১৯৬৬ সালের ২১ অক্টোবর, সকাল নয়টা; ওয়েলসের এক গ্রাম আবেরফানের স্কুল গমগম করছে ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলে। ৮ বছরের জেফ এডওয়ার্ডসের শিক্ষক বোর্ডে লেখা শুরু করেছেন মাত্র। এমন সময় গুমগুম শব্দ ভেসে এলো দূর থেকে।
গ্রামের অনেকেই শব্দটা শুনেছিল, কিন্তু কুয়াশার চাদরে চারদিক ঢাকা থাকায় বিপদ দেখতে ব্যর্থ হলো তারা। কেউ কিছু বোঝার আগেই টনকে টন কাদামাটি আছড়ে পড়লো স্কুলঘরের ওপর। শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেল অনেকগুলো জীবন!
বহু পরে তৎকালীন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রাইভেট সেক্রেটারি লর্ড চার্টেরিসকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়- এমন কোনো ঘটনা আছে কিনা, যখন রানী নিজের কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পরবর্তীতে অনুতাপ প্রকাশ করেছেন। লর্ড চার্টেরিস এককথায় উত্তর দিয়েছিলেন, আবেরফান! কিন্তু কেন?
আবেরফান দুর্ঘটনা
গত শতকের পঞ্চাশ আর ষাটের দশক পর্যন্ত দক্ষিণ ওয়েলসের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল কয়লাশিল্প। ওয়েলসের নানা পাহাড় ও উপত্যকা থেকে আহরিত হতো এই কয়লা, যাকে ঘিরে গড়ে উঠত জনবসতি। প্রায় সারাক্ষণই কুয়াশায় ঢেকে থাকা গ্লামারগনের আবেরফান তেমনই এক গ্রাম। নিকতবর্তী মার্থির ভেলের কয়লাখনি (Merthyr Vale) দক্ষিণ ওয়েলসের সবচেয়ে বড়। এর সাথে জড়িত এখানকার প্রায় ৮,০০০ মানুষের রুটিরুজি।
কয়লাখনি চালু হয় ১৮৬৯ সালে। খনির সমস্ত ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য বেছে নেয়া হয় মার্থির পাহাড়কে, ফলে উঁচু হয়ে যাচ্ছিল এই পাহাড়। ১৯৫৮ সাল থেকে পাহাড়ের চূড়ার একাংশে স্তূপ করা হয় ময়লা, যা কিনা আবেরফানের প্যান্টগ্লাস স্কুলের উপর অবস্থিত।
১৯৬৩ সালে জাতীয় কয়লা বোর্ডকে লেখা চিঠিতে এক প্রকৌশলী সতর্ক করেন যে, ময়লা-আবর্জনা জমে যে কাদার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা শীত বা বৃষ্টির সময় ধসে পড়তে পারে। এরকম হলে ঝুঁকিতে পড়বে স্কুল। কিন্তু কয়লা বোর্ড ধামাচাপা দিয়ে দেয় এই চিঠি। হুমকি দেয়- এর কথা প্রকাশ পেলে খনি বন্ধ করে দেয়া হবে, তাহলে হঠাৎ বেকার হয়ে পড়বেন গ্রামের সিংহভাগ লোক।
অক্টোবরের সেই সকালে উচ্ছল ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হয় স্কুলে। তারা বিভোর পরদিন থেকে শুরু হতে যাওয়া লম্বা ছুটির পরিকল্পনায়। কারোরই জানা নেই, এই ছুটি অনেকের জন্যই চিরদিনের ছুটি হতে চলেছে।
স্কুলের উপরে ঝুলে থাকা চূড়া ততদিনে কাদামাটি জমে ১১১ ফুট ছুঁই ছুঁই করছে, ওজনে হয়েছে চার লাখ টনের কিছু বেশি। সকাল ৭:৩০ মিনিটে শ্রমিকেরা খেয়াল করলেন- কাদা গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে। তখনও বড় আকারে দুর্ঘটনার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তবে সোয়া নয়টার সময় ভয়ঙ্কর শব্দে শুরু হয় পাহাড়ধস। প্রায় ৩০ ফুট উঁচু থকথকে কাদার ঢেউ ঘণ্টায় আশি মাইল গতিতে ছুটে যায় সবচেয়ে কাছের টার্গেট প্যান্টগ্লাস স্কুলের দিকে। মুহুর্তেই চাপা পড়েন শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা।
গ্রামবাসী হাত দিয়ে মাটি খুঁড়ে উদ্ধারকাজ আরম্ভ করে, দ্রুত প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীরা তাদের সাথে যোগ দেয়। অক্ষতাবস্থায় পাওয়া যায় পাঁচ ছাত্রছাত্রীকে। স্কুলের কর্মচারী ন্যান্সি উইলিয়ামস নিজের শরীর দিয়ে তাদের ঢেকে রেখেছিলেন, তিনি মারা গেলেও বেঁচে যায় শিশুরা। ডেভিড বেনিয়ন নামে এক শিক্ষক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি ক্লাসের কাউকে, নিজেও মারা যান। এগারোটায় শেষ জীবিত ব্যক্তি হিসেবে জেফ এডওয়ার্ডসকে উদ্ধার করা হয়। ১৪৪ জন মারা যায়, যাদের ১১৬ জনই শিক্ষার্থী।
দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি জাতীয় কয়লা বোর্ডকে দোষারোপ করলেও তারা দায় অস্বীকার করে, তবে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। প্রথমে প্রতি পরিবারকে ৫০ পাউন্ডের প্রস্তাব দিলেও শেষ পর্যন্ত ৫০০ পাউন্ডে রফা হয়। অবশ্য ময়লা সরানোর অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানায় বোর্ড, সেজন্য আলাদা ফান্ড গঠন করতে হয় সরকারকে। খনিতে কাজ স্থগিত থাকে তেইশ বছর। ১৯৮৯ সালে পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে যায় এই খনি।
রানীর আক্ষেপ
স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন যুক্তরাজ্যের রানী হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথকে অবহিত করা হয়েছিল আবেরফান সম্পর্কে। অনেকেই আশা করেছিলেন, তিনি অতিসত্বর উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন। কিন্তু তাদের অবাক করে রানী প্রথমে পাঠান তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপকে। রানীর বোনজামাই লর্ড স্নোডেনও যোগ দেন। এলিজাবেথ নিজে যান দুর্ঘটনার আট দিন পর।
রানীর জীবনীলেখক স্যালি বেচডেল স্মিথের মতে- দেরি করার যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল। এলিজাবেথ মনে করেছিলেন- এত তাড়াতাড়ি তিনি গেলে আবেরফানের মূল দুর্যোগ থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে যেতে পারে। ঠিক সেই মুহূর্তে শোক করবার জন্য গ্রামবাসীদের যে সুযোগ দরকার, তার আগমনে উল্টো বাধাগ্রস্ত হবে তা। চলমান উদ্ধার কার্যক্রমও ব্যাহত হতে পারে।
এলিজাবেথের অনেক উপদেষ্টাই অবশ্য একমত ছিলেন না এই সিদ্ধান্তের সাথে। নানাদিক থেকে তার ওপর চাপ আসতে থাকে। তবে তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, আবেরফানে যান ২৯ অক্টোবর। শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দেন তিনি।
যাদের নিয়ে এত শোরগোল, সেই আবেরফানবাসী কী মনে করেছিল? ২০০২ সালে জেফ এডওয়ার্ডস বলেন, দেরি করে আসাতে কেউ রানীকে দোষ দেয়নি, বরং এটাই ভালো হয়েছে। কারণ, দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরে বিরাজ করছিল চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, রানী এলে তা বাড়তো বৈ কমত না। রানী এসেছেন কিনা সেটা দুর্ঘটনার পর দেখার অবস্থায় ছিলেন না স্থানীয়রা। নিহত এক শিশুর মা বলেছিলেন, পরে যখন রানীকে দেখতে পান তারা, মনে হয়েছিল প্রথম থেকেই বোধহয় সঙ্গে আছেন তিনি।
রাজপরিবারের তৎকালীন প্রেস সেক্রেটারি স্যার উইলিয়াম হ্যাসেলটাইনের মতে, রানীর মনোজগতে গভীর রেখাপাত করে এই দুর্ঘটনা। লর্ড চার্টেস জানান, বহু বছর পর পেছনে তাকিয়ে এলিজাবেথ নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন। আরেকটু আগে, বা একেবারে সাথে সাথেই কি তিনি যেতে পারতেন না? সেটাই কি উচিত হতো? এই অনুতাপ তিনি বয়ে চলেছেন আজীবন।
তবে আবেরফানকে ভুলে যাননি রানী। মৃত্যুর আগে আরো চারবার সেই গ্রামে সফর করেছেন তিনি। ২০১৬ সালে, দুর্ঘটনার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লসকে দিয়ে ব্যক্তিগত বার্তা পাঠান রানী। দেরিতে গিয়ে তিনি যদি ভুল করেও থাকেন, গ্রামবাসী কিন্তু সেজন্য তাকে কখনো দোষারোপ করেনি। এটাও একেবারে অস্বীকার করা যাবে না যে, তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাথে সাথে আবেরফান সফর করেননি, তা কিন্তু একেবারে অযৌক্তিক ছিল না।