‘আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ ছিল মুসলিম ও তুর্কি বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু মাত্র দুই বছর পর বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ (সংক্ষেপে সোভিয়েত রাশিয়া) আজারবাইজান আক্রমণ করে এবং রাষ্ট্রটির ক্ষমতাসীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তদস্থলে একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। নতুন এই রাষ্ট্র আরো দুই বছর আইনত স্বাধীন থাকে, কিন্তু এ সময় রাষ্ট্রটি সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। ১৯২২ সালে রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে এবং এর মধ্য দিয়ে আজারবাইজানের সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটে।
১৮০৪–১৮১৩ এবং ১৮২৬–১৮২৮ সালের রুশ–ইরানি যুদ্ধদ্বয়ে তদানীন্তন রুশ সাম্রাজ্যের নিকট ইরান পরাজিত হয় এবং বর্তমান আজারবাইজানের ভূমি রুশদের নিকট হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে আজারবাইজানিরা প্রতিবেশী জর্জীয় ও আর্মেনীয়দের সঙ্গে মিলে একটি ফেডারেশন গঠন করে, কিন্তু নানা কারণে ফেডারেশনটি ব্যর্থ হয় এবং ১৯১৮ সালের ২৮ মে আজারবাইজানি নেতারা ‘আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রটির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী ‘মুসাভাৎ’ দল। রাষ্ট্রটি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে এবং ওসমানীয় সৈন্যদের সহায়তায় আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদী (‘দাশনাক’) ও বলশেভিকদের কাছ থেকে তেলসমৃদ্ধ বাকু দখল করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর আজারবাইজান মিত্রশক্তির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে। একই সময়ে তারা প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার সঙ্গে একটি প্রলম্বিত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং জর্জিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। তদুপরি, রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরে তীব্র বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়। জাতিগত আর্মেনীয়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে, আজারবাইজানি বলশেভিকরা একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে এবং কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তীব্র হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে সংঘটিত অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, রুশ রাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযোগের বিচ্ছিন্নতা, খাদ্য সঙ্কট, কৃষিখাতে বিপর্যয় এবং সর্বোপরি তেল উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাস পাওয়ার কারণে আজারবাইজান ক্রমশ তীব্র একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত হয়।
তদুপরি, ক্ষমতাসীন মুসাভাৎ দলের মধ্যেকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আজারবাইজানি সরকারকে প্রায় অকার্যকর করে ফেলে। দলটির ডানপন্থী ও বামপন্থী অংশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত তীব্র বিরোধ এই পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটায়। দলটির ডানপন্থী অংশ (যাদের মধ্যে ছিলেন আজারবাইজানি রাষ্ট্রনায়ক ফাতালি খান খোয়স্কি) মিত্রশক্তির সঙ্গে মৈত্রী বজায় রাখতে এবং বৃহত্তর তুর্কি ও মুসলিম বিশ্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে আগ্রহী ছিল। অন্যদিকে, দলটির বামপন্থী অংশ (যাদের মধ্যে ছিলেন আজারবাইজানি রাষ্ট্রনায়ক মাম্মাদ হাসান হাজিনস্কি) সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে এবং অর্থনৈতিক সংযোগ পুনঃস্থাপন করতে আগ্রহী ছিল। ইতোমধ্যে বৈদেশিক যুদ্ধ, জাতিগত ও শ্রেণি সংঘাত এবং সশস্ত্র দস্যুদলগুলো তাণ্ডবের কারণে আজারবাইজানের ওপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা মুসাভাৎ সরকারের জন্য ক্রমশ অসম্ভব হয়ে ওঠে।
১৯২০ সালের ২৩ মার্চ আজারবাইজানের কারাবাখ অঞ্চলের জাতিগত আর্মেনীয়রা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আর্মেনিয়ার সক্রিয় সমর্থনে বিদ্রোহ করে। কিছু কিছু সূত্রমতে, এই বিদ্রোহ শুরু পশ্চাতে সোভিয়েত রুশ গোয়েন্দা সংস্থারও ভূমিকা ছিল। আজারবাইজানি সরকার তাদের সেনাবাহিনীর সিংহভাগকে আর্মেনীয় বিদ্রোহ দমনের জন্য কারাবাখে প্রেরণ করে। অন্যদিকে, এ সময় আজারবাইজানে বলশেভিকরা ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠছিল এবং তাদের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিশেষত বাকু শহরের তেল শ্রমিক ও সৈনিকদের মধ্যে তাদের বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। আজারবাইজানি বলশেভিকরা সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে নিজেদের কার্যক্রম সমন্বয় করছিল এবং মস্কো থেকে সর্বাত্মক সহায়তা পাচ্ছিল।
১৯২০ সালের ২৭ এপ্রিল আজারবাইজানি বলশেভিকরা বাকুতে একটি অভ্যুত্থান ঘটায় এবং একই দিনে সোভিয়েত রুশ লাল ফৌজের ১১তম আর্মি ও ভোলগা–কাস্পিয়ান সামরিক নৌবহর আজারবাইজান আক্রমণ করে। আজারবাইজানে বলশেভিক অভ্যুত্থানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ‘মুসলিম সামাজিক গণতন্ত্রী দল’-এর (‘হুম্মাত’ নামে বেশি পরিচিত) প্রাক্তন সভাপতি নারিমান নারিমানভ এবং আজারবাইজানি লাল নৌবহরের প্রধান চিঙ্গিজ ইলদিরিম। এসময় আজারবাইজানি সেনাবাহিনীর মূল অংশ কারাবাখে আর্মেনীয়দের বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিল, ফলে বাকু ও উত্তর আজারবাইজান প্রায় অরক্ষিত ছিল। এর ফলে বলশেভিকরা সহজেই সম্পূর্ণ আজারবাইজানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
ইলদিরিম আজারবাইজানি সরকারকে একটি চরমপত্র প্রদান করেন এবং অবিলম্বে বলশেভিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান। আজারবাইজানি আইনসভা একটি জরুরি অধিবেশনের পর এই চরমপত্র গ্রহণ করে এবং আজারবাইজানি বলশেভিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। আজারবাইজানি প্রধানমন্ত্রী মাম্মাদ হাসান হাজিনস্কি পদত্যাগ করেন এবং বলশেভিক দলে যোগদান করেন। ১৯২০ সালের ২৮ এপ্রিল ‘আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নারিমান নারিমানভের সভাপতিত্বে আজারবাইজানি বিপ্লবী কমিটি রাষ্ট্রটির শাসনভার গ্রহণ করে। রাষ্ট্রটি আইনত স্বাধীন ছিল এবং তাদের নিজস্ব সরকার, সশস্ত্রবাহিনী ও পররাষ্ট্রনীতি ছিল। কিন্তু প্রায় আড়াই বছর পর ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে এবং আজারবাইজানের সার্বভৌম অস্তিত্বের অবসান ঘটে।
উল্লেখ্য, বলশেভিকরা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের তীব্র বিরোধী ছিল, এবং খোদ রুশ সাম্রাজ্যেরও কঠোর সমালোচক ছিল। বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির লেনিন রুশ সাম্রাজ্যকে ‘জাতিসমূহের কারাগার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বক্সার বিদ্রোহ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রুশ সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বলশেভিকরা আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার প্রতিটি জাতিকে সোভিয়েত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকার প্রদান করেছিল। আজারবাইজান কর্তৃক রুশ রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বাহ্যিকভাবে বলশেভিকদের জাতীয়তা নীতিরই বাস্তবায়ন। তাহলে সোভিয়েত রাশিয়া কেন ১৯২০ সালে আজারবাইজান আক্রমণ করল এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রটিকে সোভিয়েত রাষ্ট্রে অঙ্গীভূত করে নিল?
প্রথমত, বলশেভিকরা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরোধী ছিল, কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ ছিল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর বৈশিষ্ট্য। তাদের মতে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা এবং নতুন ও স্থায়ী বাজার সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্য বিস্তার করে এবং বিভিন্ন অঞ্চলকে উপনিবেশে পরিণত করে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেহেতু (তাত্ত্বিকভাবে) সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জনসাধারণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়, সেহেতু বলশেভিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো অধিকৃত ভূখণ্ডের/উপনিবেশের সম্পদ যেভাবে শোষণ করে এবং সেখানকার অধিবাসীদের প্রতি যেভাবে বৈষম্য করে, কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেটা করবে না। বরং কোনো ভূখণ্ড সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হস্তগত হলে তারা সেই ভূখণ্ডের সম্পদকে ভূখণ্ডটির অধিবাসীদের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টণ করবে এবং মূল রাষ্ট্রের অধিবাসীদের প্রতি যেরূপ আচরণ করা হয়, অধিকৃত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের প্রতিও একই আচরণ করবে।
একই সঙ্গে বলশেভিকরা ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদী। তারা জাতীয়তাবাদের তীব্র বিরোধী ছিল এবং জাতীয়তাবাদের বিস্তারের ফলে কোনো জাতির সদস্যদের মধ্যে যে জাত্যাভিমান, শ্রেষ্ঠত্ববোধ ও অন্য জাতির প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হয়, সেটিকে মানবজাতির মুক্তির পথে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করত। বলশেভিকদের দৃষ্টিতে, পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদী ব্যবস্থার অধীনে কোনো জাতির প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন সম্ভব নয়, বরং সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদী ব্যবস্থার অধীনেই জাতিসমূহের প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করা সম্ভব।
এই আদর্শিক অবস্থান থেকে বলশেভিকরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের কোনো ভূখণ্ডকেই পুঁজিবাদী ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলোর হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র রুশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃত ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল জাতিকে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং এই রাষ্ট্রটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিস্তার ঘটানো। কিন্তু বলশেভিক বিপ্লবের পর কেন্দ্রীয় শক্তির আক্রমণ, গৃহযুদ্ধ ও মিত্রশক্তির আক্রমণের ফলে বলশেভিকরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের বেশকিছু প্রান্তিক অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এরকমই একটি অঞ্চল ছিল আজারবাইজান।
বলশেভিকরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের প্রতিটি হারানো ভূখণ্ড ফিরে পেতে বদ্ধপরিকর ছিল, এবং আজারবাইজানও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বলশেভিকদের দৃষ্টিতে আজারবাইজানের পশ্চিমাপন্থী, বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী ও আর্মেনীয়বিদ্বেষী মুসাভাৎ সরকার ছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদেরই একটি বর্ধিতাংশ মাত্র। এজন্য আজারবাইজানের স্বাধীনতাকে তারা প্রকৃত স্বাধীনতা হিসেবে বিবেচনা করত না এবং আজারবাইজানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তারা স্বীকৃতিও প্রদান করেনি। বলশেভিকদের ধারণা ছিল, আজারবাইজানে সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল পশ্চাৎপদ, প্রায় নিরক্ষর ও কৃষিপ্রধান আজারবাইজানি জাতির প্রকৃত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এজন্য ১৯২০ সালে যখন রুশ গৃহযুদ্ধের তীব্রতা স্তিমিত হয়ে আসছিল এবং আজারবাইজান রাজনৈতিক ও আর্থ–সামাজিক সঙ্কটে নিপতিত ছিল, তখনই বলশেভিকরা আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করে সেখানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
দ্বিতীয়ত, বলশেভিকদের আজারবাইজান আক্রমণের পশ্চাতে আদর্শিক বিচার–বিবেচনার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, কিন্তু আদর্শিক কারণই এই আক্রমণের একমাত্র কারণ ছিল না। এর সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত বিভিন্ন কারণও জড়িত ছিল। আজারবাইজানের রাজধানী বাকু ও সংশ্লিষ্ট আবশেরন উপদ্বীপে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলের মজুদ রয়েছে, এবং বাকু ছিল প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের বৃহত্তম তেল উৎপাদন কেন্দ্র। আজারবাইজানের মুসাভাৎ সরকার পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষত ব্রিটেনের, সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, এবং বলশেভিকরা আশঙ্কা করছিল, পশ্চিমারা আজারবাইজানকে একটি বলশেভিকবিরোধী ঘাঁটিতে পরিণত করতে পারে।
তাদের এই আশঙ্কা নিতান্ত অমূলক ছিল না। আজারবাইজান আক্রমণের আগে সোভিয়েত রুশরা দক্ষিণ রাশিয়ায় আন্তন দেনিকিনের নেতৃত্বাধীন শ্বেত ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। দেনিকিন পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। তিনি আজারবাইজানের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিলেন এবং ১৯২০ সালের প্রথম দিকে আজারবাইজানে সৃষ্ট খাদ্য সঙ্কটের পেছনে এই অবরোধ ছিল অন্যতম কারণ।
১৯২০ সালের প্রথমদিকে বলশেভিক লাল ফৌজের নিকট দেনিকিনের শ্বেত ফৌজ ক্রমশ পরাজিত হচ্ছিল এবং পশ্চাৎপসরণ করছিল। বলশেভিকরা ক্রমশ ককেশাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এমতাবস্থায় মিত্রশক্তি আশঙ্কা করতে থাকে যে, ককেশাসে যদি বলশেভিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে বলশেভিক মতবাদের বিস্তার ঘটবে এবং এতদঞ্চলে পশ্চিমা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেবে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড জির্জ কার্জন প্রস্তাব করেন, মিত্রশক্তির উচিত অনতিবিলম্বে আজারবাইজান ও জর্জিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা। এই রাষ্ট্র দুটি বলশেভিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে বলশেভিকদের পক্ষে প্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে এই রাষ্ট্র দুটি বলশেভিক সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে জলজ্যান্ত প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে।
এই উদ্দেশ্যে ১৯২০ সালের ১১ জানুয়ারি মিত্রশক্তি আজারবাইজানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এদিকে ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারি সোভিয়েত রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিওর্গি চিচেরিন আজারবাইজানি সরকারকে একটি বার্তা প্রেরণ করেন এবং দেনিকিনের বিরুদ্ধে মিত্রতা স্থাপনের জন্য তাদেরকে প্রস্তাব দেন। আজারবাইজানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতালি খান খোয়স্কি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং জানান যে, আজারবাইজান সোভিয়েত রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নয়।
এর প্রত্যুত্তরে প্রেরিত একটি চিঠিতে চিচেরিন আজারবাইজানি সরকার অসহযোগিতামূলক ও শত্রুভাবাপন্ন আচরণের দায়ে অভিযুক্ত করেন। ফেব্রুয়ারিতে খোয়স্কি এর জবাবে জানান, যে কোনো ধরনের আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়াকে আজারবাইজানের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। চিচেরিন এর পাল্টা জবাব দিয়ে জানান, স্বীকৃতি দেয়া বা না দেয়ার ফলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না এবং আজারবাইজান সোভিয়েত রাশিয়ার মৈত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে হিসেবে সোভিয়েত রুশ সরকার গণ্য করবে।
বস্তুত এ সময় সোভিয়েত রাশিয়া আজারবাইজানকে মৈত্রীর প্রস্তাব দিয়ে রাষ্ট্রটির নেতৃবৃন্দের মনোভাব পরীক্ষা করছিল। কিন্তু মিত্রশক্তির সর্বোচ্চ পরিষদ সোভিয়েত রুশ প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আজারবাইজানকে সামরিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এর ফলে আজারবাইজানি সরকার ধারণা করে যে, সম্ভাব্য সোভিয়েত রুশ আক্রমণের ক্ষেত্রে মিত্রশক্তি আজারবাইজানকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করবে। এই বিশ্বাসে তারা সোভিয়েত রুশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অন্যদিকে, আজারবাইজানি সরকার মৈত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মস্কো তাদেরকে শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে এবং এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করতে থাকে।
তৃতীয়ত, সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক আজারবাইজান আক্রমণের পশ্চাতে সোভিয়েত রাশিয়ায় চলমান জ্বালানি সঙ্কটও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯২০ সালের জানুয়ারি নাগাদ বলশেভিক লাল ফৌজের অনেক ইউনিটকে একদম স্বল্প পরিমাণেও তেল বা কয়লা সরবরাহ করা যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একমাত্র জ্বালানির উৎস ছিল কাঠ এবং তারা রেল ইঞ্জিনগুলোতে পরিবর্তন এনে সেগুলো কাঠ দিয়ে চালনার করার উপযুক্ত করছিল। কিন্তু এতে করে রেলের গতি বহুলাংশে হ্রাস পায়। শুধু যুদ্ধক্ষেত্র নয়, সোভিয়েত রাশিয়ার বড় বড় শহরগুলোতেও মারাত্মক জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু এসময় লাল ফৌজ তেলসমৃদ্ধ গ্রোজনি ও কয়লাসমৃদ্ধ দনবাস অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়, এবং এর ফলে তাদের জ্বালানি সঙ্কটের অবসান ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বলশেভিকরা বাকু ও আবশেরন উপদ্বীপের তেলখনিগুলো হস্তগত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত সোভিয়েত রুশ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনের জন্যও বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সম্পদের প্রয়োজন ছিল। এই পরিস্থিতিতে আজারবাইজানের তেলক্ষেত্রগুলো অধিকার করা মস্কোর জন্য একটি কৌশলগত আবশ্যকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ককেশাস রণাঙ্গনের বিপ্লবী সামরিক কমিটিকে লেনিন নির্দেশ দেন, “আমাদেরকে অবশ্যই বাকু দখল করতে হবে!” ১৯২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানে বলশেভিকদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার পর মস্কোর জ্বালানি নিরাপত্তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়। আজারবাইজানের তেলক্ষেত্রগুলোর ওপর বলশেভিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর আজারবাইজান থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার বরফাবৃত উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা স্থাপিত হয়, সোভিয়েত রাশিয়ার বড় শহরগুলোয় জ্বালানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং পোলিশ–সোভিয়েত যুদ্ধে লিপ্ত লাল ফৌজের প্রয়োজনীয় জ্বালানি চাহিদা পূর্ণ হয়।
চতুর্থত, আজারবাইজানিরা জাতিগতভাবে বৃহত্তর তুর্কি এবং ধর্মগতভাবে প্রধানত শিয়া মুসলিম। এমতাবস্থায় বলশেভিকদের পরিকল্পনা ছিল, আজারবাইজানকে একটি ‘মডেল মুসলিম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত করা হবে। বলশেভিক নেতা নারিমান নারিমানভ এবং সের্গেই কিরভের আত্মজীবনী অনুসারে, লেনিন চেয়েছিলেন, সোভিয়েত আজারবাইজান যেন সমগ্র প্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের জন্য আদর্শ উদাহরণ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আজারবাইজানের মুসাভাৎ সরকারকে উৎখাত করে একটি বলশেভিক সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার প্রয়োজন ছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বলশেভিকরা প্রথম থেকেই প্রাচ্যের এবং মুসলিম বিশ্বের জনসাধারণের মধ্যে বলশেভিক মতবাদের বিস্তার ঘটাতে আগ্রহী ছিল। এসময় প্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের সিংহভাগ রাষ্ট্রই ছিল উন্নত পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর ঔপনিবেশিক শাসনাধীন। এদেরকে বলশেভিক মতবাদে দীক্ষিত করে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলাই ছিল বলশেভিকদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। কিন্তু বলশেভিক মতবাদের দিকে প্রাচ্যের জনসাধারণের সামনে এমন কোনো প্রমাণ তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল, যেটি দেখে প্রাচ্যের জনসাধারণ পশ্চিমা ব্যবস্থার পরিবর্তে বলশেভিক ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আজারবাইজানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে সেটিকে একটি অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সামাজিকভাবে প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করার মধ্য দিয়ে বলশেভিকরা এই প্রমাণ পেশ করতে ইচ্ছুক ছিল।
সর্বোপরি, আজারবাইজানে সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রমণের পশ্চাতে আজারবাইজানি বলশেভিকদেরও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে তারা নিজেদেরকে আজারবাইজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু তাদের সমর্থকরা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। গ্রামাঞ্চলে তাদের বিশেষ প্রভাব ছিল না এবং এজন্য সম্পূর্ণভাবে নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করে ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ ঘটানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য তারা আজারবাইজানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার জন্য সোভিয়েত রাশিয়াকে উৎসাহিত করে।
বিশেষত আজারবাইজানি বলশেভিক নেতা নারিমান নারিমানভ এই আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি লেনিনের সঙ্গে সুদীর্ঘ আলোচনার পর একটি সমঝোতায় পৌঁছান, যেটিকে ‘লেনিন–নারিমানভ তেল চুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। নারিমানভ মনে করতেন, সোভিয়েত রাশিয়াকে ছাড়া আজারবাইজানের উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং আজারবাইজানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র সোভিয়েত রাশিয়াই আজারবাইজানের আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে প্রকৃত অবদান রাখতে সক্ষম।
আজারবাইজানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে নারিমানভের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। উল্লেখ্য, এসময় বাকুর তেলশিল্পের সঙ্গে বাকুর পশ্চাৎভূমিতে বসবাসকারী গ্রামীণ কৃষক শ্রেণির কোনো সংযোগ ছিল না। নারিমানভের পরিকল্পনা ছিল, এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এনে আজারবাইজানের তেলসম্পদ জনসাধারণের বৃহত্তর অংশের কাজে লাগাতে হবে। তদুপরি, তিনি চেয়েছিলেন, আজারবাইজানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী ইরানে এবং বৃহত্তর প্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বে বলশেভিক বিপ্লব ঘটাতে। অল্প কিছু পুঁজিপতির সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধির তুলনায় এই উদ্দেশ্যে আজারবাইজানের তেলসম্পদকে ব্যবহার করতে তিনি বেশি উৎসাহী ছিলেন। এজন্য তিনি আজারবাইজান আক্রমণের জন্য সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।
কার্যত নারিমানভ ছিলেন মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে লেনিনের একমাত্র সংযোগ। বলশেভিকদের প্রাচ্য ও মুসলিম নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে নারিমানভের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তার পরামর্শ এবং ‘লেনিন–নারিমানভ তেল চুক্তি’ আজারবাইজানের ওপর সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রমণের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে।
সামগ্রিকভাবে, আজারবাইজানের ওপর সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রমণের পশ্চাতে নানাবিধ আদর্শিক, ভূরাজনৈতিক, ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক কারণ ছিল, এবং আজারবাইজানি বলশেভিকরাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই আক্রমণের ফলে আজারবাইজান একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং পরবর্তী প্রায় সাত দশকব্যাপী রাষ্ট্রটিতে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা বজায় ছিল।