জন্মের পর থেকে প্রথম তিন বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের সময়টা বাচ্চাদের জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সে ওদের মস্তিষ্ক ধাপে ধাপে বিকশিত হতে থাকে এবং প্রতিদিনই ওরা নতুন কিছু শেখে। বাচ্চারা যা কিছু শেখে তার অনেকটাই ৬ বছর বয়স পর্যন্ত ওরা যা যা করে তা থেকে শেখা। ৫ বছর বয়সের পর থেকে মস্তিষ্কের বিকাশ ধীর গতিতে কাজ করা শুরু করে। তাই এই সময়টাতে কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে মাধ্যমে দ্রুতই আপনার বাচ্চার মস্তিষ্ক বিকাশে সচেতন হোন। নিচে উল্লেখিত এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে আপনি আপনার বাচ্চার মস্তিষ্ক যথাযথভাবে বিকাশ করতে সক্ষম হবেন।
ওদের সাথে সময় কাটান
আপনার বাচ্চার শেখার ও দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে ওদের সাথে সময় কাটানোটা হলো সবচাইতে উপকারী পন্থা। বাচ্চারা মা-বাবার সাথে সময় কাটানোর মধ্য দিয়ে ভাষা, মুখভঙ্গি এবং আবেগের প্রকাশ শেখে। এমনকি আপনার ছোঁয়াও আপনার সন্তানের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেসব বাচ্চারা তাদের মা-বাবার ছোঁয়া ও আলিঙ্গনে বেশি থাকে সেসব বাচ্চাদের সুস্থ থাকার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি হয়ে থাকে। ছোট ছোট কাজ, যেমন- হাত ধরে হাঁটা, হাত ধরে লেখা শেখানো, খেলাধুলার সময় পরস্পরের সাথে স্পর্শও এই বিষয়ে কার্যকরী হতে পারে।
পড়ার সাথে পরিচিত করান
বই পড়ার অভ্যাসটি বাচ্চাদের মনে গেঁথে দেয়াটা খুব জরুরি। এতে করে ওরা বইকে ভালোবাসতে এবং জ্ঞানার্জন করতে শিখবে এবং প্রতিনিয়ত এগিয়ে যেতে থাকবে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার জন্য খুব ছোট হলেও ওদের সামনে বই পড়ুন। এর ফলে ওরা পড়ার বিষয়টির সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে ওরা বুঝতে শিখবে যে, নতুন নতুন জানা-অজানা সব তথ্য ও জ্ঞান আহরণের জন্য পড়াটা কত জরুরি। যখন ওরা বুঝতে শুরু করবে তখন সেসব বই দেয়া শুরু করুন যেগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠায় একটি করে ছবি থাকে। এর মধ্যে রয়েছে গণনা, বর্ণমালা, আকার-আকৃতি চেনার বইগুলো। এর পরের ধাপে আপনি ছবিসহ ছোট ছোট বাক্যে বিষয়বস্তু বুঝিয়ে লেখা বইগুলো দিতে পারেন। পড়লে বাচ্চাদের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। এছাড়াও ওদের কল্পনাশক্তি বিকশিত হয়। যার ফলে কথাবার্তা বা লেখাও সুসঙ্গত হয়।
অনুসন্ধিৎসু বা কৌতূহলী হতে অনুপ্রাণিত করুন
বাচ্চারা প্রাকৃতিকভাবেই কৌতূহলী হয়ে থাকে। কিন্তু সব বিষয়ে ওদের তদারক ও প্রশ্ন করার প্রবণতাটি মন্থর হয়ে যেতে শুরু করে যখন প্রতিটি বিষয়ে ওদের অনবরত প্রশ্ন করার জন্য ওদেরকে থামিয়ে দেয়া হয় বা প্রশ্নগুলো অবহেলা করা হয়। কৌতূহলের এই প্রবণতাটি ওদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে থাকলে কীভাবে কাজ করে বা এর কাজ কী- এই ধরনের প্রশ্ন করার অভ্যাসগুলো চলে গেলে পরবর্তীতে কৌতূহলও কমে যাবে। তাই ওদের কৌতূহলকে অনুপ্রাণিত করার জন্য এমন কিছু কার্যক্রমের ব্যবস্থা করুন যেন ওরা প্রশ্ন করতে পারে। একটি কাগজে করে কিছু জিনিসের নাম লিখে দিয়ে তা ঘরের বিভিন্ন জায়গায় রেখে দিন। এরপর সেই কাগজটি দিয়ে সেখানে লেখা জিনিসগুলো একত্রিত করতে বলুন। এতে করে ও সবকিছু চিনতে শিখবে এবং জানার কৌতূহলটাও পূরণ হবে।
স্ক্রিন টাইম কম করুন বা এড়িয়ে চলুন
আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসে্র মতে, ২ বছর বয়সের নিচের বাচ্চাদের কোনোভাবেই টিভি, মোবাইল এসব দেখতে দেয়া উচিত নয়। কারণ এতে বাচ্চাদের সার্বিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। এই বিষয়টি যদিও অস্বীকার করার মতো নয় যে, আজকাল ইন্টারনেটে বাচ্চাদের জন্য শিক্ষণীয় অনুষ্ঠানের কমতি নেই। তবে বাচ্চাদের জন্য তা তখনই কার্যকরী হবে যখন তা উভয় পক্ষের মধ্যেই ভাবের আদান-প্রদান ঘটাবে। তাই যদি আপনার বাচ্চা টিভি বা ইন্টারনেটে এই ধরনের শিক্ষণীয় কিছু দেখেও থাকে তবে অবশ্যই আপনি ওর পাশে থাকবেন, যাতে করে সেই অনুষ্ঠানগুলো ওর জন্য কার্যকরী হতে পারে। একদিকে যেমন ২ বছর বয়সের নিচের বাচ্চাদের একদমই টিভি বা কম্পিউটার দেখা মানা, তেমনি অন্যদিকে ২ বছর বয়সের উপরের বাচ্চাদের দিনে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টার বেশি টিভি বা কম্পিউটার দেখতে দেয়া ঠিক নয়। তাই যথাসম্ভব বাচ্চাদের ভিডিও গেমস, মোবাইল ফোন ও টিভি থেকে দূরে রাখুন।
সামাজিক দক্ষতা বিকশিত হতে সাহায্য করুন
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনার সন্তানের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ততা বেড়ে যাবে। তখন জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও বাইরের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ার বিষয়টি ওর রপ্ত থাকা বেশ প্রয়োজন। বাচ্চারা সামাজিকতা বিষয়ে তখনই দক্ষ হয়ে ওঠে যখন ওরা অন্য বাচ্চাদের সাথে মেলামেশা করে, কথা বলে। নিয়মকানুন মেনে খেলাধুলা করলে বাচ্চারা নিজের সুযোগ আসার জন্য ধৈর্য ধরতে শেখে ও এর মূল্য বুঝতে শেখে। এছাড়াও খেলাতে রয়েছে হার-জিতের ব্যাপার। হেরে গেলে থেমে না থেকে অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে কীভাবে আবারও একই স্পৃহা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে তা-ও শেখে বাচ্চারা। এছাড়াও জিতে গেলে নিজের খুশি অন্যদের সাথে কীভাবে ভাগাভাগি করে নিতে হয় সেটাও বুঝতে শেখে ওরা। বাচ্চারা খেলা ও একে অন্যের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে মধ্যস্থতা, ভাগাভাগি করে নেয়া এবং আত্মসংযমের মতো দক্ষতাগুলো আয়ত্ত করতে পারবে সহজেই।
অনুভূতিগুলো নিয়ে আলোচনা করুন
বাচ্চাদেরকে প্রায়শই শুধুমাত্র খুশি ও মন খারাপের অনুভূতিগুলোই শেখানো হয় বা ধারণা দেয়া হয়। এতে করে ওদের আবেগপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এমন সব পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের বোঝানোর চেষ্টা করুন যে যখন কেউ খুশি হয় বা মন খারাপ থাকে তখন তারা ঠিক কেমন অনুভব করে এবং সেই পরিস্থিতিতে তাদের কী করা উচিত। ওরা কোন পরিস্থিতিতে কেমন অনুভব করছে তা ওদেরকে বলতে ও বোঝাতে শেখান। ছোট থাকতেই যদি বাচ্চারা নিজেদের আবেগগুলো মোকাবেলা করতে না শেখে তাহলে তা ওদের জীবনে সামনের দিনগুলোতে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে আবেগপূর্ণ বুদ্ধিমত্তা একটি অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। আর তাই এটি মস্তিষ্ক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নেতৃত্ব দিতে দিন
যদিও বাচ্চাদের নিজ থেকে সব সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া উচিত নয় বা ওরা এই বিষয়ে পারদর্শীও নয়, তবুও কিছু কিছু সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বা নেতৃত্ব করার কাজটা ওদের দেয়া উচিত। আপনি যদি আপনার বাচ্চার সব প্রয়োজন মিটিয়ে দেন বা কাজ করে দেন তাহলে আপনার ওপর ওদের নির্ভরতা এবং চাহিদার প্রবণতা বেড়ে যায়। ভেতর থেকে দায়িত্বজ্ঞানবোধ আনার জন্য এবং নেতৃত্বের গুণাগুণ বিকশিত করার জন্য মাঝেমাঝে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিন। ছোট ছোট কাজ এবং সেগুলো সঠিকভাবে শেষ করার দায়িত্বটা দিয়ে দিন। এসব কাজের মধ্যে থাকতে পারে খেলার পর সেগুলো ঠিক জায়গা মতো গুছিয়ে রাখা, বাইরে যাওয়ার সময় কোন জামাটি পরে যাবে ইত্যাদি।
এছাড়াও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ানোটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শরীরে সঠিক মাত্রায় পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হলে মস্তিষ্ক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
Feature Image Source: Australian Institute of Family Studies