There is a way to do it better- find it
– টমাস আলভা এডিসন
আধুনিক বিশ্বে নিত্যনতুন গবেষণার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় কী কী পরিবর্তন আসছে তার খোঁজখবর রাখা আবশ্যক। স্বাস্থ্যসেবা একটি ক্রমিক পরিবর্তনশীল ক্ষেত্র। টেলিকমিউনিকেশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তিই অনেকটা নির্ধারণ করে দেয় কেমন হতে যাচ্ছে আগামীর স্বাস্থ্যসেবা। সেরকমই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হলো এই লেখায়, যেগুলো চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে যাচ্ছে।
রোবোটিক্স
রোবট প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে সার্জারির ধারণা এখন অলীক কল্পনা নয়। সেই দিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন রোবটের মাধ্যমে সার্জারি করা খুবই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হবে। রোবোটিক ডেমো বডির মাধ্যমে মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং সার্জনরা সিমুলেশনের মাধ্যমে শিখবেন সার্জারি, করবেন নিত্যনতুন পরীক্ষানিরীক্ষা। রোবোটিক মস্তিষ্ক ধারণ করবে রোগীর বিবরণ আর রোগের ইতিহাসসহ রোগীর বিভিন্ন ডাটা। প্রস্থেটিক সার্জারিতে বিপ্লব আনবে রোবোটিকস। মাইক্রো বট, কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ সকল অঙ্গহানির প্রতিকার করবে রোবোটিক্স।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স
যদিও রোবোটিক্স এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কাছাকাছি বিষয়, কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সঙ্গীর মতো রোগীর সাথে থেকে তার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত ওষুধ সেবন, নিয়মিত পরীক্ষা ইত্যাদির ব্যাপারে তাকে নির্দেশনা দিতে পারে। এটি ক্যান্সার, জেনেটিক্যাল রোগবালাইসহ বিভিন্ন ধরনের ডায়াগনোসিসে সহায়তা করছে এবং ভবিষ্যতে এক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এছাড়া বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই প্রাথমিক ভূমিকা পালন করবে।
ত্রুটিপূর্ণ জিন মেরামত
ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীরা মানব ভ্রূণ থেকে একটি ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএ সরিয়ে জিন মেরামতে সক্ষম হয়েছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অগ্রগতির ফলে এরকম বংশ পরম্পরায় চলে আসা ১০ হাজারেরও বেশি ত্রুটি বা স্বাস্থ্য সমস্যা সংশোধন করার দরজা খুলে গেল। যে প্রক্রিয়ায় ভ্রূণ থেকে ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএটি দূর করা হয়েছে এই এডিটিং প্রযুক্তিকে বলা হয় ক্রিসপার। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক এবং এর মাধ্যমে জেনেটিক ত্রুটি সংশোধনের মাধ্যমে সিসটিক ফিব্রোসিস থেকে শুরু করে স্তন ক্যান্সারের মতো রোগও প্রতিরোধ করা সম্ভব।
স্বয়ংক্রিয় পিল
ক্রনিক রোগীদের ক্ষেত্রে তারা সঠিক সময়ে সঠিক ডোজ গ্রহণ করেছেন কি না তা মনে রাখতে অসুবিধা হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এমন নতুন পিল তৈরি করেছেন যাতে একটি ক্ষুদ্র সংবেদক রয়েছে যা এটি গ্রহণ করার সময় রেকর্ড করে এবং রোগীর গায়ে পরে থাকা ডিভাইস দ্বারা প্রেরণ করা তথ্য পরে একটি স্মার্টফোনে প্রেরণ করা হয়। রোগী এবং চিকিৎসক প্রয়োজনানুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা নিশ্চিত করতে পারেন। স্কিৎজোফ্রেনিয়া, আলঝেইমার্সসহ বিভিন্ন মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসায় ইতিমধ্যে ব্যবহৃত একটি উদ্ভাবন হতে পারে এই স্বয়ংক্রিয় পিল।
হতাশা শনাক্তকরণে স্মার্টফোন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ হতাশায় ভুগছেন এবং প্রতিবছর আত্মহত্যার কারণে প্রায় ৮,০০,০০০ মানুষ মারা যান, যা ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। হতাশায় আক্রান্তদের অর্ধেকেরও কম চিকিৎসা পান এবং অনেক দেশে এই সংখ্যা ১০% এরও কম। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সংস্থা বলেছে, স্মার্টফোন ব্যবহারকারী কীভাবে ফোনে ট্যাপ, স্ক্রল এবং ক্লিক করে এমন আচরণ বিশ্লেষণ করে স্মার্টফোনগুলো মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নির্ণয় করতে পারে, যা চিন্তাভাবনা এবং মেজাজের অবস্থার পূর্বাভাস দিতে পারে। ফোনগুলো বিভিন্ন ট্র্যাকার এবং অ্যাপের মাধ্যমে মানসিক রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করতে পারে।
কৃত্রিম অগ্ন্যাশয়
বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম অগ্ন্যাশয় হিসেবে অভিহিত হাইব্রিড ক্লোজ-লুপ ইনসুলিন ডেলিভারি সিস্টেম টাইপ ১ ডায়াবেটিসকে আরও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে। এফডিএ অনুমোদিত এই নতুন প্রযুক্তি অবিচ্ছিন্নভাবে রক্তের গ্লুকোজ স্থিতিশীল করার জন্য গ্লুকোজ নিরীক্ষণ ডিভাইস এবং ইনসুলিন পাম্পের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে এবং গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখে। প্রযুক্তিটি পূর্বের ‘ওপেন লুপ’ ধারণাকে প্রতিস্থাপন করে, যা রোগীদেরকে তাদের গ্লুকোজ মনিটর থেকে তথ্য ব্যবহার করার জন্য ইনসুলিনকে কতটা ইনজেকশন দিতে হবে তা নির্ধারণ করত।
প্রিসিশন মেডিসিন
প্রত্যেক মানুষের জেনেটিক স্বাতন্ত্র্য এবং জীবনধারণের আলাদা পারিপার্শ্বিকতা রয়েছে। প্রিসিশন মেডিসিন (Precision Medicine) রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের জন্য একটি পদ্ধতি, যা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জিন, পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার স্বতন্ত্র পরিবর্তনশীলতার বিষয়টি বিবেচনা করে। উদাহরণস্বরূপ, চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, গ্লিভেক (আইমেটিনিব) নামক একটি ড্রাগ যখন ক্যান্সারের কোষগুলোতে একটি নির্দিষ্ট জিনগত মেকআপ থাকে কেবল তখনই লিউকেমিয়া নিরাময়ের জন্য কাজ করে। সুতরাং, গ্লিভেক ব্যবহার করে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত বাকি সবার সাথে চিকিৎসা করার পরিবর্তে চিকিৎসকরা সেই নির্দিষ্ট জিনগত মেকআপবিশিষ্ট লোকদের পরীক্ষা করেন এবং কেবল তাদের মধ্যে ড্রাগ দেন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য গড়পড়তা ওষুধ না দিয়ে যা তার শরীরে কাজ করবে সেই ওষুধ ব্যবহার করার পদ্ধতিই হলো প্রিসিশন মেডিসিন।
নতুন ব্যথানাশক পদ্ধতি হিসেবে ক্লোজড-লুপ স্টিমুলেশন
অনেক রোগেই ক্রনিক ব্যথা খুবই কমন সমস্যা, এবং এটি Opioid ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়ার অন্যতম কারণ। ক্রনিক ব্যথার জন্য স্পাইনাল কর্ড স্টিমুলেশন একটি জনপ্রিয় চিকিৎসা, যার মাধ্যমে একটি ইমপ্লান্টযোগ্য ডিভাইস মেরুদণ্ডের কর্ডকে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা সরবরাহ করে এবং ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে। তবে এই ধরনের স্টিমুলেশনে সাবথেরাপিউটিক বা ওভারস্টিমুলেশন ইভেন্টগুলোর কারণে অসন্তুোষজনক ফলাফল ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে ক্লোজড-লুপ স্টিমুলেশন ব্যবহার করে ডিভাইস এবং মেরুদণ্ডের কর্ডের মধ্যে আরও ভাল যোগাযোগের মাধ্যমে আরও অনুকূল উদ্দীপনা এবং ব্যথার স্বস্তি লাভের অনুভূতি দিতে পারে।
নতুন ধরনের ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপি
এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে ক্যান্সারের রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়। এটি একটি কৌশল যাতে ইমিউন কোষগুলো সংগ্রহ করা হয় এবং তাদেরকে বিশেষ ক্যান্সার-প্রতিরোধী যোদ্ধা হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়, যাদের চিমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপ্টর বলা হয়। এই পদ্ধতিটি ইতোমধ্যে দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের এবং শিশুদের জীবন বাঁচিয়েছে। বর্তমানে স্তন, প্রস্টেট, কোলন, ডিম্বাশয়, অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারসহ আরও বিভিন্ন ক্যান্সারে কাজ করার উপযোগী করে তোলার জন্য বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। ২০১৮ সালে জেমস অ্যালিসন এবং তাসুকু হনজো ইনহিবিশন অফ নেগেটিভ ইমিউন রেগুলেশনের মাধ্যমে ক্যান্সারের চিকিৎসায় ইমিউন কোষের ব্যবহার নিয়ে গবেষণার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন।