩,০০০ কর্মীর জন্য বছরে এক বিলিয়নেরও বেশি অর্থ ব্যয় হবে।
কোনো সংক্রামক রোগ মহামারি আকার ধারণ করার পূর্বে তার অবসান ঘটানোই হবে তাদের প্রধান লক্ষ্য। কাজের সামগ্রিক তদারকিতে থাকবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। জার্ম বাহিনীর কর্মীরা সারা বিশ্বের বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য সংস্থায় নিযুক্ত থাকার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে উপস্থিত থাকবেন। আয় স্তরের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের জাতীয় দলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে তাদের উপস্থিতি বেশি থাকবে। যেমন ধরুন, আবুজায় (নাইজেরিয়ার রাজধানী শহর) অবস্থিত আফ্রিকা সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) অফিসের বাইরে কর্মরত জার্ম কর্মীদের আমরা মহামারি বিশেষজ্ঞ বলতে পারি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দমকল বাহিনীর কর্মীদের মতো জার্ম বাহিনীর কর্মীদেরও প্রচুর অনুশীলন করতে হবে। বিপদ দেখা মাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সদাপ্রস্তুত থাকতে চাইলে, তাদের কাজের গতি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অনুশীলন হবে সাফল্যের চাবিকাঠি। অনুশীলনের মাধ্যমে কাকে কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে সেই সম্পর্কে আগে থেকে অবগত হওয়া যাবে। আর যখন কোনো রোগের প্রকোপ থাকবে না, তখন জার্ম বাহিনীর কর্মীরা অন্যান্য সংক্রামক রোগের উপর কাজ করার মাধ্যমে নিজেদেরকে আরও দক্ষ করে তুলতে পারবে; তবে এটা হবে তাদের দ্বিতীয় প্রধান কাজ। তারা বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যখাত শক্তিশালীকরণে ভূমিকা রাখবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে নতুন ধরনের উপসর্গ দেখা যাওয়া মাত্রই জার্ম বাহিনীকে সেদিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে আপনাকেও বিভিন্ন বিষয়ে জানতে হবে। যেমন, এটা কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব কিনা? প্রাদুর্ভাব ঘটলে এর জন্য কোনো নতুন ধরনের প্যাথোজেন (রোগ সংক্রমণ এজেন্ট, যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ইত্যাদি) দায়ী কিনা? নতুন কোনো প্যাথোজেনের কারণে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে তার জিনোম সিকোয়েন্স কী?
এক্ষেত্রে প্রথম ১০০ দিনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে ধরতে হবে। ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং, ভাইরাস সংক্রমণের হার কম থাকা অবস্থায় কাজ শুরু করা গেলে এর সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে। কোভিড মহামারি শুরুর পরবর্তী ১০০ দিনের মধ্যে এর অবসান ঘটানো গেলে ৯৮ শতাংশেরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচানো যেত। অবশ্য এমন অনেক দেশ আছে যারা বেশ ভালো কাজ করেছে। অস্ট্রেলিয়া এর একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ। দেশটি তাদের ডায়াগনস্টিক সক্ষমতা বাড়িয়েছে। সামাজিক দূরত্ব নীতি এবং কোয়ারেন্টিন নীতি কঠোরভাবে মেনে চলেছে। এ কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ায় মাথাপিছু মৃত্যুর হার ১০ শতাংশেরও কম ছিল। তবে আমার এমনটি করতে পারেনি। এবং পরেরবার আমাদের এটি করতেই হবে।
আগুন নেভানোর কাজ ব্যবহৃত বালতি আর দমকল বাহিনীহীন প্রাচীন রোম যেমন নাজুক অবস্থায় ছিল, কোভিড শুরুর ঐ সময়ে আমাদের অবস্থাও ঠিক তেমনটিই ছিল। আমাদের জনবল ছিল না, ছিল না কোনো সিস্টেম কিংবা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও। কিন্তু এখন সঠিক বিনিয়োগের ফলে আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্মের চিকিৎসা সরঞ্জাম, ভালো ডায়াগনস্টিক সিস্টেম, প্রতিষেধক ও ভ্যাকসিন আছে। উন্নত ডায়াগনস্টিক যন্ত্রের ভালো উদাহরণ হতে পারে এই ছোট যন্ত্রটি। এর নাম লুমিরা (Lumira)। বিশ্বজুড়ে যেকোনো রোগের পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য এটি ব্যাপকহারে ব্যবহার করা যেতে পারে। পিসিআর ল্যাব টেস্টের মতো এটি ১০ম ব্যয়বহুল পরীক্ষা পদ্ধতি। এটি একেবারে নির্ভুল পরীক্ষা পদ্ধতি। এর ব্যবহারবিধিও সহজ। ফলে যেকোনো জায়গায় এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়াও উন্নত গবেষণার কাজে আমাদের আরো বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। আমাদের এমন ড্রাগ দরকার, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে সংক্রমণের হাত থেকে সুরক্ষা পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারটি আমার দারুণ লেগেছে। এ ধরনের ড্রাগ হবে প্যাথোজেনমুক্ত, যা মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। সকল চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে ডায়াগনস্টিক আর সংক্রমণ প্রতিরোধকারী সরঞ্জামগুলো আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ, এগুলো আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা যায়।
আমাদের ভ্যাকসিনেরও দরকার হবে, তবে বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পূর্বেই আমরা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব বন্ধ করতে চাই। এক্ষেত্রে ভ্যাকসিন ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে প্রাথমিক ভূমিকা নয়। এ কাজে আমাদের আরো বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। কোভিড মহামারির সময়ে ভ্যাকসিন খুব ভালো কাজ করেছে। ভ্যাকসিন লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, এটি সত্যি। তবে এটি আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারত। আমাদের এমন ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করতে হবে, যা সহজে সরবরাহ করা যাবে। আমাদের এমন ভ্যাকসিন দরকার, যা খুব সহজে বাহুতে লাগানো যাবে, কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করা যাবে। আমাদের এমন ভ্যাকসিন দরকার, যা সংক্রমণ রোধ করতে পারবে। মহামারির সময় জুড়ে সংক্রমণের হার ছিল যুগান্তকারী। তাই আমাদের এমন ভ্যাকসিন দরকার, যা সকল ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মহামারির এই সময়ে আমাদের হাতে এমন কোনো ভ্যাকসিন ছিল না। আমাদের এমন কারখানারও প্রয়োজন রয়েছে, যা ছয় মাসের মধ্যে সমগ্র বিশ্বের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষম হবে এবং একইসাথে সকলের আস্থা অর্জন করতে পারবে।
আসলে ভ্যাকসিন এমন আরও অনেক কিছুই করতে পারে, যা মহামারি রোধে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, উদ্ভাবিত নতুন ভ্যাকসিন করোনাভাইরাসের মতো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের গোটা গোত্র নির্মূলে সহায়তা করতে পারে। মহামারির রূপ না নিলেও প্রতিবছর এসব ভাইরাসে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়। তাই এসব ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে পারলে, এগুলো আর কখনই মহামারি সৃষ্টি করতে পারবে না। তাই আমি তিনটি খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের কথা ভাবছি। এর প্রথমটি হলো রোগ পর্যবেক্ষণ করা। রোগ পর্যবেক্ষণের কাজটি জার্ম বাহিনী করবে। এক্ষেত্রে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (R&D) টুলগুলো ভালো কাজ করবে। মোটকথা, স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজাতে হবে। এ কাজ সস্তায় হবে না, তবে এতে বহু মানুষের জীবন বাঁচবে। ফলে ভবিষ্যতের খরচ কমবে। সিস্টেমটি অনেকটা ইন্স্যুরেন্স পলিসির মতো কাজ করবে।
কোভিড-পরবর্তী মহামারি নির্মূলে প্রায় দশ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। যে বিনিয়োগগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর সাথে মহামারি মোকাবেলার খরচের ব্যাপারটি তুলনা করা যাক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যানুযায়ী, কোভিডের জন্য প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, পরবর্তীতে ট্রিলিয়ন ডলার বাঁচানোর জন্য আমাদের এখনই বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে।
এখন এ বিনিয়োগের অন্যান্য সুফল নিয়ে বলা যাক। যখন কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব থাকবে না, তখনও লুমিরা আর নতুন ভ্যাকসিনের মতো বিনিয়োগগুলো আমাদেরকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে। সেই সাথে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যকার স্বাস্থ্যবৈষম্য কমিয়ে আনা যাবে। যেমন ধরুন, দেশগুলোতে হয়তো আরো ব্যাপকভাবে এইচআইভি সন্ধানের জন্য পরীক্ষা করা যাবে। এবং আক্রান্তদের জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে। আবার ম্যালেরিয়াজনিত মৃত্যুর হারও কমিয়ে আনা যাবে। ফলে বহু মানুষ উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পাবে।
যে বিনিয়োগগুলোর কথা বললাম, সেগুলো করলে কেবল সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়া থেকে রুখতে প্রস্তুতিই হবো না আমরা; এর বাইরে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য সুফলও মিলবে। একবাক্যে বললে, আমাদের সঠিক পদক্ষেপই কোভিড-১৯ কে পৃথিবীর সর্বশেষ মহামারি বানাতে পারে। একইসাথে এ বিনিয়োগগুলোর মাধ্যমে আমরা সকলের জন্য আরো স্বাস্থ্যকর ও ন্যায়সঙ্গত বিশ্বও গড়ে তুলতে পারব।