খাবার খেতে গিয়ে মনে হচ্ছে ঠিক করে গলা দিয়ে নামছে না খাবারটা? গলা কিংবা তার নিচে গিয়ে কোনো না কোনো স্থানে আটকে আছে বলে অনুভব করছেন? এই অনুভূতিটা কেবল আপনার একার নয়। আরো অনেকে আছেন যাদের খাবার খেলে কিংবা পানি পান করলেও গলায় আটকে যাওয়ার অনুভূতি হয়। ব্যাপারটিকে অবহেলা করে যান অনেকে। ভাবেন, গলায় পানি আটকে যাওয়াটা হাস্যকর। খাবার আটকে গেলেও সময় নেন অনেক। মনে করেন ঠিক হয়ে যাবে। পুষে রাখেন সমস্যাকে নিজেদের মধ্যেই। তবে আপনি কি জানেন যে, গলায় খাবার এবং পানি আটকে যাওয়ার এই সমস্যাটিরও একটি নাম আছে। হাস্যকর কিংবা হুট করে হওয়া কিছু নয়, ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটু অন্যরকম এই সমস্যাটির নাম ডিসফ্যাগিয়া।
ডিসফ্যাগিয়া
ডিসফ্যাগিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা খাবার কিংবা পানি- যেকোনো কিছুই গলা থেকে পেট পর্যন্ত স্থানান্তরিত করতে যথেষ্ট ঝামেলা পোহান। কখনো কখনো সেটা অসম্ভব বলে মনে হয়। খাবার খাওয়ার মতো সাধারণ ব্যাপারটি হয়ে পড়ে যন্ত্রণার মতো। কেবল খাবার গিলতে কিংবা পানি পান করতেই যে সমস্যা হয় তা না, এই ক্ষেত্রে মানুষের খাদ্যনালীতে ও বুকে ব্যথাবোধ হয়। মাঝেমধ্যে এমনটা হতেই পারে। খুব দ্রুত খেতে চেষ্টা করলে কিংবা ভালো করে না চিবিয়ে খাবার খেলে এমনটা হতেই পারে। কিন্তু সেটা ডিসফ্যাগিয়ার মধ্যে পড়ে না। ডিসফ্যাগিয়ায় আক্রান্তদের খাবার ও পানি সংক্রান্ত এই সমস্যা সবসময়েই হয়ে থাকে। আপনার যদি এই সমস্যাটি নিয়মিত হতে থাকে সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে, আপনি ডিসফ্যাগিয়ায় আক্রান্ত। ডিসফ্যাগিয়া সব বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে এই সমস্যাটি বেশি দেখা যায় বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে। শারীরিক নানা পরিবর্তনের কারণেই খাবার কিংবা পানি পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছতে বেশ কষ্ট হয় তাদের।
ডিসফ্যাগিয়ায় লক্ষণ
হ্যাঁ, ডিসফ্যাগিয়ায় প্রধান এবং প্রাথমিক লক্ষণ খেতে কিংবা পান করতে গিয়ে সমস্যায় পড়া, গলায় খাবার কিংবা পানি আটকে যাওয়া। তবে এছাড়াও আরো বেশ কিছু লক্ষণ আছে যেগুলো দেখে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন আপনার ডিসফ্যাগিয়া আছে কিনা। লক্ষণগুলো হলো-
- খাবার খাওয়া বা পানি পানের সময় ব্যথা বোধ করা। এই সমস্যাটিকে বলা হয় ওডিনোফ্যাগিয়া। ডিসফ্যাগিয়া এবং ওডিনোফ্যাগিয়ার মধ্যে খুব বেশি পার্থ্যক্য নেই। এই ক্ষেত্রে গলা, বুক, পিঠ এবং পেট পর্যন্ত ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে।
- খাবার গিলতে না পারা
- খাবার কিংবা পানি গলায় কিংবা খাদ্যনালীতে আটকে গিয়েছে বলে মনে হওয়া। মাঝেমধ্যে পানি পানের সময় গলায় জোরে আঘাত লাগা।
- কম্পন অনুভব করা
- গলা কর্কশ হয়ে যাওয়া
- অস্বাভাবিক ওজন কমে যাওয়া
- খাবার খুব ছোট টুকরো না হলে না খেতে পারা
- হৃদপিণ্ড জ্বালাপোড়া করা
- খাবার গেলার সময় কফ কিংবা অন্যকিছুতে কন্ঠরোধ হয়ে আসা ইত্যাদি।
এই লক্ষণগুলোর বেশিরভাগ যদি আপনার সাথে মিলে যায় তাহলে আর অপেক্ষা না করে চিকিৎসকের কাছে চলে যান। অনেক সময় এই সাধারণ সমস্যার কারণেই আপনার শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটি হয়ে যাবে অনেক বেশি জটিল। তাই এই ধরনের সমস্যা আপনার থেকে থাকলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে আসুন।
ডিসফ্যাগিয়া এবং ওডিনোফ্যাগিয়া: পার্থক্য কী?
অনেকেই ডিসফ্যাগিয়া এবং ওডিনোফ্যাগিয়াকে এক করে ফেলেন। তাদের জন্য দুটোকেই এক মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে এই দুটো একেবারেই ভিন্ন দুই জিনিস। ডিসফ্যাগিয়া মানে শুধুই খাবার খাওয়ার সময় কিংবা পানি পান করার সময় সমস্যা বোধ করা। অন্যদিকে ওডিনোফ্যাগিয়া তৈরি হয় যখন খাবার কিংবা পানি গ্রহণের সময় মানুষ ব্যথা অনুভব হয়। এই দুটো সমস্যা কোনো মানুষের একইসাথে হতে পারে। যার গলায় খাবার আটকে যাওয়ার সমস্যা আছে তার যে ব্যথা থাকতেই হবে এমনটা কিন্তু নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডিসফ্যাগিয়া এবং ওডিনোফ্যাগিয়া একসাথেই হয়ে থাকে।
ডিসফ্যাগিয়ার কারণ ও রকমভেদ
যেকোনো সমস্যার পেছনেই কোনো না কোনো কারণ থাকে। ডিসফ্যাগিয়ার পেছনের আছে কিছু কারণ। তবে সেগুলোকে একদম নির্দিষ্ট করে নির্ধারণ করা যায় না। ডিসফ্যাগিয়া নানারকম হতে পারে। আর এই রকমভেদের উপর নির্ভর করে সেগুলোর নানারকম কারণও থাকতে পারে।
১) খাদ্যনালীর ডিসফ্যাগিয়া
খাদ্যনালীর ডিসফ্যাগিয়া মূলত খাবার গলা এবং বুকের মাঝামাঝি অবস্থানে আটকে থাকাকে বলে। খাবার গিলতে শুরু করার ঠিক পরপরই এমনটা হয়ে থাকে। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আকাল্যাজিয়া। খাদ্যনালীর নিম্নাংশ শিথিল না হওয়ার কারণে এমনটা ঘটে থাকে। খাদ্যনালীর দেয়াল দুর্বল হওয়ার কারণেও এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। এছাড়াও খাদ্যনালীতে যথেষ্ট স্থান না থাকা, টিউমার বা সাধারণ গ্যাসও হতে পারে ডিসফ্যাগিয়া হওয়ার কারণ। অনেক সময় আমাদের খাদ্যনালী ঠিক যতটা চাপ নিতে পারে তার চাইতেও অনেক বেশি বা অনেক বড় কোনো খাবার খেয়ে ফেললে সেটা খাদ্যনালীতে আটকে যায় আর তৈরি করে সমস্যা। কেবল খাবার নয়, অন্য যেকোনো উপাদানও খাদ্যনালীর এই অংশটুকুকে বন্ধ করে দিতে পারে। পাকস্থলী থেকে আগত কোনো এসিড খাদ্যনালীতে প্রভাব ফেলতে পারে। এতে করে আমাদের খাদ্যনালী নতুন করে কোনো খাবার এলে সেটা প্রক্রিয়াজাত নিতে সক্ষম হয় না। খাদ্যনালীর কোনো টিস্যুতে সমস্যা দেখা দিলে কিংবা কোনো খাবারে এলার্জি থাকলেও খাদ্যনালীর ডিসফ্যাগিয়া হতে পারে। আর কেউ যদি ক্যান্সারের কারণে থেরাপি নিয়ে থাকেন তাহলেও ডিসফ্যাগিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
২) গলার ডিসফ্যাগিয়া
অনেক সময় নানারকম কারণে আমাদের গলায় সমস্যা দেখা দেয়। গলা খাবার খাদ্যনালী এবং পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সক্ষম হয় না। ফলে জন্ম নেয় গলার ডিসফ্যাগিয়া বা অরোফারিঞ্জিল ডিসফ্যাগিয়া। এতে করে খাবার এবং পানি পানের সময় আপনার নাক ও গলায় প্রভাব পড়তে পারে। কফ, সর্দির মতো ব্যাপারগুলো জন্ম নিতে পারে। এমনকি সমস্যা নিউমোনিয়া পর্যন্ত চলে যেতে পারে। এই ধরনের ডিসফ্যাগিয়ার পেছনে থাকতে পারে স্নায়ুজনিত কোনো সমস্যা, যেমন- মাসকিউলার ডিস্ট্রোফি, পারকিনসন্স ডিজিজ ইত্যাদি। এছাড়াও স্নায়ুতে কোনো আঘাত লাগলেও এমনটা ঘটতে পারে। কিছু ক্যান্সারের প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা প্রক্রিয়াগুলোই সমস্যা তৈরি করে।
ডিসফ্যাগিয়ার কারণ হিসেবে উপরোক্ত ব্যাপারগুলোকে দেখা হলেও উল্টো করেও পুরো ব্যাপারটিকে দেখা যায়। আপনি যদি বোঝেন যে আপনার ডিসফ্যাগিয়া আছে সেক্ষেত্রে আপনার মধ্যে স্নায়ুজনিত সমস্যা এবং স্ট্রোক বা পারকিনসন্স ডিজিজের মতো ব্যাপারগুলো থাকার আশঙ্কাও অনেক বেড়ে যায়। ফলে আপনি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়ে যান স্বাভাবিকভাবে। এছাড়াও ডিসফ্যাগিয়ার কারণে ওজন কমে যেতে পারে। অপুষ্টি, নিঃশ্বাস আটকে যাওয়া, এমনকি নিউমোনিয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে ডিসফ্যাগিয়ার কারণে।
সমাধান
ডিসফ্যাগিয়ার কোনো সমাধান নেই। পুরোপুরিভাবে এই সমস্যার হাত থেকে আপনি কখনোই রেহাই পাবেন না। তবে এর পরিমাণ বা প্রভাব কমিয়ে আনতে পারেন আপনি ধীরে ধীরে খাবার খেয়ে। এছাড়া চেষ্টা করুন খাবার ভালো করে চিবিয়ে তারপর গিলে ফেলার। এতে করে ডিসফ্যাগিয়া দেখা দেবে কম।
ফিচার ইমেজ: Czeshop.info