‘আমার মা-বাবার জন্য আমার হিংসে হয়, তাদের ছেলের মতো এত সুবোধ একটা ছেলে আমার কখনোই থাকবে না’
বর্তমান ক্রিকেট দুনিয়াই পেস এবং সুইংয়ের বাহারি সাজ নিয়ে মাঠ মাতানো বোলাররাও তার সামনে বোলিং করতে দুরু দুরু পায়ে এগিয়ে যায়। বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান, যেমন- শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা কিংবা কেভিন পিটারসেন যার বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতে অস্বস্তি পেতেন, সেই ব্রেট লিকে তিনি আছড়ে ফেলেছেন গ্যালারিতে। তা-ও প্রায় নির্দ্বিধায়, অবলীলায়। দেখে মনে হবে এটা যেন তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।
তিনি ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল বা ক্রিস গেইল। নিজেকে ইউনিভার্সাল বস হিসেবে দাবি করা এই বাঁহাতি ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান নিজের স্বভাবের কথা বলতে গিয়ে মজা করে উপরোক্ত উক্তিটি করেন। সবাই যখন বলাবলি করছেন, ক্রিস গেইল উদ্ধত আচরণ করেন, তার আচরণে সমস্যা রয়েছে। তখন নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে কিংবা হয়তো বিনোদন দেয়ার জন্য নিজের ছেলেবেলার সময়ের গেইলকে তুলে ধরলেন সবার সামনে।
তবে উক্তিটিতে সরাসরি নিজেকে নিয়ে নিজে বললেন না তিনি। ব্যবহার করলেন না নিজের নাম। এমনকি উত্তম পুরুষে অর্থাৎ নিজের বর্ণনা দেয়ার দিকেও গেলেন না তিনি। কিন্তু নিজের ব্যাপারে বলা হয়ে গেলো। কারণ, তিনি বললেন তার মা-বাবার সন্তান। এখানে পরোক্ষভাবে নিজেকেই বুঝিয়েছেন তিনি।
মূলত এখানে ক্রিস গেইল নিজেকে তৃতীয় একজন ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি তিনি নিজেই। এতে করে সরাসরি নিজের প্রশংসা করার সমালোচনা থেকেও নিজেকে রক্ষা করা গেলো, আবার নিজের সম্পর্কে মূল বার্তাটাও দেয়া হলো।
ইলেইজম (Illeism) কী?
কোনো বক্তব্যে বা বার্তায় নিজেই নিজেকে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উদ্ধৃত করার প্রবণতাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ইলেইজম (Illeism) বলা হয়। মূলত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই টার্মটি অধিক ব্যবহৃত হয়। তবে প্রায় অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই এই টার্মটি ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। অনেকেই এই টার্মটি সম্পর্কে অজ্ঞ। এক্ষেত্রে তারা নিজের অজ্ঞাতসারেই নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করার পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
মূলত এই অভ্যাসটি ব্যবহার করে মানুষ তার নিজের চরিত্রের কিংবা আচরণের বিশেষ কিছু দিক উন্মোচন করতে চায়। ইলেইজম শব্দটি এসেছে মূলত ল্যাটিন শব্দ Ille থেকে, যার মানে হচ্ছে ‘সে’। এখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনের কারণে ‘সে’ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ১৮০৯ সালে স্যামুয়েল টেইলর কোলেরিজ প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। এই শব্দটি ফের আলোচনায় আসে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে। বলা হয়, ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ নিজেকে সরাসরি উপস্থাপন না করে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছেন। ব্যবহার করছেন তার নিজের নাম।
ইলেইজমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ ওসোফ চমৎকার এক উদাহরণ দেন। আমাদের উপমহাদেশের সাথে যাকে মিলিয়ে আমরা বাস্তবিক অর্থে উপস্থাপন করতে পারি। আমাদের দেশের নেতারা যখন নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসেন, তখন নিজেকে গবীরের কাতারের একজন হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
“আমি তো আপনাদেরই লোক, চিনতে পারছেন না? জেনে রাখবেন, অমুক ভাই আপনার পাশে থাকবে। সুদিনে কিংবা দুর্দিনে ভাইকে পাশে পাবেন আপনারা।”
নার্সিসিজমের সাথে পার্থক্য
নিজের প্রতি নিজেই মুগ্ধ হয়ে থাকার নাম হচ্ছে নার্সিসিজম। এখানে মূলত কোনো ব্যক্তি তার নিজের কোনো ব্যাপারের প্রতি নিজে এতটাই সন্তুষ্ট থাকেন যে নিজের সেই ব্যাপারটি ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি তিনি সহজে গ্রহণ করতে পারেন না। নিজের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা তৈরি হয়। সেটি নিজের কোনো বৈশিষ্ট্য কিংবা অবয়বেও হতে পারে।
কিন্তু ইলেইজমের ক্ষেত্রে এমনটি না-ও হতে পারে। ইলেইজমে মূলত নিজের কোনো দিক মানুষকে জানানোর তাগিদ থাকে। সেই তাগিদটা নার্সিসিজমে থাকে না। অন্যদিকে নিজেকে প্রকাশের সময় তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে বলা হয় ইলেইজমে। কিন্তু নার্সিসিজমে সরাসরি নিজের প্রতি নিজের মুগ্ধতা থাকে।
খ্রিষ্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই ইতিহাস ইলেইজমের উৎপত্তির কথা বলে। অনেকের মতে, প্রথম ইলেইজম ব্যবহার করা ব্যক্তিটি হলেন রোম সাম্রাজ্যের সেনাপতি জুলিয়াস সিজার। শেক্সপিয়রের রচনায় যার নমুনা আমরা পেয়েছি। এছাড়াও যুগে যুগে আমরা এই প্রবণতার নমুনা প্রায়ই দেখি।
ডালি অমর, সে কখনোই মরবে না
– চিত্রশিল্পী সালভাদর ডালি
তুমি যেখানেই যাও না কেন, সেখানেই সবার পরিচিত তিনটি আইকন খুঁজে পাবে। সেগুলো হলো- যীশু খ্রিষ্ট, পেলে এবং কোকা-কোলা
– ব্রাজিলিয়ান তারকা ফুটবলার পেলে
যদি এখানে ট্রাম্প না থাকতো, তাহলে ইমিগ্রেশন কথাটাই কেউ শুনতো না
– মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
এছাড়াও আমরা প্রায়ই টিভি ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার কিংবা কোনো আলাপচারিতায় দেখতে পারি তারা কীভাবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন।
দর্শনের ক্ষেত্রে নিজেকে জানার ওপর গুরুত্ব দেয়ায় আমরা মহাজ্ঞানী সক্রেটিসকে ধন্যবাদ দিয়ে থাকি। এছাড়াও তিনি বলে গেছেন, নিজের ভেতরের অংশকে জানাই হচ্ছে মূল সফলতা। কারণ ভেতরের চিন্তা কিংবা নিজের ব্যাপারগুলো ভাল করে জানলে নিজেকে শুধরে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। তবে ইলেইজমের ক্ষেত্রে ঘটে উল্টো ঘটনা। এখানে নিজের কোনো কাজকে যথার্থতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে নিজেকে যাচাই করার কোনো ধরনের সুযোগ থাকে না।
‘সাইআরস্কিভ’ নামের একটি প্রিপ্রিন্টে পাওয়া যায়, নিজের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি লম্বা সময় ধরে প্রভাব ফেলতে পারে। মানবিক এবং চিন্তার দিক থেকে নিজের যোগ্যতার রকমফের হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকতে পারে।
“এটি হচ্ছে প্রজ্ঞা সম্পর্কিত প্রথম অবধারণ এবং কার্যকর প্রক্রিয়া, যেটি প্রতিদিনের রুটিনের মাধ্যমে করা সম্ভব হয়, শিখে ফেলা যায় এমন আচরণ কীভাবে করতে হয়। এ নিয়ে বিস্তর কাজ করা হয়ে যায়।”
ইলেইজম নিয়ে গবেষণা করেছেন কানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ ইগোর গ্রোসমান। তার মতামতে তিনি এমনটিই জানান।
তবে গবেষকরা যে যা-ই বলুক না কেন, মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা তৈরি এবং তা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতার কারণ বের করার ক্ষেত্রে প্রায় সবাই একমত পোষণ করেছেন। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
কোনো একজন লোক আরেকজন লোকের সাথে আলাপ করছে। মানুষের স্বভাবজাত ধর্মে পরিণত হয়েছে নিজেকে জয়ী হিসেবে উপস্থাপণ করার মানসিকতা। তাই কথা বলার সময় সে অবশ্যই চাইবে সে যেন প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জিতে যায়। পরোক্ষভাবে জেতার সুযোগটাই তুলনামূলক সহজ। ফলে লোকটি আলাপ করার সময় কথার মাঝখানে নিজের ভালো কিংবা ইতিবাচক দিকগুলো বর্ণনা করার চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে যেহেতু রাজনীতিবিদরা সরাসরি নিজেদের কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন এবং নাম উল্লেখ করলে তাদের ক্ষেত্রে সহানুভূতি বেড়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। তাই তারা নিজেদের ক্যারিয়ার এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এমন ইলেইজম ব্যবহার করে থেকেন।
বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যেও ছিলো এমন প্রবণতা। ফলে আমরা ঢালাওভাবে এই বৈশিষ্ট্যকে মানুষের নীতিবাচক আচরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি না। একজন আদর্শবান ব্যক্তি যখন নিজের উদাহরণ এভাবে দেবেন তখন বুঝতে হবে তিনি ভিন্ন উপায়ে নিজের আদর্শকেই আমাদের সামনে মেলে ধরছেন।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/