- মৃত্যুর আগপর্যন্ত হিটলারের পাশে ছিলেন সহধর্মিনী ইভা ব্রাউন
- মাগদার সাথে হিটলারের ঘনিষ্ঠতা ঈর্ষান্বিত করে তুলেছিল তার স্বামীকে
- গেলি রোবালের সাথে হিটলারের সম্পর্কটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন
- উইনিফ্রেডের সাথে হিটলারের বিয়ে হতে যাচ্ছে, এমনটাই ভেবেছিল সবাই
১. ইভা ব্রাউন
অ্যাডলফ হিটলারের ঘনিষ্ঠ নারীদের কথা বলতে গেলে সবার আগে অবধারিতভাবে যে নামটি চলে আসবে, তিনি আর কেউ নন, তারই সহধর্মিনী ইভা ব্রাউন। সতের বছর বয়সী ইভার সাথে পরিচয়ের সময় হিটলার ছিলেন চল্লিশ বছরের এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। তবুও হিটলারের মাঝে এমন কিছু একটা ছিল, যা তেইশ বছরের ব্যবধানকেও তুচ্ছ প্রমাণ করেছিল ইভার কাছে।
দুজনের পরিচয়ের সময়ে ইভা কাজ করতেন একজন ফটোগ্রাফারের সহকারী হিসেবে। অন্য আট-দশটা সম্পর্কের মতো হিটলার-ইভার সম্পর্কও দেখেছে উত্থান-পতনের মুখ। তবে সেটা হয়তো মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, কারণ হিটলারের সাথে অভিমান করে ইভা দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়।
তাদের দুজনের মাঝে সম্পর্কটা বেশ গাঢ়ই ছিল বলতে হবে। একবার ইভা হিটলারের মিউনিখের ফ্ল্যাটে তোলা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইনের একটি ছবি দেখাচ্ছিলেন। সেখানে চেম্বারলেইন যে সোফায় বসে ছিলেন, সেটাকে নির্দেশ করে তিনি নাকি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “যদি তিনি জানতেন যে এই সোফাটা কতকিছু দেখে ফেলেছে!”
হিটলারের এতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জার্মান জনগণ আসলে ইভা ব্রাউনের সম্পর্কে তেমন কিছু একটা জানতো না। তার অধিকাংশ সময়ই কাটতো ওবারসাল্জবার্গে হিটলারের ব্যক্তিগত অবকাশযাপন কেন্দ্রে। জনসমক্ষেও তাকে খুব একটা আসতে দেখা যেত না।
জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত হিটলারকে সমর্থন জানিয়ে গেছেন ইভা। ১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল ছোটখাট এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে দুজন বিয়ের কাজটা সেরে ফেলেন। তবে এ দম্পতির বিবাহিত জীবনের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টা। কারণ এরপরই তারা দুজন একত্রে আত্মহত্যা করে বসেন। একটি সায়ানাইডের পিল মুখে পুরে দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন ইভা।
২. মাগদা গোয়েবল্স
মাগদা গোয়েবল্স ছিলেন নাৎসি মিনিস্টার জোসেফ গোয়েবল্সের স্ত্রী। জোসেফ গোয়েবল্স ১৯৩৩-৪৫ সাল পর্যন্ত প্রায় এক যুগ ধরে নাৎসি বাহিনীর প্রোপ্যাগান্ডা মিনিস্টার হিসেবে কাজ করে গেছেন। শোনা যায়, তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে যতটা না ছিল ভালোবাসা, তারচেয়েও বেশি ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধার। এ দম্পতির ঘরে মোট ছয় সন্তান জন্ম নিয়েছিল। জোসেফ গোয়েবল্স মাগদাকে নিয়ে কখনোই তেমন একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই স্ত্রীর কাছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেননি তিনি। অন্যদিকে হিটলারের সাথে মাগদার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও তাকে মানসিক পীড়া দিত।
থার্ড রাইখের একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন মাগদা। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় যখন আস্তে আস্তে হিটলার বাহিনীর প্রতিকূলে যাওয়া শুরু করে, তখন যেন মাগদাও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন নিজের সমর্থন নিয়ে। একবার তাই রেডিওতে হিটলারের ভাষণ সম্প্রচারের সময় তিনি হুট করে সেটা বন্ধ করে বলে বসেন, “কী সব আজেবাজে কথাবার্তা!”
সে যা-ই হোক, আসল কথা হলো হিটলার-ব্রাউনের মৃত্যুর পর মৃত্যু ঘটেছিল মাগদা-জোসেফেরও। আর সেটাও ঠিক তাদের নেতার মতোই, অর্থাৎ আত্মহত্যা। তবে আত্মহত্যার আগে তারা করে গিয়েছিলেন নিকৃষ্ট এক কাজ, একে একে খুন করেছিলেন নিজেদের ছয় সন্তানকেই। এজন্য প্রথমে তাদেরকে মরফিন প্রয়োগে ঘুম পাড়ানো হয়। এরপর সবার মুখে একটি করে সায়ানাইডের পিল রেখে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন তারা। সন্তানদের খুন করে এরপর তারাও একইদিনে আত্মহত্যা করেন।
৩. গেলি রোবাল
গেলি রোবাল ছিলেন হিটলারের সৎবোন অ্যাঞ্জেলার মেয়ে। লুডউইগ ম্যাক্সিমিলান ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করতে মামার বাসায় উঠেছিলেন তরুণী গেলি। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে শুরু থেকেই হিটলার গেলির উপর কর্তৃত্ব খাটাতে চাইতেন বলে শোনা যায়। এমনকি ভাগ্নির প্রতি তার দুর্বলতার কথাও বলেছেন অনেকে।
হিটলারের ব্যক্তিগত গাড়ির চালক এমিল মরিসের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল গেলির। এটা জানামাত্রই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়েছিলেন হিটলার। সাথে সাথেই গেলিকে তিনি বাধ্য করেন এ সম্পর্ক ছিন্ন করতে, সেই সাথে মরিসকে করেন চাকরিচ্যুত। এরপর থেকে গেলি যত সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতেন, সব জায়গায় তার সাথে একজনকে অভিভাবক হিসেবে পাঠানো হতো।
সহজ করে বলতে গেলে হিটলারের কাছে একপ্রকার বন্দীই হয়ে পড়েছিলেন গেলি। এ বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পেতে তিনি চেয়েছিলেন ভিয়েনায় চলে যেতে। কিন্তু হিটলার তাতেও বাধ সাধেন। ১৯৩১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে মামা-ভাগ্নীর মাঝে তর্ক-বিতর্কও চলেছিল। গেলিকে মানা করে হিটলার ন্যুরেমবার্গে চলে গিয়েছিলেন একটি মিটিংয়ে যোগ দিতে। কিন্তু পরদিনই তাকে ফেরত আসতে হয়েছিল। কারণ মামার ওয়ালথার পিস্তলটি দিয়ে নিজের বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন গেলি রোবাল। সেসময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর।
হিটলারের সাথে গেলির ঘনিষ্ঠতা কতটুকু ছিল, সেটা কি শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়িয়েছিল কিনা- এমন সব বিষয় নিয়ে ইতিহাসবিদগণ আজও একমত হতে পারেন নি। হয় গেলি হিটলারের প্রতি ভালোবাসার অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, নাহয় এ বন্দী জীবন তার কাছে আর ভালো লাগছিল না- এ দুয়ের কোনো একটাই তার স্বেচ্ছামৃত্যুর কারণ বলে মনে করেন তারা।
৪. এমি গোয়েরিং
জার্মান অভিনেত্রী এমি গোয়েরিং ছিলেন নাৎসি লুফটওয়াফে বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হারম্যান গোয়েরিংয়ের স্ত্রী। লোকে তাকে ‘ফার্স্ট লেডি অফ দ্য থার্ড রাইখ’ নামেই বেশি চিনতো, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে রাষ্ট্রীয় নানা অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ নানা দায়িত্ব তাকেই পালন করতে দেখা যেত। তবে এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে হিটলারের সাথে ভালো সম্পর্কের কারণে এমিকে অপছন্দ করতেন ইভা ব্রাউন। একই কথা এমির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুজনের এ দ্বন্দ্বের কারণেই কখনো বার্ঘফে হিটলারের বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি এমির।
সে যা-ই হোক, আপামর জনতার কাছে এমি ছিলেন বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয় এক মুখ। অমিতব্যয়ী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। প্রায় সময়ই পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে লেখা আসতো। নিজেদের বাড়িগুলোর সৌন্দর্য বর্ধনে এমি ও হারম্যান যে চিত্রকর্মগুলো ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলো মূলত বিভিন্ন সময় ইহুদিদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।
বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ততার দায়ে এমিকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। একবছর কারাভোগের পর মুক্তি পান তিনি। তবে মঞ্চে অভিনয়ের অনুমতি আর মেলেনি। মিউনিখেরই ছোট্ট এক এপার্টমেন্টে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে ১৯৭৩ সালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এমি গোয়েরিং।
৫. উইনিফ্রেড ওয়াগনার
জাতিতে ইংরেজ এই রমনীর সাথে হিটলারের বন্ধুত্বের সূচনা ঘটে ১৯২০ সালের শুরুর দিককার সময়ে। ১৯৩৩ সালে পরিচিত মহলে অনেকেই মনে করতো যে, বিধবা ওয়াগনারের সাথেই বোধহয় গাটছাড়া বাধতে যাচ্ছেন অ্যাডলফ হিটলার। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। অবশ্য এতে তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বে কোনো ফাটল ধরেনি।
ইতিহাসবিদ এবং ওয়াগনারের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, ইহুদিদের ব্যাপারে হিটলারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ওয়াগনার একেবারেই পছন্দ করতেন না। তবে এতকিছুর পরেও হিটলার ছিলেন তার খুব কাছের বন্ধু। ১৯৮০ সালে মারা যান তিনি।
৬. এলসা ব্রাকম্যান
এলসা ব্রাকম্যান জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। তার বাবা থিওডোর ছিলেন রোমানিয়ার প্রিন্স। তার নিজেরও উপাধি ছিল প্রিন্সেস ক্যান্টাকুজিন অফ রোমানিয়া। জার্মান প্রকাশক হ্যুগো ব্রাকম্যানের সাথে বিয়ে হয়েছিল এলসার। স্বামী-স্ত্রী দুজনই হিটলারের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তার ক্যারিয়ারের একেবারে শুরু থেকেই তারা মানসিক ও আর্থিক উভয়ভাবেই হিটলারের পাশে থেকে গেছেন।
বিশেষ করে এলসার কথা বলতেই হয়। হিটলারের প্রতি তার আত্মনিবেদন এতটাই ছিল যে মাঝে মাঝেই সমাজের উঁচু মহলের মানুষদের নিয়ে তিনি সমাবেশের আয়োজন করতেন, যার ফলশ্রুতিতে হিটলার তাদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেতেন, বিস্তৃত করতেন তার মতাদর্শ ও নেটওয়ার্ক। ১৯৪৬ সালে মৃত্যু হয় এলসা ব্রাকম্যানের।
ফিচার ইমেজ: NRK