যদিও গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ, তবু তর্কের খাতিরে ধরে নিন, শীতের সকাল এটি। কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ, সবকিছু ধোঁয়াটে লাগছে, দুই হাত দূরের কিছুও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ কুয়াশা আপনার দৃষ্টিশক্তির সীমানাকে সংক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে। আপনি চাইলেও আপনার সামনে কী আছে তা ভালো করে দেখতে পাচ্ছেন না।
এই একই রকম অবস্থা কিন্তু আপনার মস্তিষ্কের সাথেও ঘটতে পারে। এমন অবস্থা দাঁড়াতে পারে যে আপনি ঠিকমতো কিছু ভাবতে পারছেন না, সকল চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, কোনো কাজে মন বসাতে পারছেন না, কোনো কিছু স্মরণেও থাকছে না। এরকম অবস্থায় কল্পনা করে নেয়া যেতে পারে যে, আপনার মস্তিষ্কের ভেতরেও বুঝি ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে, যা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।
তবে হ্যাঁ, বাস্তবিকই কারো মস্তিষ্কে এমন ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয় না, এবং এটি কোনো স্বকীয় মেডিকেল কন্ডিশনও নয়। বরং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল কন্ডিশনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে আপনার মস্তিষ্ক প্রভাবিত হতে পারে, যার ফলে সেখানে এই তথাকথিত ধোঁয়াশাও সৃষ্টি হতে পারে। এভাবে মস্তিষ্ক মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকাকেই ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ব্রেইন ফগ।
ব্রেইন ফগ হলে কী হয়?
মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, অর্থাৎ আপনি আপনার মস্তিষ্ক থেকে সচরাচর যে পরিমাণ কাজ আশা করেন, তার সমপরিমাণ কাজ পাচ্ছেন না, এমন ক্ষেত্রে আপনার ব্রেইন ফগ হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে, যদি আপনার মস্তিষ্ক নিচের কোনো এক বা একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে:
- স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া
- সহজে কোনো বিষয় বুঝতে ব্যর্থতা
- কোনো ব্যাপারে পূর্ণ মনোযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থতা
- বারবার বিভ্রান্তিতে পড়া
- কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে লম্বা সময় ধরে দোনোমনা করা
- সহজেই ধৈর্যচ্যুতি হওয়া
অনেকেই এগুলোকে মেন্টাল ফ্যাটিগ বা মানসিক শৈথিল্য হিসেবেও চিহ্নিত করে থাকে। তবে মূল বিষয়টি হলো, আপনার অবস্থা ঠিক কতটা গুরুতর। কারো কারো ক্ষেত্রে এটি কেবলই স্বল্পস্থায়ী একটি সমস্যা, নির্দিষ্ট সময় পর যা কেটে যায়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সমস্যাটি এতটাই সংকটাপন্ন যে, এতে করে তার শিক্ষা, কর্ম ও ব্যক্তিজীবনেও অনবরত সমস্যা দেখা দিতে থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো, ব্রেইন ফগ কেন হয়। এর পেছনে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সাধারণ কার্যকারণ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন। চলুন, জেনে আসি কী সেগুলো।
উদ্বেগ থেকে ব্রেইন ফগ হতে পারে
সাধারণ মানুষেরা প্রায় সময়ই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। আবার কিছু মানুষের ক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণেরও প্রয়োজন হয় না। তারা কোনো কারণ ছাড়াই, অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে থাকে। তবে উদ্বেগের পেছনে কারণ থাকুক বা না থাকুক, সেই উদ্বেগের মাত্রা যদি খুব বেশি হয়, এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রবণতাও যদি ঘন ঘন দেখা দিতে থাকে, তবে তার ফলে ব্রেইন ফগ হতে পারে। চিন্তাভাবনা এলোমেলো হওয়া এবং মনোযোগহীনতা এক্ষেত্রে দুটি প্রধান লক্ষণ।
নতুন কোনো ওষুধ শুরু করাও একটি কারণ হতে পারে
ওষুধ সেবন করা হয় দ্রুত রোগমুক্তি, কিংবা কোনো রোগকে মাত্রা ছাড়ানো থেকে আটকানোর আশায়। কিন্তু কিছু কিছু ওষুধ, সেবনকারীর উপর নেতিবাচক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত বয়স্ক রোগীরা হঠাৎ করে নতুন কোনো ওষুধ সেবন শুরু করলে, তাদের মনে স্মৃতিভ্রম এবং ব্রেইন ফগে আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে। উদ্বিগ্নতা, সিজার প্রভৃতি মানসিক সমস্যার প্রতিষেধক কিংবা নারকোটিক পেইন মেডিসিন সেবনে ব্রেইন ফগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ইনসমনিয়া প্রভাব ফেলতে পারে অবধারণগত দক্ষতায়
কোনো ব্যক্তির যদি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হয় এবং সে ইনসমনিয়ায় ভোগে, তবে তার ফলে অনেক সময়ই সে বিভ্রান্ত থাকতে পারে। পাশাপাশি তার বিচারবুদ্ধি যেমন আংশিক লোপ পেতে পারে, তেমনই স্মৃতিশক্তিও লোপ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া ইনসমনিয়ার অন্যান্য শারীরিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে, যেমন: এর ফলে স্ট্রোক, অ্যাজমা কিংবা সিজারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে, উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে, এবং হৃদযন্ত্রের অন্যান্য বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে পারে।
পর্যাপ্ত লৌহজাতীয় খাবারের অভাবে ব্রেইন ফগ হতে পারে
লৌহ আমাদের শরীরকে সাহায্য করে ফুফফুস থেকে শরীরের অন্যান্য অংশে অক্সিজেন পরিবহনের কাজে। কিন্তু যখন আমাদের শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে লৌহ না থাকে, তখন কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যার মধ্যে ব্রেইন ফগ অন্যতম। শরীরে লৌহের ঘাটতি রয়েছে কি না তা জানার জন্য সাধারণত রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। পাশাপাশি চিকিৎসককে এটিও অবগত করা দরকার যে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, হৃদকম্পন বেড়ে যাওয়া, জিহবা শুকিয়ে যাওয়া ছাড়াও আমরা ব্রেইন ফগেরও সম্মুখীন হচ্ছি।
ভিটামিন বি-১২ এর অভাবে ব্রেইন ফগ হতে পারে
কোনো কিছু পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে না পারা, কোনো ব্যাপারে যুক্তি খুঁজে বের করতে কষ্ট হওয়া প্রভৃতি হলো শরীরে বি-১২ ভিটামিনের ঘাটতির কিছু প্রাথমিক লক্ষণ। এছাড়া আরো কিছু লক্ষণও দেখা দিতে পারে, যেমন- শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে কষ্ট হওয়া, দুর্বল অনুভব করা, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়া, হাত-পা ও পায়ের পাতা অসাড় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। বয়স্ক রোগী, হঠাৎ করে যাদের খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনা হয়েছে বা আগের চেয়ে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে, এবং নিরামিষভোজী, যাদের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত ভিটামিনের উপস্থিতি থাকে না, তাদের মধ্যে এই সমস্যা সৃষ্টির ঝুঁকি বেশি থাকে।
ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোমের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে
যাদের ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম বা ঘন ঘন অবসাদগ্রস্ত বা মানসিকভাবে শিথিল হয়ে পড়ার ধাত আছে, তারা শর্ট-টাইম মেমোরি লস এবং মনোযোগহীনতার শিকারও হতে পারে। এছাড়া এমন ব্যক্তিদের গলায় ঘা কিংবা প্রায়ই মাথাব্যথাও হতে পারে।
ব্রেইন ফগ ফাইব্রোমায়ালজিয়ার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে
ফাইব্রোমায়ালজিয়া হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতা, যার প্রধান উপসর্গ হলো মাংসপেশি, টেন্ডন এবং অস্থিসন্ধিগুলোতে প্রদাহ। এই অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকের মধ্যেই ব্রেইন ফগও দেখা যায়, এবং তারা এটিকে “ফাইব্রো ফগ” হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
ব্রেইন ফগ লাইম রোগের উপসর্গও হতে পারে
বোরেলিয়া বাগডোরফেরি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত বা আক্রান্ত পোকামাকড়ের কামড়ের কারণে লাইম রোগটি দেখা দেয়। জ্বর, মাথা ব্যথা, ক্লান্তি এবং ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া হলো এই রোগের সাধারণ উপসর্গ। এছাড়া এই রোগটি পেশি, রক্ত সংবহনতন্ত্র, হজম প্রক্রিয়া এবং স্নায়ুতন্ত্রকেও প্রভাবিত করে। শেষোক্তটির কারণে ব্রেইন ফগ দেখা দিতে পারে।
শেষ কথা
কথায় আছে, কোনো রোগের কার্যকারণ সম্পর্কে জানা থাকলে, সেই রোগের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। আপনারা যেহেতু জেনেছেন, ব্রেইন ফগের নেপথ্যে কী কী কারণ থাকতে পারে, তাই আশা করাই যায় যে এখন থেকে আপনারা সবসময় এসব কার্যকারণের ব্যাপারে সচেতন থাকবেন, ফলে আপনারাও ব্রেইন ফগের শিকার হবেন না। ব্রেইন ফগ থেকে বাঁচার জন্য আরো কয়েকটি উপদেশ মেনে চলাও আবশ্যক:
- প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে
- সুষম খাদ্য তালিকা অনুযায়ী খাদ্যগ্রহণ করতে হবে
- হজম প্রক্রিয়াকে ঠিক মতো কাজ করতে দেয়ার জন্য, রাতের শেষ খাবার ও সকালের প্রথম খাবারের মধ্যে অন্তত ১২ ঘণ্টার ব্যবধান রাখতে হবে
- প্রতিদিন কোনো আনন্দদায়ক শরীরচর্চা করতে হবে, যেমন: হাঁটা, দৌড়ানো বা নাচা
- একটানা অনেকক্ষণ কাজ করা যাবে না, রুটিন মেনে অল্প অল্প করে কাজ সারতে হবে
- মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্য সুডোকু বা ক্রসওয়ার্ড পাজল জাতীয় খেলা খেলতে হবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/