অপরাধীকে ধরতে পারার সাফল্যের কাহিনীতে আমাদের পত্রিকার পাতা, টিভি চ্যানেল কিংবা নিউজ সাইটগুলো প্রায় নিয়মিতই ভরপুর থাকে, সেই সাথে থাকে অপরাধীকে খুঁজে না পাবার ব্যর্থতার কথাও। তবে অপরাধীদের জেল থেকে পালানোর কথা সচরাচর শোনা যায় না। কারণ জেলের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে আসলেই আলাদা রকমের সাহস আর বুদ্ধির দরকার হয়। তাই মাঝে মাঝে যখন এমন খবর শোনা যায়, তখন পালিয়ে যাওয়া আসামীর কৌশলের মাত্রা দেখে আশ্চর্য হয় কমবেশি সবাই। ইতিহাসে বিখ্যাত এমনই পাঁচটি জেল পালানোর গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে তাই আজকের এ লেখাটি।
গ্লাইডারে চড়ে পালানো
জার্মানির স্যাক্সনি অঙ্গরাজ্যের জিকাও মুল্ড নদীর তীরে অবস্থিত এক শহরের নাম কোল্ডিৎজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ শহরেরই কোল্ডিৎজ দুর্গে স্থাপন করা যুদ্ধবন্দী অফিসারদের ক্যাম্পটি ইতিহাসে বেশ বিখ্যাত। বেশ উঁচু এক পাহাড়ের কিনারা ঘেষে ছিলো ক্যাম্পটির অবস্থান। আর এখান থেকেই গ্লাইডারে চড়ে পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন দুই ব্রিটিশ পাইলট জ্যাক বেস্ট ও বিল গোল্ডফিঞ্চ।
গ্লাইডারের বিভিন্ন অংশগুলো তারা জোড়া লাগিয়েছিলেন ক্যাম্পেরই চ্যাপেলের চিলেকুঠুরিতে। তারা পরিকল্পনা করেছিলেন যে, ছাদে উঠে সেখান থেকেই গ্লাইডারে চড়ে প্রায় ২০০ ফুট নিচে থাকা মুল্ড নদী পাড়ি দিবেন। নিজেদের ওয়ার্কশপ লুকিয়ে রাখতে তারা এর চারদিকে প্রথমে দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেন যাতে জার্মান সৈন্যরা তাদের কাজকর্মের কিছু টের না পায়। নিজেদের খাটের কাঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা থেকে চুরি করে আনা কাঠ দিয়েই চলছিলো গ্লাইডার বানানোর কাজ। গ্লাইডারের ডানা বানানো হয়েছিলো মেঝে তৈরিতে ব্যবহৃত বোর্ডগুলোর সাহায্যে। আর এটি চালাতে প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক তার জোগাড় করা হয়েছিলো দুর্গেরই অব্যবহৃত অংশ থেকে তার চুরি করে। লর্নে ওয়েল্চ নামক এক গ্লাইডার বিশেষজ্ঞকে দিয়ে নিজেদের গ্লাইডারের ডিজাইন ও বিভিন্ন গাণিতিক হিসেবনিকেশ পরীক্ষাও করিয়ে নিয়েছিলেন তারা। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাদের নির্মানাধীন সেই গ্লাইডারের নাম ছিলো ‘কোল্ডিৎজ কক’।
তবে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা-ই হোক না কেন, বেস্ট এবং গোল্ডফিঞ্চ তাদের গ্লাইডারে চড়ে কোল্ডিৎজ দুর্গ থেকে পালাতে পারেননি। কারণ তাদের কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে, তখনই মিত্রবাহিনী দুর্গের দখল নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ফলে প্রায় ২০০ ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে উড়ে জেল থেকে পালানোর যে অবিশ্বাস্য পরিকল্পনা তারা করেছিলেন, তা কেবল স্বপ্নই থেকে গিয়েছিলো।
দ্য গ্রেট এস্কেপ
এখন জেল থেকে পালানোর যে ইতিহাসটি শোনাতে যাচ্ছি, সেটিও ইতিহাসে অনেক বিখ্যাত একটি ঘটনা, যা ‘দ্য গ্রেট এস্কেপ’ নামে সুপরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘স্টালাগ লাফ্ট ৩’ ছিলো জার্মানদের বানানো আরেকটি যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্প যেখানে বিমান বাহিনীর লোকদেরকে বন্দী হিসেবে রাখা হতো। এখানকার বন্দীদের মাঝেই একজন ছিলেন অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার রজার জয়েস বুশেল। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে বুশেল এখান থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালানোর পরিকল্পনা করলেন, তবে একটি নয়, তিনটি; একা নয়, সবাইকে নিয়ে। এগুলোর সাংকেতিক নাম ছিলো টম, ডিক ও হ্যারি।
সুড়ঙ্গগুলোর জায়গা এমনভাবে নির্বাচন করা হলো যেন সেগুলো প্রহরীদের চোখে সহজে ধরা না পড়ে। পেরিমিটার মাইক্রোফোনেও যাতে তাদের অস্তিত্ব ধরা না পড়ে, সেজন্য ভু-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ ফুট নিচে খোঁড়া হয়েছিলো প্রতিটি সুড়ঙ্গ। এগুলো আকারেও ছিলো বেশ ছোট, কোনো রকমে শরীর ঢুকিয়ে এগিয়ে নেবার মতো। তবে ভেতরে খননকাজের সুবিধার্থে এয়ার পাম্প ও ওয়ার্কশপ বানানো হয়েছিলো। ভেতরের বালি যাতে ধ্বসে না পড়ে, সেজন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো কাঠ। নিজেদের খাটের কাঠের পাশাপাশি সারা ক্যাম্প থেকে বিভিন্নভাবে কাঠ জোগাড় করেই করা হয়েছিলো এমনটি। কাজের সুবিধার্থে সুড়ঙ্গের ভেতরে যুদ্ধবন্দীরা বৈদ্যুতিক বাতি লাগিয়েছিলো, মাটি আনা-নেয়ার সুবিধার্থে ব্যবহার করেছিলো ছোট গাড়ি। বিভিন্ন খনিতে যেভাবে রেললাইনের উপর দিয়ে চলা ছোট গাড়িতে করে মালামাল আনা-নেয়া করা হয়, এগুলোও ছিলো তেমন। প্রায় পাঁচ মাস ধরে এ গাড়ি দিয়েই প্রায় ১৩০ টন মাটি সরানোর কাজ করা হয়েছিলো!
১৯৪৪ সালের মার্চে ‘হ্যারি’র খনন সম্পন্ন হয়। কিন্তু একটা ঝামেলা বেঁধে যায় তখন। এতদিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করা যুদ্ধবন্দীদের কয়েকজনকে এ ক্যাম্প থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বন্দীরা অপেক্ষা করতে থাকলেন অমাবস্যার অন্ধকারাচ্ছন্ন এক রাতের জন্য। মার্চের ২৪ তারিখে এসে যায় কাঙ্ক্ষিত সেই সময়। সুড়ঙ্গপথে এক এক করে পালাতে থাকেন যুদ্ধবন্দীরা। এভাবে চলে যান ৭৬ জন। এরপরই বাঁধে মস্ত বড় এক ঝামেলা। সময় তখন ২৫ তারিখের ভোর ৫টা। ৭৭তম বন্দী সুড়ঙ্গ থেকে বের হওয়া মাত্রই ধরা পড়ে যান এক প্রহরীর নজরে। এরপরই শুরু হয় পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের খোঁজে সাঁড়াশি অভিযান। ৭৬ জনের মাঝে ধরা পড়েছিলেন ৭৩ জনই। এদের মাঝে ৫০ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিলো। বাকিদের ভাগ্যে নেমে এসেছিলো পুনরায় বন্দীত্ব ও নির্যাতনের কালরাত্রি।
এরপর জার্মানরা হিসেব করে দেখে যে, এ সুড়ঙ্গ খননের জন্য ৪,০০০ খাটের পাটাতন, ৯০টি ডাবল বাঙ্ক খাট, ৬৩৫টি ম্যাট্রেস, ১৯২টি বেড কভার, ১৬১টি বালিশের কভার, ৫১টি ২০ জন একসাথে খেতে পারার মতো টেবিল, ১০টি সিঙ্গেল টেবিল, ৩৪টি চেয়ার, ৭৬টি বেঞ্চ, ১,২১২টি কোলবালিশ, ১,৩৭০টি কাঠের তক্তা, ১,২১৯টি ছুরি, ৪৫৮টি চামচ, ৫৮২টি কাটা চামচ, ৬৯টি ল্যাম্প, ২৪৬টি পানির বোতল, ৩০টি কোদাল, ১,০০০ ফুট বৈদ্যুতিক তার, ৬০০ ফুট দড়ি এবং ৩,৪২৪টি তোয়ালে ব্যবহার করা হয়েছিলো!
জন ডিলিঞ্জারের কাঠের পিস্তল
জন ডিলিঞ্জার আমেরিকার ইতিহাসের কুখ্যাত এক সন্ত্রাসী। তিনি ছিলেন ডিলিঞ্জার গ্যাঙের সদস্য যেটি ২৪টি ব্যাংক ডাকাতি, ৪টি পুলিশ স্টেশনে হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য পরিচিত। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে অ্যারিজোনার টুস্কনে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং তার স্থান হয় ইন্ডিয়ানার লেক কাউন্টি জেলে।
অল্প কিছুদিন পরেই মার্চের ৩ তারিখে তিনি এমন এক কান্ড করে বসেন যা অবাক করে দেয় গোটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই। সামান্য কাঠ কেটে তিনি বানিয়েছিলেন এক খেলনা পিস্তল। তারপর সেটিকে আরো আসলের মতো দেখাতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন জুতার কালি। তারপর সেই খেলনা পিস্তল দিয়ে প্রহরীদের ভয় দেখিয়েই পালিয়ে যান তিনি। আর পালানোর ব্যাপারটা যাতে তাড়াতাড়ি হয়, সেজন্য সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন শেরিফের নতুন কেনা V-8 ফোর্ড গাড়িটি!
অবশ্য পালিয়ে খুব বেশিদিন বাঁচতে পারেননি তিনি। একই বছরের ২২ জুলাই পুলিশের ৪টি গুলিতেই ৩১ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
আলকাত্রাজ থেকে পালানো
যুক্তরাষ্ট্রের আলকাত্রাজ দ্বীপে অবস্থিত আলকাত্রাজ জেলখানাটি ছিলো অত্যন্ত সুরক্ষিত, সার্বক্ষণিক নজরদারিতে ঘেরা এক জেলখানা। এখান থেকে কেউ যে পালাতে পারে সেই কথা চিন্তাও করা যেতো না। আর সেই অচিন্ত্যনীয় জিনিসটিই বাস্তবে দেখিয়ে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো তিন অপরাধী- ফ্রাঙ্ক মরিস, জন অ্যাংলিন ও ক্ল্যারেন্স অ্যাংলিন।
১৯৬২ সালের ১১ জুনের কথা। উপরে উল্লিখিত তিন অপরাধীই ছিলেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। কিন্তু তারা খুঁজছিলেন মুক্তির পথ, তাই কাজে লাগালেন তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে। এজন্য তারা সাবান আর টয়লেট টিস্যু দিয়ে প্রথমে তৈরী করলেন মানুষের মাথা। এরপর মাথায় আসল চুল লাগিয়ে সেই কৃত্রিম মাথাগুলোকে কাঁথা দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিলেন যাতে রাতের বেলায় প্রহরীরা যখন চেক করার জন্য আসবে, তখন যেন বুঝতে না পারে।
এ ঘটনার প্রায় এক বছর আগে থেকে তারা তাদের সেলের দেয়ালে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে গর্ত খুঁড়ছিলেন। সেই গর্তটি গিয়ে শেষ হয়েছিলো এক অব্যবহৃত সার্ভিস করিডোরে। সেই সার্ভিস করিডোর থেকে তারা ভেন্টিলেশন শ্যাফট বেয়ে উঠে যান একবারে ছাদে। এরপর ছাদ থেকে নেমে আবার আরেকটি বেড়া ডিঙোতে হয় তাদের। সেখান থেকে তারা সোজা চলে যান সমুদ্রের পাড়ে। এরপর জেলের গুদাম থেকে চুরি করে আনা রেইনকোট ও সিমেন্ট দিয়ে তারা তৈরি করেন র্যাফ্ট। এরপর রাত দশটার দিকে তারা আলকাত্রাজ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এফবিআই আর কখনোই সেই তিনজনের কোনো সন্ধান পায় নি। ১৭ বছরের অনুসন্ধান শেষে তারা বলে যে, এ তিনজন অবশ্যই সাগরের পানিতে ডুবে মরেছে! এফবিআই-এর সাইটে এ ঘটনাটিকে ‘কুখ্যাত’ হিসেবে উল্লেখ করা আছে।
আলফ্রেড ওয়েটজ্লার
হলোকাস্টের সময় অল্প যে ক’জন ইহুদী অসউইৎজ ডেথ ক্যাম্পের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের জীবন বাঁচাতে পেরেছিলো, আলফ্রেড ওয়েটজ্লার তাদের মাঝে একজন। তিনি এবং তার সাথে পালানো রুডলফ ভ্রবা অবশ্য বিখ্যাত হয়ে আছে এ ক্যাম্পের সর্বপ্রথম বিস্তারিত বর্ণনা দেয়ার জন্য। ৩২ পৃষ্ঠার এ ভ্রবা-ওয়েটজ্লার রিপোর্টে ছিলো অসউইৎজ ক্যাম্পের গ্রাউন্ড প্ল্যান, গ্যাস চেম্বারের কন্সট্রাকশন প্ল্যান, মানবদেহ পোড়ানোর চুল্লির বর্ণনা এবং গ্যাস চেম্বারে ব্যবহৃত জিক্লন বি গ্যাসের একটি ক্যানিস্টারের মোড়ক। এ রিপোর্টের তথ্যের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে মিত্রবাহিনী নাৎসি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়, রক্ষা পায় ১,২০,০০০ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদী।
১৯৪৪ সালের ৭ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর দুটোর দিকে ওয়েটজ্লার এবং ভ্রবা পালিয়ে এক কাঠের স্তুপের আড়ালে আশ্রয় নেন। এ এলাকাটি বির্কেনয়ের কাঁটাতার দেয়া এলাকার বাইরে হলেও তা আরেকটি বড় এলাকার অংশ ছিলো যা সার্বক্ষণিক প্রহরার মাঝে রাখা হতো। ফলে পুরোপুরি মুক্তি তাদের তখনো মিলে নি। ক্যাম্পের অন্যান্য বন্দীরা তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গাটির চারদিকে কাঠের বোর্ড জমা করে রেখেছিলেন যাতে তারা ধরা না পড়েন। কুকুরেরা যাতে গন্ধ শুঁকেও তাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে না পেতে পারে, সেজন্য সেই জায়গাটিতে তারা তামাক পাতা গ্যাসোলিনে ভিজিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতেই সেখানে ৪টি রাত কাটিয়ে দেন পলাতক দুই বন্দী।
১০ এপ্রিল ডাচ স্যুট, ওভারকোট ও বুট গায়ে জড়িয়ে দুজন ১৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পোল্যান্ডের সীমান্তের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেন। তাদের কাছে দিক নির্দেশক বলতে কেবল ছিলো বাচ্চাদের মানচিত্রের বইয়ের একটি পৃষ্ঠা।