করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ: যে বিষয়গুলো না জানলেই নয়

গত বছরের শেষের দিক থেকে বিশ্বে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক জায়গায় রোগ নিয়ন্ত্রণে আসতে না আসতেই নতুন আরেক জায়গাতে করোনার উপদ্রব দেখা দেয়। সহজভাবে বোঝার জন্য একে অনেক বিজ্ঞানী সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তুলনা করেছেন। ঢেউ যেমন করে একটার পর একটা পাড়ে ভেঙে পড়ে, সেরকম করোনার ধাক্কাও একটার পর একটা আসতে পারে বলে তারা মনে করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কার্যকরী ভ্যাক্সিন আবিষ্কার না হচ্ছে।

এটা অনেকটা ফ্লু-র মতো। প্রতি বছর শরতের শেষ থেকে আরম্ভ করে শীতকাল অবধি ফ্লু হয়ে থাকে, এরপর উষ্ণ আবহাওয়াতে রোগের প্রকোপ একদমই কমে যায়। নতুন করে শীতকাল আসতে থাকলে আবার প্রকোপ বাড়তে থাকে। এভাবে তরঙ্গের মতো এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে-কমে। করোনার বেলাতেও সেরকম হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ ধারণা করছেন।

সারা বিশ্বই এখন করোনায় পর্যুদস্ত © Brian Stauffer/Foreign Policy

সেকেন্ড ওয়েভ কী?

আমরা এখন আছি করোনার প্রথম ধাক্কা, বা ফার্স্ট ওয়েভে। মার্কিন সরকারের করোনা বিষয়ক উপদেষ্টা ডক্টর অ্যান্থনি ফাউচির মতে, যখন প্রতিদিনের হিসেবে নতুন আক্রান্ত করোনা রোগীর সংখ্যা হবে হাতেগোনা (দশের কম), তখন আমরা ধরে নিতে পারি যে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এই পরিস্থিতি নির্দেশ করে প্রথম ওয়েভের সমাপ্তির। ঢেউ বা ওয়েভের আকারে রোগের প্রাদুর্ভাব নতুন কিছু নয়। মধ্যযুগে বিউবোনিক প্লেগ এবং ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জাও বেশ কয়েকটি ওয়েভের আকারে আঘাত হেনেছিল। শীতকালীন সর্দি-কাশির কথাই চিন্তা করে দেখুন। শীত চলে গেলে এই সমস্যা সাধারণত চলে যায় এবং পরের শীতে আবার আসে। এটাও ঋতুর সাথে রোগ বাড়া-কমা বা ওয়েভের নির্দেশ করে।

স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা/ফ্লু-র তিনটি ওয়েভ; Image Source: consultant360.com

বলে রাখা ভাল, নতুন রোগীর সংখ্যা কত হলে প্রথম ওয়েভ শেষ হয়েছে বলা যাবে এবং এর পর কত রোগী পেলে সেকেন্ড ওয়েভের আরম্ভ ধরা হবে এ ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই। এটা পুরোটাই নির্ভর করে বিশেষজ্ঞদের নিজস্ব ধ্যানধারণার ওপর। তবে এটাও ঠিক সেকেন্ড ওয়েভ চিহ্নিত করতে গেলে নতুন রোগীর সংখ্যা অনেকদিন কম থাকার পর আবার নির্দিষ্ট সময় ধরে বাড়তে থাকতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে একটি-দুটি নতুন কেস পেলেই তা সেকেন্ড ওয়েভের আগমন ঘোষণা করে না। উদাহরণ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের কথাই ধরা যাক। চব্বিশ দিন নতুন কোন ইনফেকশন না পাওয়ার পর নতুন করে দুজন রোগী সেখানে সনাক্ত হয়েছে। এতে করে এখনই বলা যাবে না যে তাদের সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে। যদি দ্রুত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং হাজার হাজার নতুন করে করোনাতে আক্রান্ত হয় তাহলে সেই ভয় করা যেতে পারে।

চীনের কথাও ধরা যাক। পঞ্চাশ দিন শূন্য নতুন রোগীর পর নতুন কেস চিহ্নিত হয়েছে, তবে তা সেকেন্ড ওয়েভ দাবি করার জন্য যথেষ্ট নয়। অনেক বিজ্ঞানী অবশ্য মনে করেন, ইরানে রোগ কমে যাবার পর নতুন করে আবার বেড়ে যাওয়া সেকেন্ড ওয়েভের শর্তাবলি পূরণ করে।

ওয়েভ আকারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তাত্ত্বিক ধারণা ©Robert Roy Britt/CIDRAP

কেন আসতে পারে সেকেন্ড ওয়েভ?

মূলত দুটি কারণ হতে পারে

১) ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন। এর ফলে একদিকে যেমন করোনা দুর্বল হতে পারে, আবার মুদ্রার উল্টো পিঠে এর আরো ভয়াবহ সংস্করণ চলে আসতে পারে। দ্বিতীয়টি হলে আমাদের জন্য তা হবে ভয়ঙ্কর।

Image Source: Visual Science/LA Times

২) উপসর্গবিহীন বহু মানুষ করোনা ভাইরাস বহন করে বেড়াচ্ছেন। তাদের চিহ্নিত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তারা যখন সামাজিক দূরত্ব এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক সতর্কতা মেনে চলতে ব্যর্থ হন তখন অজান্তেই আরেকজন মানুষের শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে দিতে পারেন। ভাইরাস শরীরে সংরক্ষণ করে রাখা এই মানুষগুলোর কাছ থেকে নতুন করে রোগ ছড়িয়ে পড়বার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রথম ওয়েভেই সম্ভবত বহু লোক এভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে মনে করে সমস্ত সতর্কতা তুলে নেয়া হলে বহু সংখ্যক মানুষ অনুমিতভাবেই আবার হঠাৎ একসাথে মেলামেশা শুরু করবেন। এতে নতুন করে রোগের বিস্ফোরণ হবার সম্ভাবনা আছে।  

সামাজিক বিধিনিষেধ মানুষ কতটুকু মানছে? © Stringer/Xinhua

ঝুঁকিতে কারা?

এশিয়া-প্যাসিফিক অণুজীব ও সংক্রামক ব্যাধি সংস্থার (Asia-Pacific Society of Clinical Microbiology and Infection) ডক্টর ট্যাম্বায়াহ মনে করেন, প্রতিদিন যেসব দেশ হাজার হাজার নতুন রোগীর সন্ধান পাচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রেই সেকেন্ড ওয়েভের শঙ্কা বেশি। ভারত, যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যে এক মিলিয়ন ছাড়িয়েছে এবং প্রতিদিন কম করে হলেও দশ থেকে বিশ হাজার রোগী সনাক্ত হচ্ছে, তারা এই তালিকার প্রথমদিকেই থাকবে। এর পর আসবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।  তার এখনও প্রথম ওয়েভেই আছে এবং সেখানে করোনার বিস্তার দেখে মনে হচ্ছে না সহসা পরিস্থিতির উন্নতির কোনো সম্ভাবনা আছে। ব্রাজিল আর রাশিয়াও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে তাদেরও সেকেন্ড ওয়েভের কথা মাথায় রাখতে হবে। 

যেসব দেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে তাদের কী অবস্থা? নিউজিল্যান্ডের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়াও কিন্তু রোগ দেখা দেবার পরেই তড়িৎ ব্যবস্থা নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিল। সেখানে এখন ১২ হাজারের উপর রোগী রয়েছে, এবং নতুন করে প্রতিদিন ৪০-৬০ জন আক্রান্ত হচ্ছে। এখানে রোগতত্ত্বের অধ্যাপক কি মোরান এই বলে হুঁশিয়ার করেছেন যে, নতুন করে কড়াকড়ি আরোপ না করলে প্রতিদিন এখানে আটশোর বেশি রোগী আক্রান্ত হতে পারে। জাপানেও একই অবস্থা। পরিস্থিতির উন্নতির পরে টোকিও শহরে নতুন করে রোগী বাড়ছে। সুতরাং সঠিক পরিকল্পনা না করলে তারাও করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কার সম্মুখীন হতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়া কি সেকেন্ড ওয়েভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? © European CDC

কী হতে পারে সেকেন্ড ওয়েভে?

যখন প্রথম করোনাভাইরাসের অতিমারির সূচনা হয়, তখন সর্বোচ্চ একজন সংক্রমিত ব্যক্তি তিনজন পর্যন্ত লোককে আক্রান্ত করতে পারতেন। তবে পরের দিকে সংক্রমণের মাত্রা শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর টিল্ডেসলির মতে, সেকেন্ড ওয়েভের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে সংক্রমণের হার ফার্স্ট ওয়েভের থেকে অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে।

প্রভাব

করোনা প্রভাবে এর মধ্যেই বহু ব্যবসা-বাণিজ্য পথে বসেছে। জীবিকা হারিয়েছে অনেক মানুষ। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তার ফলে অনেকে সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন, যা হয়তো মধ্য ও নিম্ন আয়ের অনেক দেশেই চিন্তা করা যায় না। ফলে অর্থনীতি পড়ে গেছে চরম বিপর্যয়ের মুখে। সুতরাং প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও আমাদের সামনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পেতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এর মধ্যে যদি নতুন করে সেকেন্ড ওয়েভের আবির্ভাব হয় তাহলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পুরো প্রক্রিয়াই হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। যেসব ব্যবসা কোনোমতে টিকে আছে তারাও হয়তো আর টিকে থাকতে পারবে না। আর সরকারের ব্যয়ও এত বেড়ে যাবে যে অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব কয়েক বছর থাকতে পারে।

আরেকটি সমস্যা হলো সময়। অনেক বিজ্ঞানীই ধারণা করছেন, আসছে শীতেই হয়তো সেকেন্ড ওয়েভের সূচনা হতে পারে। শীতকাল এমনিতেই ফ্লু সিজন। এর সাথে করোনা যোগ হলে যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হবে তাতে এরই মধ্যে করোনার চাপে পর্যুদস্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভেঙে পড়তে সময় বেশি লাগবে না। ফলে মৃত্যুহার আবার বেড়ে যেতে পারে।

করোনা অতিমারিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে; Image Source: lark.com

প্রতিকার কী?

করোনা প্রতিরোধে নিয়ম মেনে চলার বিকল্প নেই; Image Source: ajuntament.barcelona.cat

মোটা দাগে বলতে গেলে ভ্যাক্সিন বাজারে আসা পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে এই রোগ থেকে মুক্তি নেই। এর আগপর্যন্ত সামাজিক বিধিনিষেধ বজায় রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কড়াকড়ি উঠিয়ে নিলেও নিজেদের স্বার্থেই আমাদের উচিত হবে সতর্কতা মেনে চলা। আমরা যদি সচেতন হই তাহলেই সম্ভব এই অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে করে সেকেন্ড ওয়েভ যদি আসেও তাহলে তা যাতে ভয়াবহ হতে না পারে।

Related Articles

Exit mobile version