২০১৯ সালের শেষ প্রহর এবং ২০২০ সালের শুরু থেকে যে বিষয়টি আমাদেরকে অত্যন্ত চিন্তিত এবং আতঙ্কিত করে রেখেছে, তা হলো কোভিড-১৯। এই ভাইরাসের সূচনা সুদূর চীনে হলেও, এটি খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সকল মহাদেশ, এমনকি সকল দেশেও। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন গাণিতিক হারে বেড়েই চলেছে। একইসাথে বেড়ে চলেছে মানুষের মনে আতঙ্ক। বর্তমানে মানুষের মনে দুটি প্রশ্নই বারবার উঁকি দিচ্ছে- “এই বৈশ্বিক মহামারির শেষ কোথায়?” এবং “এই মহামারির সমাপ্তি কীভাবেই বা দাবি করা যাবে?“
বৈশ্বিক মহামারি: কী ও কখন?
একটি মহামারির আরম্ভ ও শেষ বিবেচনা করতে হলে প্রথমেই যে বিষয় সম্পর্কে আমাদেরকে পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে, তা হলো- বৈশ্বিক মহামারি কী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বৈশ্বিক মহামারি বলতে প্রচুর লোককে আক্রান্ত করে একটি বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে (যেমন- একাধিক মহাদেশ বা বিশ্বব্যাপী) ছড়িয়ে পড়া রোগের মহামারিকে বোঝায়।
বৈশ্বিক মহামারি কী, তা তো আমরা জেনে নিলাম। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট রোগকে আমরা কখন মহামারি বলতে পারব? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাক তাহলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের জানায়, বৈশ্বিক মহামারি এমন একটি মাপে ঘটে যা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে, সাধারণত বিশ্বব্যাপী লোককে প্রভাবিত করে। কোনো রোগ বা অবস্থা কেবল বৈশ্বিক মহামারি নয়, কারণ এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে বা বহু মানুষ এতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়; এটি অবশ্যই সংক্রামক হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার অনেক মৃত্যুর জন্য দায়ী, তবে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে বিবেচিত হয় না, কারণ এই রোগটি সংক্রামক নয়।
এই মহামারির রয়েছে কিছু প্রকারভেদ। শুধুই যে সংক্রামক বা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেই যে সেই রোগ বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে বিবেচিত হবে, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি বোঝান যাক।
২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু মহামারির কথা হয়তো আমাদের সকলেরই স্মরণে আছে। এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে এক লক্ষাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এই মহামারি বাংলাদেশে ভয়ানক রূপ ধারণ করলেও একে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কারণ সেসময় বাংলাদেশের বাইরে আর কোথাও এই রোগ এভাবে ছড়িয়ে পড়ার আলামত পাওয়া যায়নি। এই মহামারিকে ইংরেজিতে আউটব্রেক (Outbreak) বলে।
অপরদিকে চীনের উহান শহর থেকে উৎপত্তি পাওয়া করোনাভাইরাস সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি সংক্রামকও বটে। এখানে দুটি ব্যাপার এই রোগকে বৈশ্বিক মহামারিতে রূপান্তরিত করেছে। এক, তার সংক্রামণ ক্ষমতা; অপরটি হলো বিশ্বের সকল মহাদেশ ও উপমহাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়া এবং এর উপদ্রব। এই দুটি ব্যাপার মাথায় রেখে এই রোগকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
একটি মহামারি মোকাবেলার পদ্ধতি সমূহ
একটি মহামারির যখন উৎপত্তি ঘটে, সেই উৎপত্তির সূচনালগ্ন থেকে শুরু হয় এই মহামারিকে প্রতিহত করার যুদ্ধ। মহামারি মোকাবেলার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তিনটি পদক্ষেপ অবলম্বন করে থাকে:
১) মহামারির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া;
২) মহামারির ব্যাপ্তিকাল প্রলম্বিত করা এবং টিকার সন্ধান করা; এবং
৩) আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে মহামারিকে রুখে দেয়া।
১) মহামারির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া
এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি দেশে কোনো রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না (যেমন- লকডাউন জারি করা বা জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা), বরং মানুষকে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা লক্ষ-কোটিতে যেতে পারে। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে অধিকাংশ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। যারা এই পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তাদের মধ্যে গড়ে উঠে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ (Herd Immunity)।
এই ব্যাপারটি আমরা অতীতের দিকে নজর দিলে লক্ষ্য করব। আজ থেকে বহু বছর আগে জলবসন্ত এক আতঙ্কের নাম ছিল। এই মহামারিতে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু মানুষ এই মহামারির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয় এবং তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এই রোগের প্রতিরোধব্যবস্থা, যাতে ভবিষ্যতে এই রোগ তাদের শরীরে আর কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
ঠিক একই চিত্র আমরা কলেরা মহামারির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করব। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। দেখা গিয়েছে গ্রামাঞ্চলে এক পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই মারা গিয়েছে কলেরাতে আক্রান্ত হয়ে। কিন্তু তাদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক মানুষ এই রোগের জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম হয়েছে এবং এই মহামারির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
এই পদ্ধতি অবলম্বনের সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিক হলো, অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু যা একটি দেশের জন্য হুমকিরস্বরূপ।
২) মহামারির ব্যাপ্তিকাল প্রলম্বিত করা এবং টিকার সন্ধান করা
এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি মহামারির সঙ্গে লড়াই করার জন্য টিকা আবিষ্কারের প্রতি উৎসাহিত করে। এই পদ্ধতির একটি দুর্বলতা হলো, এ ক্ষেত্রে একটি মহামারি মোকাবেলায় সময় লেগে যায় অনেক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব হয় এবং টিকা আবিষ্কার হয়ে গেলে মানুষের দেহে তা প্রয়োগের পর তাদের শরীরে ঐ রোগের প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। ফলে সেই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে তার বিরুদ্ধে আমাদের শরীর লড়াই করে টিকে থাকতে সক্ষম হয়।
এই পদ্ধতির ক্ষেত্রে কিছু ধাপ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, মানুষের চলাফেরা সীমিত করা, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা এবং তা এড়িয়ে চলা। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন পর্যায়ের লকডাউন জারি এবং তা নিশ্চিত করা। এর ফলে ঐ নির্দিষ্ট প্যাথোজেনের সংক্রমণ অনেকটাই কমে যায়, বিজ্ঞানীরা এর টিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হন আর মৃত্যুর সংখ্যাও হ্রাস পায়।
এ ধরনের পদ্ধতির অবলম্বন আমরা লক্ষ্য করি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ক্ষেত্রে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন জারি করা হয়েছে এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি জনসমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা তো আছেই। এর ফলে বিভিন্ন দেশ কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, লকডাউন জারি করলে বা জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করে কীভাবে একটি মহামারির মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে? কোভিড-১৯ ভাইরাল রোগ হলেও, এই রোগের ছড়িয়ে পড়ার জন্য দরকার তার বাহক অর্থাৎ মানুষ এবং তাদের মধ্যে ন্যূনতম দূরত্ব। তাই জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করলে বহু সংখ্যক মানুষ এক জায়গায় জড়ো হতে পারে না, যার ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে মানুষের ঘনত্ব কমে যায় এবং এই ভাইরাস সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। আর লকডাউন জারি করলে মানুষের ঘরেই থাকা লাগে, যার ফলে তারা বাইরের জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায় এবং সে ও তার পরিবার এই ভাইরাসের সংক্রামণ থেকে রক্ষা পায়। এভাবে একটি ভাইরাসের সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
৩) আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে মহামারিকে রুখে দেয়া
এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত কার্যকর। এর মূলমন্ত্র হলো, ওই মহামারিকে নিজের দেশে প্রবেশ করতেই না দেওয়া। অর্থাৎ, দেশের সীমান্তে নিষেধাজ্ঞা জারি করা, মানুষের অন্য দেশে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা এবং অন্য দেশের মানুষ যাতে নিজের দেশে ঢুকতে না পারে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে সংক্রমণের আশঙ্কা একেবারেই কমে যায়। যার ফলে একটি দেশ সেই মহামারির সঙ্গে অতি দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটি দেশ চাইলেই সীমান্তে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে না। কারণ, বিভিন্ন কারণে একটি দেশ তার পার্শ্ববর্তী দেশের উপর নির্ভরশীল। আমদানি-রপ্তানি বা কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য একটি দেশকে তার পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। ফলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কোন পদ্ধতি সর্বাধিক কার্যকর?
শুরুতেই বলা যাক প্রথম পদ্ধতির কথা। এ ক্ষেত্রে মানুষ খাপ খাইয়ে নেয় ঠিকই, কিন্তু অসংখ্য মানুষের মৃত্যু একটি দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি এড়িয়ে চলা হয়।
এরপর বলা যাক আন্তর্জাতিক মহলে সমন্বয়ের বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে একটি দেশ চাইলেই তার সীমান্তে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে না। কারণ আমদানি-রপ্তানি, বিদেশে নিজেদের নাগরিক- সবকিছু মিলিয়ে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অনেক ব্যাঘাত ঘটে থাকে, যার ফলে এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।
পরিশেষে, একটি রোগের টিকা তৈরি করাই সর্বাধিক কার্যকর পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে সময় বেশি প্রয়োজন হলেও অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয় এবং পরবর্তী প্রজন্ম সুরক্ষিত থাকে। তাই এই পদ্ধতিই বর্তমানে অবলম্বন করা হয়ে থাকে।
কোনো মহামারির সমাপ্তি কীসের ভিত্তিতে ঘোষণা করা হয়?
এখন আমাদের প্রশ্ন হলো, কখন একটি মহামারিকে ‘শেষ’ বলা যেতে পারে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যখন একটি জীবাণুকে অনেকটাই (৮০-৯০%) দমন করা সম্ভব হয়, তখনই ঐ মহামারির সমাপ্তি ঘোষণা করা যায়। অর্থাৎ যখন সারা বিশ্বের সকল দেশের অধিকাংশ জনগণকে কার্যকর টিকা প্রদান করা সম্ভব হয়, মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে এবং নতুন আক্রান্তের সংখ্যা একদমই কমে যায়, তখনই ঐ মহামারির সমাপ্তি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।