১
১৬০৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে সুবাদার ইসলাম খান চিশতী ভাটি বাংলার উদ্দেশ্যে রাজমহল ত্যাগ করেন। গঙ্গা নদী ধরে শাহপুর হয়ে ঘোড়াঘাটে গিয়ে তিনি থামলেন পরের বছরের জুনের ২ তারিখে। বাংলায় বর্ষা চলে আসায় বাকী সময়টা তিনি ঘোড়াঘাটে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ইতোমধ্যেই খাজা উসমান আলপসিংহ পরগনা (ময়মনসিংহ ও এর আশেরপাশের কিছু এলাকা) আক্রমণ করে দায়িত্বে থাকা মুঘল কর্মকর্তা সাজাউল খানকে হত্যা করে দখল করে নেন। ইসলাম খান চিশতী ছোট্ট একটি বাহিনী পাঠিয়ে আলপসিংহ পুনরুদ্ধার করলেও বর্ষা চলে আসায় এ স্থানে অবস্থান করা মুঘল বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পরার সম্ভাবনায় তিনি বাহিনী প্রত্যাহার করে নেন।
এদিকে বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ামাত্র তিনি ঘোড়াঘাট ত্যাগ করে শাহজাদপুর হয়ে ঢাকার দিকে রওয়ানা দিলেন। বিচক্ষণ ইসলাম খান পেছনে কোনো শত্রু রেখে যেতে চাচ্ছিলেন না। বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যার সীমান্ত সংলগ্ন বিষ্ণুপুর, পাচেট আর হিজলি ছিলো মুঘল বিরোধী জমিদারদের অধীনে। কাজেই ইসলাম খানকে এই তিন জমিদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি বাহিনী রেখে যেতে হলো। গৌড়ের কাছাকাছি থাকতেই তিনি শয়খ কামাল নামক একজন অফিসারের অধীনে ২ হাজার অশ্বারোহী আর ৪ হাজার পদাতিকের একটি বাহিনী রেখে যান। এই বাহিনী নিয়ে শয়খ কামাল জমিদারি তিনটিতে আক্রমণ চালালেন।
বিষ্ণুপুরের বীর হাম্বির আর হিজলির সলিম খান বিনাবাধায় আত্মসমর্পণ করলেন। পাচেটের শামস খান মুঘলদের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষ পর্যন্ত হার মানলেন।
মুঘল সেনাবাহিনী একাংশ গেল ভূষণাতেও। ভূষণার জমিদার শত্রুজিত পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। ইতোমধ্যেই যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও আশেপাশের কিছু জমিদার ইসলাম খানের কাছে আত্মসমর্পণ করে গিয়েছেন। অন্যদিকে ভূষণার জমিদার শত্রুজিত মুঘল জেনারেল ইফতেখার খানের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুললে পারলেও শেষপর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করেন।
২
এদিকে এর মাঝেই মাসুম খান কাবুলির পুত্র মির্জা মুমিন সহযোগী জমিদারদের সহায়তায় ২০০ নৌকা, ৪০০ অশ্বারোহী আর ২০০০ পদাতিক সৈন্য নিয়ে আক্রমণ চালালেন ইহতিমাম খানের জায়গীর সোনাবাজু পরগণায়। সোনাবাজু পরগণার অবরুদ্ধ মুঘল সৈন্যদের ২ জন বাদে বাকী সবাই নিহত হন। ইহতিমাম খানের নিকট এই সংবাদ পৌঁছালে তিনি ইলাহদাদ খান ও শাহবাজ খান বরিদ নামে দুজন অফিসারকে ৩০০ অশ্বারোহী আর ১,০০০ পদাতিক সৈন্যসহ প্রেরণ করেন। মির্জা নাথান তাদের সাথে যোগ দিতে রওয়ানা দেন আলাইপুর থেকে। সুবাদার ইসলাম শাহ মির্জা নাথানের সাহায্যার্থে আরও সৈন্য প্রেরণ করলে মাসুম খান কাবুলি তার বাহিনী নিয়ে সোজা চলে গেলেন সোনারগাঁয়ে।
সোনাবাজুর পর আক্রমণ চালানো হয় শাহজাদপুর আর চাঁদ প্রতাপ প্রগণায়। প্রত্যেকটিতেই স্থানীয় জমিদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, সোনাবাজু আর শাহজাদপুর বর্তমান পাবনা জেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশ নিয়ে ছিলো। আর বর্তমান মানিকগঞ্জ নিয়ে ছিলো তৎকালীন চাঁদ প্রতাপ পরগণা।
ইসলাম খান ভাটিতে যাওয়ার আগে তার পেছনে থাকা জায়গীরদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলেন। এসব জমিদাররা আনুগত্য স্বীকার না করলে প্রয়োজনে তাদের ভূমি দখল করে নিচ্ছিলেন, যাতে মূল ভাটিতে আক্রমণের সময় তারা ভূঁইয়াদের কোনো সহযোগীতা করতে না পারে। জমিদারদের দমন করার পর বাংলার উত্তর সীমান্তে থাকা স্বাধীন রাজ্যগুলোর দিকে তিনি এবার নজর দিলেন।
কামতার লক্ষীনারায়ণ (নরনারায়ণের পুত্র) আর কামরূপের পরীক্ষিত নারায়ণের (রঘুদেবের পুত্র) নিকট ইসলাম শাহ আত্মসপর্মনের বার্তা নিয়ে দূত পাঠালেন। লক্ষ্মীনারায়ণ মুঘল সালতানাতের আনুগত্য স্বীকার করলেন। কিন্তু পরীক্ষিত নারায়ণ আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন। জবাবে ইসলাম খান আবদুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে একটী বাহিনী প্রেরণ করেন কামরূপে। আবদুল ওয়াহিদের অযোগ্যতার কারণে এই বাহিনীটি পরাজিত হয়। রাজা পরীক্ষিত নারায়ণ ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে কামতার সীমান্তবর্তী কিছু অঞ্চল জয় করে নেন।
সুবাদার ইসলাম খান এই পরাজয়ের পর আর কামরূপের দিকে নজর দিতে পারেননি, তাকে ভাটি অঞ্চল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে এই অপমান তিনি একেবারে হজম করে ফেলেননি। সমগ্র ভাটি পদানত করার পর ১৬১২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি রাজা পরীক্ষিতের বিরুদ্ধে বাহিনী প্রেরণ করেন। রাজা পরীক্ষিতের সাথে মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষের পর রাজা আত্মসমর্পণ করেন, কামরূপ মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
৩
বাংলার উত্তর, পশ্চিম আর দক্ষিণাংশ নিরাপদ করে সুবাদার ইসলাম খান চিশতী ১৬০৯ সালের ১৫ অক্টোবর ঘোড়াঘাট ত্যাগ করে ভাটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ডিসেম্বরের শেষদিকে তিনি শিয়ালগড় হয়ে শাহজাদপুরে গিয়ে পৌঁছান। মুঘল নৌবহরটিও শাহজাদপুরে সুবাদারের সাথে যোগ দেয়। এরপর ইসলাম খান কাটাশগড় বা কাটাশপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। ইতোমধ্যেই ইসলাম খান শয়খ কামাল, তুকমক খান আর মীরক বাহাদুর জালাইরের নেতৃত্বে একটি বাহিনীকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র আর রসদসহ ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। ঢাকায় পৌঁছে এই বাহিনীর কাজ হবে মুঘল বাহিনীর অবস্থান করার জন্য একটি শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করা।
এদিকে ইসলাম খান চিশতী মুসা খানের শক্তিশালী দুর্গ যাত্রাপুরের উদ্দেশ্য যাত্রা করলেন। দুর্গটি ঢাকা থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার পশ্চিমে ইছামতী নদীর তীরে অবস্থিত। সুবাদার ছাউনি ফেললেন কাটাশপুরে। যাত্রাপুর দুর্গটি ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক ঘাটি। মুসা খান এই দুর্গটি হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। মির্জা মুমিন, দরিয়া খান আর মাধব রায়সহ অন্যান্য অভিজ্ঞ জেনারেলদের তিনি যাত্রাপুর দুর্গ রক্ষার দায়িত্ব দেন।
অন্যদিকে মুসা খান নিজে যাত্রাপুরের কাছাকাছি ডাকছড়া নামক জায়গাকে কেন্দ্র করে প্রতিরক্ষা জোরদার করলেন। মুঘল সেনাবাহিনীও কাটাশপুরকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করলো। এর ভেতরেই ইসলাম খান তার ভাই শয়খ হাবীবুল্লাহর নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠালেন ফতেহাবাদের জমিদার মজলিশ কুতুবকে দমন করার জন্য।
৪
মুঘল সেনাবাহিনীর উপর প্রথম আক্রমণ চালালেন মসনদ-ই-আলা মুসা খানই। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০০ নৌকা নিয়ে হুট করেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুঘল শিবিরের উপরে। সাথে রয়েছে মুহুর্মুহু কামানের গোলা নিক্ষেপ। সুবাদার ইসলাম খান তখন মাত্র সকালের নাস্তা করছিলেন। আক্রমণের প্রথমদিকে তার ঠিক নাস্তার সামনেই একটা গোলা এসে পড়লো। ভাগ্যের জোরে ইসলাম খান বেঁচে গেলেন বটে, তবে এই হামলায় সুবাদারের সাথে থাকা বেশ কিছু সৈন্য মারা গেলেন।
মুসা খানের আক্রমণের জবাব দিতে মূহুর্তের মাঝেই যুদ্ধবিন্যাসে ছড়িয়ে পড়লো মুঘল সৈন্যরা। মুঘল বাহিনীর অবস্থান কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় হওয়ায় মুঘলরাও কামানের সদ্ব্যবহার করতে পারলেন। মুসা খানের নৌবহরের উপর মুঘল কামানের গোলা এসে আঘাত করতে শুরু করলো। বেশ কিছু নৌকা হারালেন মুসা খান। তবে তাতে যুদ্ধের তীব্রতা কমলো না মোটেও। বরং আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা সময়ের সাথে সাথে বেড়েই চললো। যুদ্ধ তৃতীয় দিনে গড়ালেও কোনো পক্ষ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভে ব্যর্থ হলো।
এর ভেতরেই মুসা খানের কাছে ফতেহাবাদ থেকে বার্তা এলো। এই মুহূর্তেই যদি ফতেহাবাদ রক্ষা করতে সহায়তা পাঠানো না হয়, তাহলে ফতেহাবাদ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। মুসা খান বাধ্য হলেন দ্রুত ২০০ নৌকাসহ মির্জা মুমিনকে পাঠাতে।
এদিকে ডাকছড়া দুর্গ বিজয় নিয়ে মুঘলরা পড়লেন সঙ্কটে। দুর্গটির তিনদিকে ছিল জলাভূমি আর একদিকে নদী। কাজেই অশ্বারোহী বাহিনীর পক্ষে এই দুর্গে আক্রমণ করা অসম্ভব ছিলো। অন্যদিকে মুঘল নৌবহরেরও ডাকছড়ার কাছাকাছি যাওয়ার কোনো পথ খোলা ছিলো না। ইসলাম খান তখন ডাকছড়া বিজয়ের রাস্তা খোলার জন্য একটি শুকিয়ে যাওয়া একটি খালের মুখ খনন করে খালে পানি প্রবাহ আনার নির্দেশ দিলেন। রাতারাতি খাল খননের কাজ হাত দেওয়া হলো।
অবস্থা বেগতিক দেখে মুসা খান সন্ধি প্রস্তাব পাঠালেন ইসলাম খানের কাছে। ইসলাম খান তাতে সায় দিলেন। আলোচনা চললো টানা দুদিন। সুবাদার ইসলাম খান মুসা খানের সাথে খুবই ভালো আচরণ করলেন, মুসা খানকে যথাযোগ্য সম্মান দেখানো হলো। সম্মানিত করতে মসনদ-ই-আলা মুসা খানকে মুঘল খেলাত উপহার দেওয়া হলো। আরও দেওয়া হলো মণিমুক্তা খচিত একটি তরবারির খাপ, উন্নত জাতের দুটি ঘোড়া আর একটি বাজপাখি। তবে তৃতীয় দিন শেষে আলোচনা ভেস্তে দিলেন মুসা খান।
৫
আসলে মুসা খানের এই আলোচনা ছিলো নিছক সময়ক্ষেপণের উদ্দেশ্যে। তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন যে মুঘল আক্রমণের মুখে ডাকছড়া দুর্গ তিনি আর ধরে রাখতে পারবেন না। তিনি তার সর্বোচ্চটা দিয়ে ফেলেছেন। আলোচনার নাম করে যতটুকু সময় পাওয়া গেলো সেই সময়ের মাঝে দুর্গ থেকে তিনি প্রয়োজনীয় রসদ সরিয়ে ফেললেন।
এদিকে সুবাদার ইসলাম খান চিশতী অনুমান করলেন ডাকছড়া থেকে পালিয়ে মুসা খানা আবারও যাত্রাপুর দুর্গে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কাজেই তিনি মির্জা নাথান, ইফতিখার খান, মুতাকিদ খানসহ কয়েকজন জেনারেলের হাতে ডাকছড়া পদানত করার দায়িত্ব দিয়ে দ্রুত যাত্রাপুর দুর্গের দিকে যাত্রা করলেন। মুসা খান যাত্রাপুরে পৌঁছার ঠিক কিছুক্ষণ আগেই ইসলাম খান যাত্রাপুর দুর্গ দখল করে নিলেন।
এদিকে মির্জা নাথানও খাল খনন করে খালের ভেতর দিয়ে মুঘল নৌবহরকে ইছামতি নদীতে নিয়ে আসেন। ইসলাম খান যাত্রাপুর দুর্গের দিক থেকে ডাকছড়া দুর্গ আক্রমণের নির্দেশ দেন, অন্যদিকে মির্জা নাথান নদীপথে ডাকছড়ায় আঘাত হানেন। ডাকছড়া দুর্গের ভেতর থেকে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলো। দুর্গের ভেতর থেকে মুঘল অবস্থান লক্ষ করে কামান গাদানো হচ্ছিলো। অন্যদিকে দুর্গের চারপাশে বাঁশ পুঁতে পরিখা মজবুত করা হচ্ছিলো।
দুর্গের ভেতরের প্রতিরোধের জবাবও দেওয়া হয় বেশ কড়া করে। তীব্র আক্রমণ চালানো হয় মুঘলদের দিক থেকে। শেষপর্যন্ত ডাকছড়া মাথানত করতে বাধ্য হলো। মির্জা নাথানের অবিশ্বাস্য সাহস আর দুর্দান্ত কৌশলে দুর্গম ডাকছড়া দুর্গের পতন হলো।
৬
একে একে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দুর্গ হারিয়ে মুসা খান এবার শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি দ্রুত ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যার তীরের দুর্গগুলোতে শক্তিবৃদ্ধি করলেন।
এদিকে যাত্রাপুর আর ডাকছড়া দুর্গ জয়ের পর সুবাদার ইসলাম খান চিশতী ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৬১০ সালের মাঝামাঝির দিকে তিনি ঢাকা পৌঁছালেন। সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে তার পছন্দ হলো। মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সম্মানে নতুন রাজধানী ঢাকার নামকরণ করা হলো জাহাঙ্গীরনগর। মাঝে কিছু সময়ের জন্য বাংলার রাজধানী নানান জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হলেও, প্রতিষ্ঠার ৪১০ বছর পর আজও ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রয়েছে।
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]