আমেরিকান সাইকিয়েট্রিক অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা প্রণীত ডায়গোনসটিক এন্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডার (ডিএসএম) এর মতে, টুরিস্ট সিন্ড্রোম আদতে কোনো মানসিক সমস্যা নয়। কিন্তু সারাবিশ্ব জুড়ে প্রচুর মানুষ, হোক ভ্রমণকারী বা সাধারণ জনতা- টুরিস্ট সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হচ্ছেন। হয়তো আপনিও জীবনে কোনো না কোনো সময় এই সিন্ড্রোমের শিকার হয়েছেন। ভাবুন, কোনো একদিন কোথাও ঘুরতে গিয়ে আপনার এমন কি মনে হয়েছে যে, আপনি সেখানের প্রকৃতির সাথে এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছেন যে আপনার আর কিছুই মনে নেই? বা এমন কি হয়েছে যে, কোনো মনোমুগ্ধকর শিল্প বা স্থান দেখে আপনি এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছেন যে, আপনার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল? যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে আপনিও এক প্রকার টুরিস্ট সিন্ড্রোমে ভুগছেন।
অর্থাৎ, টুরিস্ট সিন্ড্রোম এমন এক ধরনের মানসিক অস্বাভাবিকতা যা পর্যটকদের মধ্যে দেখা যায়, যখন তারা এমন কোনো স্থান বা বস্তু দর্শন করেন যা তাদের কাছে অত্যন্ত অর্থবহ। এক কথায়, তারা ঘোরের মাঝে চলে যান।
প্যারিস সিন্ড্রোম
টুরিস্ট সিন্ড্রোম সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে আছে সিটি অব লাইটস খ্যাত প্যারিসের সাথে। একে তাই অনেকে প্যারিস সিন্ড্রোমও বলে। ভ্রমণকারীরা প্রথমবার প্যারিসে আগমণ করে যখন অনুভব করেন সিনেমা, টেলিভিশনে দেখানো প্যারিসের সাথে বাস্তবের প্যারিসের বেশ অমিল আছে তখন অনেকের মাঝে এই সিন্ড্রোম দেখা দেয়। ফ্রান্সের নারভিওর নামের এক জার্নালে ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় যে, জাপানিরা সবচেয়ে বেশি প্যারিস সিন্ড্রোমে ভোগেন। এর কারণ হতে পারে যে, প্যারিসের নাগরিকদের জীবনযাত্রার সাথে জাপানিদের জীবন ও সংস্কৃতির আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
এই ক্ষেত্রে জাপানী ভ্রমণকারীরা প্রায়ই নিজেদেরকে ফ্রান্সের গণ্যমান্য রাজনৈতিক নেতা ভাবেন নতুবা ভাবেন কোনো ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কখনো তারা ভাবেন যে, তাদের হোটেল রুমে গুপ্ত ক্যামেরা লাগিয়ে তাদের গতিবিধি কেউ নজরে রাখছে। এই ব্যাপারটি এতটাই বেশি ঘটে যে, ভ্রমণকারীদের জন্য ফ্রান্সের জাপান এম্বাসি একটি ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইনের ব্যবস্থা করেছে।
স্টেনডাল সিন্ড্রোম বা ফ্লোরেন্স সিন্ড্রোম
১৯৭৯ সালে গ্রাজিইয়েলা মাঘেরিনি নামের একজন ইতালীয় মনোবিশেষজ্ঞ প্রথম এর নাম দেন স্টেনডাল’স সিন্ড্রোম। তিনি ইতালির ফ্লোরেন্সে সান্তা মারিয়া নৌভা হাসপাতালের প্রধান মনোবিশেষজ্ঞ ছিলেন।
তার কার্যকালে তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন যে, বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি, জাদুঘর ঘুরে আসা প্রায় ১০৬ জন ভ্রমণকারীর লক্ষণ একই রকম। তারা প্রত্যেকে উদাসীন, তাদের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়ে গেছে, তারা তাদের অবস্থান সম্পর্কে তারা অবগত নয়। মাঘেরিনি এই রোগের নাম দেন স্টেনডাল সিন্ড্রোম এবং পরবর্তীতে একটি বইও প্রকাশ করেন এই সিন্ড্রোমটি।
স্টেনডাল সিন্ড্রোম নামকরণের কারণ
কোনো শিল্প দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়াই এই সিন্ড্রোমের কারণ। এটির সর্বপ্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় ফরাসি লেখক-পর্যটক মারি হেনরি বেইলের লেখা নেপলস এন্ড ফ্লোরেন্সঃ এ জার্নি ফ্রম মিলান টু রেজিও –তে। বেইল স্টেনডাল ছদ্মনামে লিখতেন। ১৮১৭ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ে তিনি তার ইতালির হলি ক্রসের বাসিলিকা গির্জা ভ্রমণের বর্ণনা দেন। গির্জার পাশে সমাহিত মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং নিকোলো ম্যকিয়াভিলির সমাধি দেখে তিনি আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, “সেখানে দাঁড়িয়ে আমি যেন একটি স্বর্গীয় অনুভূতি পাই। আহ! আমি সেটি কখনো ভুলতে পারবো না। আমার বুক দুরুদুরু করছিল। মনে হচ্ছিলো, আমার শরীর থেকে সব শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে আর আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”
স্টেনডাল যখন এমনটি অনুভব করেছিলেন তখন এই সিন্ড্রোমের কোনো নাম ছিল না, কিন্তু অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীতে হাসপাতালে আসা পর্যটক রোগীদের দেখে মাঘেরিনি এই ‘রোগের’ নাম দেন স্টেনডাল। কিন্তু আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিই স্টেনডাল সিন্ড্রোম অনুভব করেছেন। যেমন- বিখ্যাত মনোবিশ্লেষক সিগমান্ড ফ্রয়েড এথেন্সের নগরদুর্গ ভ্রমণ করতে গিয়ে চরম একাকীত্ব ও উদাসীন অনুভব করেন। তাঁর দীর্ঘদিনের আকর্ষণ এথেন্সের নগরদুর্গ যখন তাঁর চোখের সামনে ছিল তিনি সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
ভেনিস সিন্ড্রোম
ইতালির আরেকটি কুখ্যাত টুরিস্ট সিন্ড্রোমের নাম ভেনিস সিন্ড্রোম। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৫ এই ৭ বছরে ভেনিসে ভ্রমণ করতে আসা বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা আত্মহত্যা করেন বা আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে জার্মানি, আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে মোট ৫১ জন পর্যটক ছিলেন। একে সিমবল অব ডেথ বা মৃত্যুর প্রতীক বলা হয়। কারণ এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা বলেন, তাদের ভেনিসে আসার মূল কারণই ছিল আত্মহত্যা করা!
এছাড়াও ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করেও কিছু টুরিস্ট সিন্ড্রোম চোখে পড়ে।
জেরুজালেম সিন্ড্রোম
১৯৩০ সালে হারম্যান নামক একজন ইসরাইলি মনোবিশ্লেষক প্রথম জেরুজালেমে এই ধরনের রোগীর সন্ধান পান। কিন্তু ১৯৭০ এর আগ পর্যন্ত জেরুজালেম সিন্ড্রোম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি কারণ তখন এ সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা নগণ্য ছিল। রোমের জেরুজালেমে ভ্রমণ করতে আসা পর্যটকরা নিজেদেরকে খুব বড় মাপের ধর্মীয় গুরু হিসেবে মনে করতে শুরু করেন। তারা ধ্যান-উপাসনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে থাকেন, সারাদিন ব্যাপী মানুষকে বাইবেল সম্পর্কে দীক্ষা দেন এবং অত্যধিক পয়ঃপরিষ্কার সচেতন হয়ে পড়েন, তাই অসংখ্যবার গোসল করেন।
প্রতিবছর জেরুজালেমের ক’ফার সউল মেন্টাল হেলথ সেন্টারে ১০০ জন জেরুজালেম সিন্ড্রোম রোগী নিয়ে আসা হয় এবং এদের মধ্যে শতকরা ৪০ জনের অবস্থা এতই গুরুতর থাকে যে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।
মক্কা, ভ্যাটিকান ও ভারত সিন্ড্রোম
জেরুজালেমের মতোই অন্যান্য পবিত্র ধর্মীয় স্থান যেমন মক্কা, ভ্যাটিকান সিটি ও ভারতের হৃষীকেশ, বেনারস, ধর্মশালা প্রভৃতিতে অবস্থানকালে মানুষের মনের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন আসে। এটি তাদের বিশ্বাসের মাত্রার সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ যত বেশি বিশ্বাস তত বেশিই এই সিন্ড্রোমগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। তবে এক্ষেত্রে বংশগত কারণ থাকতে পারে বলেও বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
৬২ বছর বয়সী একজন ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধা যখন ভ্যাটিকান সিটিতে গেলেন তখন তিনি বেশ কয়েকটি মানসিক ও শারীরিক সমস্যা অনুভব করেন, যেমন- অনিদ্রা, অস্বস্তি, অস্বাভাবিক আচরণ। উদাহরণস্বরূপ, তিনি সারাদিন ব্যাপী ধর্মীয় বাণী প্রচার করতে লাগলেন, হোটেল কক্ষের মেঝে চাটা শুরু করলেন এবং অন্য তীর্থযাত্রীদের সরাব বলে পানি খাওয়াতে লাগলেন। দেখা যায় যে, ২০ বছর আগে যখন তিনি ভ্যাটিকানে এসেছিলেন তখনও একইরকম আচরণ করেছিলেন। এক মাস হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ চিকিৎসকরা তাকে কখনো কোনো ধর্মীয় স্থানে ভ্রমণ করতে নিষেধ করেন।
পশ্চিমা পর্যটকদের সবসময়ই আকর্ষণ করে এশিয়ার ধার্মিক দর্শন। বিশেষ করে ভারতের উল্লিখিত পবিত্র স্থানগুলো তাদের কাছে একটি রহস্য। এসব স্থানে হয় ধ্যান, আরাধনা। পরমাত্মা এবং নিজেকে খুঁজে পায় মানুষ এসব তীর্থস্থানে। ভারতীয় ধর্মীয় বিশ্বাসের যে মূর্তি পশ্চিমা জনগণ তাদের মনে ধরে রেখেছেন তাই তাদের ভারত সিন্ড্রোমে আক্রান্ত করে। নিজেকে খুঁজে পেতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও আয়ারল্যান্ডের দুইজন পর্যটক একদা হৃষীকেশে হারিয়ে যান। এমনটা হওয়া খুব অস্বাভাবিক ছিল না। প্রায়ই দেখা যেত হৃষীকেশ, ধর্মশালা, কৈলাস পর্বত ভ্রমণ করতে গিয়ে অনেক পশ্চিমা পর্যটক পুরোদস্তুর সাধু বা সন্ন্যাসী বনে গেছেন।
এয়ারপোর্ট অয়াণ্ডারিং সিন্ড্রোম
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটি কিসের সাথে জড়িত। এই সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় সময়ই অকারণে এয়ারপোর্টে চলে যান। হয়তো তার কোথাও যাওয়ার কথা নয়। অনেক সময় কোথাও পৌঁছানোর কথা থাকলেও যাত্রীরা তাদের নাম, পরিচয়, গন্তব্য ভুলে যান। অন্য সব সিন্ড্রোম সাময়িক হলেও এয়ারপোর্ট সিন্ড্রোমের সাথে মনোরোগের দীর্ঘ সম্পর্ক আছে। এটি ভবিষ্যতে হতে পারে এমন কোনো গুরুতর মানসিক রোগের লক্ষণ। শুধু বিমানবন্দরেই নয়; এটি কোনো যাদুঘর, আর্ট গ্যালারি বা এমনই বড় কোনো স্থানে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেও প্রকাশ পায়।
এছাড়াও ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে আরও অসংখ্য টুরিস্ট সিন্ড্রোম দেখা যায়। এদের গভীরতা অন্যান্য মানসিক সমস্যার মতো প্রকট নয় বিধায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের চিকিৎসা সম্ভব হয় না। তাদের সম্পর্কে মানুষ সচেতনও হয় না। সুসংবাদ এই যে, এখন মনোবিশ্লেষকগণ এই লক্ষণগুলোর তীব্রতা নিয়ে সচেতন হয়েছেন এবং এই বিষয়ে গবেষণা আরও বেড়েছে।
ফিচার ইমেজ- npr.org