শারীরিক সুস্থতার জন্য ব্যায়ামের কার্যকারিতা অনেক। দৈহিক কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নানাবিধ প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি হ্রাসে ব্যায়াম প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও কম-বেশি আমরা জানি। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে করা গবেষণাগুলো থেকে এটাও প্রমাণিত যে, ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কেও বেশ বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
গত কয়েক দশক ধরে ব্যায়ামের ফলে মানুষের মনোযোগ, স্মৃতি এবং সংবেদনশীলতায় কী ধরনের পরিবর্তন আসে তা নিয়ে গবেষণা করে এতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, মানুষের মস্তিষ্ক ব্যায়ামের পরে সবচেয়ে ভালো কাজ করে। যদিও তখন এর নির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে ধীরে ধীরে কিছু বিষয়ে বিজ্ঞানীরা ধারণা পেতে শুরু করেছেন। এই লেখায় সেগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
ব্রেইন-ওয়েভ বৃদ্ধির মাধ্যমে মস্তিষ্ককে আরো বেশি সক্রিয় করে তোলে
সাধারণত, আমাদের চলা-ফেরা, কথা বলা, আচার-আচরণ, আবেগ-অনুভূতিসহ প্রতিটি কাজের নিয়ন্ত্রণ থাকে নিউরন বা স্নায়ুকোষের হাতে। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো এঁকে অপরের সাথে ইলেকট্রিক্যাল পালসের সাহায্যে যোগাযোগ করে। যোগাযোগের সময় একসাথে নানা ধরনের নিউরন স্পন্দিত হওয়ার সময়েই ব্রেইন-ওয়েভের উৎপত্তি ঘটে।
প্রত্যেক সেকেন্ডে কী পরিমাণ ব্রেইন-ওয়েভ স্পন্দিত হয় তার উপর ভিত্তি করে ব্রেইন-ওয়েভগুলো আবার কয়েকভাবে বিভক্ত। সেগুলোকে ডেলটা, থিটা, আলফা, বিটা এবং গামা ওয়েভ নামে চিহ্নিত করা হয়। আমরা যখন অটো-পাইলটে থাকি; অর্থাৎ ব্রাশ করা, ঘুমানো, ঘর গোছানো, গাড়ি চালানোর মতো প্রাত্যহিক কাজগুলো করি, তখন আমাদের মস্তিষ্কে নিম্ন কম্পাঙ্কের ব্রেইন-ওয়েভ উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে, আমরা যখন কোনো কিছু সম্পর্কে বেশ সতর্ক থাকি, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করি, বা কোনো সমস্যার সমাধান করার কাজে নিজেদের মস্তিষ্ককে কাজে লাগাই, তখন বিটা ও গামার মতো উচ্চ কম্পাঙ্কের ব্রেইন-ওয়েভগুলো উৎপন্ন হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ রিচার্ড ম্যাডকের মতে, ব্যায়ামের সময় আমাদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রামের সাহায্যে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ব্যায়াম করার সময় মস্তিষ্কে উচ্চ কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট বিটা ওয়েভের উপস্থিতি দেখা যায়। অর্থাৎ, ব্যায়াম আপনার মস্তিষ্ককে আশপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বেশি সতর্ক তুলতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্কের পেছনের দিকে বেশ বড় একটি অংশ ভিজুয়াল ইনফরমেশন বা দৃশ্যমান তথ্য বিশ্লেষণের জন্য বরাদ্দ, যা ভিজুয়াল কর্টেক্স নামে পরিচিত। এই প্রাথমিক করটিকাল অঞ্চলটি রেটিনা থেকে আগত তথ্যগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে এবং আমাদের মাঝে দেখার অনুভূতি জাগায়। এ সময় পরিবেশ বা দৃশ্যে থাকা কম গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোও আমাদের মস্তিষ্কে দৃশ্যমান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সান্তা বারবারায় অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান এবং ব্রেইন সায়েন্সের অধ্যাপক টম বুলক ও ব্যারি গ্রিজব্র্যাচট, নানা ধরনের অ্যারোবিক এক্সারসাইজের সময় মস্তিষ্কের ভিজুয়াল কর্টেক্সে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে টা দীর্ঘদিন ধরে বের করার চেষ্টা করেছেন। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, ব্যায়ামের সময় আমাদের মস্তিষ্ক আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে আরো বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। সেসময় ভিজুয়াল কর্টেক্স নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যমান তথ্যগুলোকে কম গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যমান তথ্যগুলো থেকে আলাদা করতে আরো সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
নানা ধরনের কগনিটিভ টেস্টে একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘ফ্লিকার ফিউশন থ্রেশহোল্ড’ পরীক্ষার কথাই ধরা যাক, যেখানে জ্বলতে-নিভতে থাকা আলোর ঝলকানিগুলো হাই-ফ্রিকোয়েন্সিতে অবিচ্ছিন্নভাবে জ্বলজ্বল করতে দেখা যায়। নানা পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে, ব্যায়ামের আগের চেয়ে ব্যায়ামের পরে জ্বলতে-নিভতে থাকা অস্থায়ী পরিবর্তনগুলো আরো বেশি ইন্দ্রিয়গাহ্য হয়। অর্থাৎ, ব্যায়ামের আগে যে ফ্রিকোয়েন্সিতে ঝলকানিগুলোর অস্থায়ী পরিবর্তনগুলো ধরা যেত না, ব্যায়ামের পরে সে ফ্রিকোয়েন্সি বা তার চেয়ে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতেও অস্থায়ী পরিবর্তনগুলো মস্তিষ্ক আলাদা করতে পারে।
উপরোক্ত অনুসন্ধানগুলো ইঙ্গিত দেয়, ব্যায়াম আপনার মস্তিষ্ককে আরো বেশি সক্রিয় করার মাধ্যমে স্পষ্ট দেখা এবং উপলব্ধির সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
নতুন নিউরোট্রান্সমিটার তৈরিতে সাহায্য করে
দৌড়ানোসহ অন্যান্য অ্যারোবিক এক্সারসাইজগুলো করার একপর্যায়ে আমাদের ফুসফুস পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে না। আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী এবং দ্রুত হয়ে ওঠে। সে সময় আমাদের হৃদপিণ্ড শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পৌঁছে দিতে গিয়ে হিমশিম খায়। ফলে হৃদকম্পন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় আমাদের মাংসপেশিগুলো তুলনামূলক বেশি শক্তি চায়, এবং আমাদের মস্তিষ্ক গ্লুকোজসহ অন্যান্য কার্বোহাইড্রেটগুলোকে গোগ্রাসে গিলতে থাকে।
অতীতে ব্যায়ামের সময় মস্তিষ্ক এই বিশাল পরিমাণ জ্বালানি দিয়ে কী করে, তা সম্পর্কে তেমন কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তবে ২০১৬ সালে ম্যাডক এবং তার সহকারী গবেষকরা জার্নাল অফ নিউরো-সায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে দেখিয়েছেন, এই জ্বালানীর কিছু অংশ ব্যবহার করে মস্তিষ্ক নতুন নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি করে।
এক নিউরন বা স্নায়ুকোষ থেকে পার্শ্ববর্তী অন্য স্নায়ুকোষে সংকেত পরিবহন, পরিবর্ধন এবং সংকেত নিয়ন্ত্রণের জন্য একধরনের রাসায়নিক বার্তাবাহকের প্রয়োজন হয়। নিউরোট্রান্সমিটার হচ্ছে সেই বার্তাবাহক।
ম্যাডক এবং তার দল, তাদের সাবজেক্টকে স্টেশনারি বাই-সাইকেলে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যায়াম করতে বলে এবং এমআরআই-এর মাধ্যমে সাইক্লিংয়ের পূর্বের এবং পরের নিউরোট্রান্সমিটার লেভেল পরিমাপ করে নতুন নিউরোট্রান্সমিটার তৈরির ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ করেন। সে সময় তারা গ্লুটামেট (Glutamate) এবং GABA-2 এর মতো নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর বৃদ্ধি দেখতে পান। ম্যাডক মনে করেন, ঠিকঠাকমতো কাজ করার জন্য মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় যেসকল রাসায়নিক উপাদানগুলোর ঘাটতি তৈরি হয়, ব্যায়াম সে ঘাটতিগুলো পূরণের ব্যাপারে সাহায্য করে।
বর্তমানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা প্রশমনের জন্য ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। ম্যাডক এবং তার দল ব্যায়ামের সময় তৈরি হওয়া গ্লুটামেট জাতীয় নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে মস্তিষ্কের ঐ সকল অঞ্চলে বৃদ্ধি পেতে দেখেন, যে অঞ্চলে বিষণ্নতাগ্রস্ত রোগীদের বেলায় পূর্বে নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণ কম ছিল।
স্নায়ুকোষের মাঝে নতুন সংযোগ তৈরির মাধ্যমে মস্তিষ্ককে আরো প্রাণোচ্ছ্বল করে তোলে
নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কের নিউরন বা স্নায়ুকোষদের মাঝে নতুন সংযোগ তৈরি হয়। ২০১৬ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের যে অঞ্চলগুলো স্মৃতি, মনোযোগ, মাল্টি-টাস্কিং, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সংবেদনশীল তথ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজে নিয়োজিত, ক্রস-কান্ট্রি দৌড়বিদদের মস্তিষ্কের সে অঞ্চলগুলোর নিউরনদের মাঝে নতুন সংযোগ তৈরি হয়। সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এ অঞ্চলগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিয়মিত ব্যায়াম শুধু যে স্নায়ুকোষগুলোর মাঝে নতুন সংযোগ সৃষ্টি করে তা-ই নয়, নানা ধরনের গ্রোথ ফ্যাক্টর উৎপাদনের মাধ্যমে বিদ্যমান ব্রেইন সেলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে, নিউরোজেনেসিসের মাধ্যমে মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসে তৈরি হওয়া উদীয়মান নিউরাল সেলগুলোর বিকাশ ঘটতে নিউট্রিয়েন্ট বা পরিপোষক পদার্থের প্রয়োজন পরে। কিছু গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, ব্যায়ামের ফলে ব্লাড ভেসেলগুলোর উন্নতি বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্ট উৎপাদন সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান এবং ব্রেইন সায়েন্সের অধ্যাপক ব্যারি গ্রিজব্র্যাচট বলেন, নানা ধরর অ্যারোবিক এক্সারসাইজ হিপ্পোক্যাম্পাসে নিউরোজেনেসিস বৃদ্ধিতেও সাহায্য করতে পারে।
শেষ কথা
নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক চার্লস হিলম্যান মনে করেন, নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে হয়তো মস্তিষ্কে ছোট থেকে মাঝারি আকারের পরিবর্তন সম্ভব, যেগুলো মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্য রক্ষা এবং জ্ঞান বৃদ্ধির কাজে সাহায্য করবে। কিন্তু কেউ যেন মনে না করে, ব্যায়ামের সাহায্যে আইকিউ বৃদ্ধি বা তার চাইতেও বেশি কিছু করা যাবে।
তবে টম বুলক ও ব্যারি গ্রিজব্র্যাচট এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে ওষুধের বদলে ডাক্তাররা ব্যায়ামের পরামর্শ দেবেন। এ সম্বন্ধে গ্রিজব্যাচট বলেন, “বয়সের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞানীয় অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে ব্যায়াম সম্ভাব্য প্রতিষেধক। এমনকি বার্ধক্যজনিত সমস্যা বা হতাশাবিষয়ক ব্যাধিগুলো পরিত্রাণের জন্য ব্যায়ামই একমাত্র সহজ চিকিৎসা।“
বিজ্ঞানের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/