শহরের অলিগলিতে চুলকানির মলম ফেরি করা লোকগুলোর কথা শুনে আমরা মজা পাই। কিংবা কাঠফাটা গরমে ঘেমে নেয়ে সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে শরীরের ভাঁজে দু’দণ্ড চুলকে নিতেও আরাম পাই আমরা। কিংবা পইপই করে ডাক্তার যেখানে বলে দিয়েছেন, ঘা চুলকাবেন না, ক্ষতি হবে; আপনমনে সেই স্থান চুলকোতেও নিষিদ্ধ আনন্দ পান অনেকেই। চুলকানোর সাথে এই যে আরামের সম্পর্ক, এটি কেন? দৈনন্দিন জীবনে এই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবাটা যেন একদমই অনর্থক। তবে কৌতউহলই জ্ঞানের দরজা। তাই মনে আসা প্রশ্নকে বিব্রতকর না ভেবে চলুন একটু খুঁজে দেখি উত্তর।
জীবাণুর প্রতি আক্রোশে নখের লাঙল চালিয়ে অনেকেই উল্টো তাদের বংশবিস্তার ঘটিয়ে ফেলেন। বীভৎস ঘায়ের দিকে বারবার তাকানো কিংবা আত্মঘাতী উপায়ে চুলকানো – এসবের আছে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। একটি জ্বলজ্যান্ত রোগই আছে, নাম ডিলিউসরি প্যারাসাইটোসিস। কেন চুলকাচ্ছে- এই প্রশ্নের প্রতি অতি অনুসন্ধিৎসু হয়ে যারা চুলকে ঘা বানিয়ে বা ঘা চিমটে-চটিয়ে রক্ত বের করেই আরামে ক্ষান্ত দেন, তারাই এই রোগে আক্রান্ত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটি কেবলই একটি মনস্তাত্ত্বিক বিকার। এ রোগ যদি আপনার থেকে থাকে, তবে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের চেয়ে একজন মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসকের দ্বারাই উপকৃত হবার সম্ভাবনা বেশি।
এখন বিষয় হচ্ছে, চুলকে তো সবাই-ই আরাম পায়, আর এটা তো রোজকার ঘটনা। তবে সবাই কি ডিলিউসরি প্যারাসাইটোসিসের রোগী? মোটেও না। বরং ১০০ জনে বড়জোর ২/৩ জনের এমন থাকতে পারে। তাহলে বাদবাকি সেই সাধারণদের জন্য ব্যাখ্যাটি আসলে কী?
জার্মান ডাক্তার স্যামুয়েল হ্যাফেনরেফারের দেয়া সংজ্ঞাটিই সাড়ে তিনশ বছর অবধি প্রচলিত পুরো বিশ্বে। যে শারীরিক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় আপনি শরীরের কোনো স্থানে ঘষে আরাম পেতে প্রলুব্ধ হন, সেটিই itch বা চুলকানি। সরলীকরণ করতে গেলে বলতে হয়, যে কারণে চুলকোতে (Scratch) ইচ্ছা হয়, সেটিই চুলকানি (Itch)। ব্যাপারটি অনেকটা বাড়ির ঠিকানা নিয়ে সে চুটকির মতো।
– তোমার বাড়ি কোথায়?
– চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে।
– চেয়ারম্যানের বাড়ি কোথায়?
– আমার বাড়ির পাশে।
এভাবে আসলে বাড়ির ঠিকানা কিংবা চুলকানির পরিচয় কোনোটাই স্পষ্ট হবে না। বিস্তারিত ঘটনায় প্রবেশ করা যাক। অনেকে ব্যথা ও চুলকানি নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকেন। কেউ আবার ভাবেন, ব্যথারই প্রাথমিক পর্যায় চুলকানি। প্রকৃতপক্ষে এ দুইটি আলাদা বিষয় এবং খুব সহজেই উভয়কে আলাদাও করা যায়।
যেমন ধরা যাক, একটি জ্বলন্ত শিখার ওপর হাত দিলেন আপনি। আনমনে থাকলেও খানিক বাদেই কিন্তু আপনি হাত সরিয়ে আনবেন। এটিই ব্যথা। ওদিকে চুলকানির সাথে আপনার সম্পর্কটা সরিয়ে দেবার নয়, বরং কাছে টেনে নেবার, বাড়তি মনোযোগ দেবার। আনমনে থাকলে পোকার কামড় টের পাবেন না। কিন্তু ঠিকই খানিক পরে কামড়ানো জায়গায় দু’ঘা ঘষে বা চুলকে নেবেন। এটিই চুলকানি। ব্যথার রিফ্লেক্স নিষ্ক্রিয় বা ঋণাত্মক। চুলকানির রিফ্লেক্স ধনাত্মক।
চুলকানি অনেক ধরনের হতে পারে। পোকামাকড়ের কামড়ে সাময়িক চুলকানি থেকে শুরু করে খোসপাঁচড়া, দাদ, কুষ্ঠ ইত্যাদি চর্মরোগেও চুলকানি হতে পারে। আবার লিভার সিরোসিস, ব্রেন টিউমার, এইডস ইত্যাদি জটিল রোগের ক্ষেত্রেও আক্রান্ত নিউরনের দরুন চুলকানি হতে পারে। ওদিকে মানসিকভাবেও যে চুলকানির ব্যারাম হতে পারে, তা ডিলিউসরি প্যারাসাইটোসিসের উপর্যুক্ত বর্ণনায় জেনেছেন। তবে আরো অনেক রকম প্রকরণও আছে এর।
এবারে আসা যাক চুলকানি দেহের অভ্যন্তরে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সে বিষয়ে। বহির্প্রভাবক কর্তৃক চামড়ার বাইরের স্তর এপিডার্মিস আক্রান্ত হলে কোষ থেকে হিস্টামিন নামক রস নিঃসরিত হয়। আগে ধারণা করা হতো, হিস্টামিনের ক্রিয়ায় ব্যথা ও চুলকানির জন্য বিশেষায়িত এক ধরনের স্নায়ুতন্তু ‘সি-ফাইবার’ কর্তৃক অনুভূতি সংকেতটি সুষুম্নাকাণ্ডে প্রেরিত হয়। ১৯৯৭ সালে আবিষ্কৃত হয় যে, ব্যথা ও চুলকানির জন্য আলাদা আলাদা রকম পরিবাহী স্নায়ুতন্তু আছে। এদের মাধ্যমে সুষুম্নাকাণ্ড হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায় চুলকানির সংকেত।
মস্তিষ্কের সোম্যাটোসেন্সরি কর্টেক্স দ্বারা চুলকানির প্রাবল্য নিরূপিত হয়। অন্যদিকে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স হচ্ছে মূলত ‘সুখের কেন্দ্র’। যেকোনো উত্তেজনার চরমতম মুহূর্তে ডোপামিন নিঃসরণের দ্বারা যেভাবে সুখানুভূতি তৈরি হয়, চুলকানির ক্ষেত্রেও একই হরমোন একইভাবেই কাজ করে। যেকোনো ধরনের নেশাগ্রস্থ তার নেশার কাজটি করে যে আরাম পান, তার ব্যাখ্যাও এই প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যপদ্ধতি থেকেই পাওয়া যায়। সেই নেশা হতে পারে সিগারেটের, হতে পারে হস্তমৈথুনের, হতে পারে চুলকানোর।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন (সেন্ট লুইস) এর একটি গবেষণায় এসেছে আরেকটি প্রসঙ্গ। চামড়া তথা দেহের ক্ষতি উপেক্ষা করে চুলকানোর দরুন ব্যথা তৈরি হয় খানিকটা। যা অনেকটা চুলকানি থেকে মস্তিষ্ককে ভুলিয়ে রাখে। অনেক সময় নানা রকম বহির্প্রদাহের ক্ষেত্রে আমরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করি – কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা বলে যেটিকে। জ্বলবার স্থানে চুন বা অন্য কোনো ভেষজ লাগিয়ে প্রায়ই দেখা যায় জ্বলুনি আরো তীব্র হয়। তা চলে যায় ব্যথার পর্যায়ে। ফলশ্রুতিতে, প্রাথমিক সমস্যাটি বা জ্বলুনি থেকে তাৎক্ষণিক উপশম লাভ করা যায়।
যাই হোক, অধিক চুলকানোর দরুন সৃষ্টি হওয়া ব্যথার ফলে নিঃসরিত হয় সেরোটোনিন নামক হরমোন। এটি আসলে ব্যথা বা চুলকানির আশু-উপশম দেয় না। কেবল ভালো লাগার অনুভূতি দিয়ে ব্যথা ভুলিয়ে রাখে। ফলে ব্যক্তি আরামের বন্যায় চুলকাতেই থাকেন, ওদিকে চুলকানিও জ্যামিতিক হারে বাড়তেই থাকে। এতে বাড়তে থাকে জীবাণু সংক্রমণের শঙ্কা। আবার সেরোটোনিন ক্ষরণ আটকালেও সমস্যা। দেহজ ও বয়োঃবৃদ্ধি, হাড়ের বিপাকসহ নানা কাজে লাগে এ হরমোন। একদিকে চুলকাতে চুলকাতে চুলকানি বাড়ে, অন্যদিকে হরমোন ক্ষরণও আটকে রাখা দায়। তাই গুরুতর চর্মরোগের ক্ষেত্রে এই Itch-Scratch এর চক্রকে ভাঙাটাই চিকিৎসার মূল কৌশল।
ওয়েক ফরেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডার্মাটোলজিস্ট ড. গিল ইয়োসিপোভিচ ১৩ জন সুস্থ-স্বাভাবিক ব্যক্তিকে নিয়ে একটি গবেষণা করেন। এমআরআই স্ক্যানারের মধ্যে নিয়ে উক্ত ব্যক্তিদের পায়ে চুলকে দেওয়া হচ্ছিলো। উল্লেখ্য, এ সময় কাউকেই চুলকানির কৃত্রিম সংবেদনা দেওয়া হয়নি। ড. ইয়োসিপোভিচ দেখেন, চুলকানোর দরুণ মস্তিষ্কের যে অংশটি স্মৃতি ও আনন্দ প্রক্রিয়াকরণ করে, সেটি সক্রিয় হয়।
একই সঙ্গে বেদনা ও আবেগ প্রক্রিয়াকারী অংশটি অবদমিত হয়। জার্নাল অব ইনভেস্টিগেটিভ ডার্মাটোলজিতেও এসেছে এই গবেষণার কথা। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, গোড়ালি, পিঠে চুলকানির প্রাবল্য বেশি। ফলে দেহের অন্যান্য জায়গার চেয়ে এসব জায়গায় চুলকে বেশি আরাম পাওয়া যায়।
চুলকালে ভালো লাগে কেন, এ নিয়ে গবেষণা অবশ্য থেমে নেই। বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি আছে দার্শনিক ব্যাখ্যাও। তেমনই এক ব্যাখ্যার কথাই বলছি। মনে করা হয়, যৌন সঙ্গম সুখদায়ক বলেই সন্তান উৎপাদনের ব্যাপারে আমাদের নিরুৎসাহ তৈরি হয় না। খাওয়া সুখদায়ক বলেই দেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধিসাধনের জন্য ‘পরিশ্রম’ করতে আমাদের খারাপ লাগে না।
প্রকৃতি নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতেই উক্ত কাজগুলোকে আনন্দদায়ক করেছে, কেননা আনন্দলাভ ব্যতীত আমরা কিছুই করতে চাই না। তবে চুলকানির পেছনে প্রকৃতির মহান উদ্দেশ্যটি কী? এ ব্যাপারে দার্শনিক ব্যাখ্যা বলে, চুলকানির স্থানে নখ দিয়ে ঘষার ফলে অনেক সময় জীবাণুর স্থানান্তর ঘটে, যা তার বংশবিস্তার ঘটায়। আর এই ব্যাপারটিই এতটা নির্বিঘ্ন হতো না, যদি চুলকানি আরামদায়ক না হতো।
বিব্রতকর, ক্ষতিকর ইত্যাদি নেতিবাচকতার ভীড়ে ‘সুখকর’ পরিচয়টিই মুখ্য হয়ে ওঠে চুলকানোর ক্ষেত্রে। তবে সাময়িক তৃপ্তিলাভের জন্য ক্রমশ জেঁকে বসতে চাওয়া চুলকানিকে প্রশ্রয় না দেওয়াই ভালো। সহনশীলতা না দেখানো কিংবা বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া কেবল শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, বরং সামাজিক স্বাস্থ্যের পক্ষেও খারাপ।
ফিচার ইমেজ- medium.com