কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর জীবনের উপর আসা একের পর এক গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, “হত্যা চেষ্টার পরও বেঁচে যাওয়া যদি কোনো অলিম্পিক ইভেন্ট হতো, তবে তাতে আমি স্বর্ণপদক জিততাম”। দেশটির কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সাবেক প্রধান ফাবিয়ান এস্কালান্তের মতে, জীবদ্দশায় সিআইএ কাস্ত্রোকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে! বিশ্বজুড়ে অজস্র মানুষকে কাঁদিয়ে ৯০ বছর বয়সে আজ পরলোকে গমনকারী মহান এ নেতার উপর জীবদ্দশায় যেসব রোমহর্ষক হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিলো, সেসব ঘটনা নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এ বিশেষ আয়োজন।
ভালোবাসার মানুষ যখন গুপ্ত ঘাতক
ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনে উল্লেখযোগ্য একটি নাম মারিতা লরেঞ্জ। জার্মান বংশোদ্ভুত এ আমেরিকান নাগরিকের সাথে ১৯৫৯ সালে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর তাদের সম্পর্ক এককালে এমন একদিকে মোড় নেয় যা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
কাস্ত্রোর সাথে সম্পর্কের এক পর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে যান লরেঞ্জ। গর্ভাবস্থায় একবার হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি চলে যান আমেরিকায়। সেখানেই যেন তার জন্য ওঁত পেতে ছিলো সিআইএর সদস্যরা। তারা তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, কাস্ত্রো আসলে তার গর্ভপাতের ব্যবস্থা করেছেন! সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা কেমন হতে পারে তা তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু সিআইএর সদস্যদের কথার সত্যতা যাচাই না করেই তাদের বিশ্বাস করে বসলেন লরেঞ্জ। তারা তাকে বললেন যে, আমেরিকার স্বার্থে হলেও লরেঞ্জকে কিউবায় ফিরে যেতে হবে। তারপর তার মিশন হবে একটাই- ফিদেল কাস্ত্রোকে চিরতরে সরিয়ে দেয়া। এজন্য সিআইএর পক্ষ থেকে তাকে কিছু বিষাক্ত ওষুধ দেয়া হয়। লরেঞ্জের কাজ ছিলো সেগুলো কাস্ত্রোর জুসে মিশিয়ে দিয়ে সবার অগোচরে আবার পালিয়ে আসা।
কাস্টমস অফিসে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে লরেঞ্জ ওষুধগুলো তার কোল্ড ক্রিমের বক্সে করে আনার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সৌভাগ্য বলতে হবে কাস্ত্রোর। কারণ কোনোভাবে এ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি টের পেয়ে যান তিনি। এরপর তিনি নিজের পিস্তলটি লরেঞ্জের হাতে তুলে দিয়ে সিগারেটে একটি টান দেন, বলেন তাঁকে শেষ করে দিতে। কিন্তু সেটি আর করতে পারেন নি তিনি, বরং আবেগের আতিশায্যে জড়িয়ে ধরেছিলেন কাস্ত্রোকে।
বিষ মাখানো ডাইভ স্যুট
১৯৬১ সালে বে অফ পিগ্স হামলার পর সিআইএ’র প্রশিক্ষিত ১,০০০ এরও বেশি কিউবার নির্বাসিত নাগরিক কাস্ত্রোর বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এরপরই আমেরিকার সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মুক্তির ব্যাপারে সরাসরি ফিদেল কাস্ত্রোর সাথেই কথা বলতে পাঠানো হয় অ্যাটর্নি জেমস বি. ডনোভানকে।
মাসাধিক কাল ধরে চলে তাদের আলাপচারিতা। এ সময়ে এই দুই ব্যক্তির মাঝে বেশ ভালোই হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। ডনোভানকে বিশ্বাস করে তার সাথে নিজের প্রিয় কাজ মাছ ধরতেও গিয়েছিলেন কাস্ত্রো। এখান থেকেই তাঁকে খুন করার আরেকটি পরিকল্পনা করে সিআইএ- ‘বিষ মাখানো ডাইভ স্যুট’।
তারা ডনোভানকে প্রস্তাব দেয় ফিদেল কাস্ত্রোকে একটি ডাইভ স্যুট উপহার দেয়ার যেটাতে বিষাক্ত মাদুরা ফুট ফাঙ্গাস (Madura Foot Fungus) ও যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া মেশানো থাকবে। এটা গায়ে দিলেই রোগে আক্রান্ত হয়ে যাবেন কাস্ত্রো, হাসিল হবে সিআইএর উদ্দেশ্য।
কিন্তু এবারও হতাশ হতে হয় তাদের। কারণ কিছুদিন আগেই ডনোভান কাস্ত্রোকে একটি ডাইভ স্যুট উপহার দিয়েছিলেন। তাই নতুন করে আবার দিলে সেটি যে সন্দেহের উদ্রেক করবে, সেটা তো না বললেও চলে।
কলমের খোঁচায় জীবন নাশ
শরীরে বিভিন্ন টিকা দিতে কিংবা বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দেহাভ্যন্তরের কোনো তরলের নমুনা নেয়ার দরকার হলে ভেতরে ফাঁপা যে সুঁইটি ব্যবহার করা হয়, তাকে বলে হাইপোডার্মিক সুঁই। আর এ হাইপোডার্মিক সুঁই দিয়েও ফিদেল কাস্ত্রোকে মারার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। তবে সরাসরি সুঁই নিয়ে এগিয়ে গেলে ধরা পড়ে যাবার ভয় থাকে দেখে চিন্তা করা হয়েছিলো কোনো বলপয়েন্ট কলমের আগায় সেই সুঁই লাগিয়ে নেয়ার। আর এর ভেতরে ব্যবহার করা হবে কোনো বিষাক্ত পদার্থ। ফলে কেউ শুধু ধাক্কা দেবার ছলে একবার কাস্ত্রোর গায়ে কলমটি দিয়ে খোঁচা দিলেই হয়ে যেত! কিন্তু না, এমন ধুরন্ধর পরিকল্পনাটিও সফলতার মুখ দেখে নি।
বিষ্ফোরক চুরুট
এ খবরটি এসেছিলো ১৯৬৭ সালের ৪ নভেম্বর স্যাটার্ডে ইভ্নিং পোস্টে। সেখান থেকে জানা যায় যে, ১৯৬০ সালে কাস্ত্রো যখন জাতিসংঘের সদর দপ্তর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, তখন তাকে হত্যার আরেকটি প্রচেষ্টা চালায় সিআইএ। এর অংশ হিসেবে সিআইএ’র এক এজেন্ট নিউ ইয়র্ক শহরের পুলিশ ইন্সপেক্টর মাইকেল জে. মার্ফির শরণাপন্ন হন। তিনি তাকে প্রলুব্ধ করেন কাস্ত্রোকে এমন একটি চুরুট দেয়ার জন্য যার ভেতরে ভরা থাকবে বারুদ। ফলে আগুন ধরানো মাত্রই বিষ্ফোরণে মৃত্যু ঘটবে কাস্ত্রোর। কিন্তু বরাবরের মতো সেবারও ব্যর্থ হতে হয় তাদের।
বিষাক্ত চুরুট
এবারের পরিকল্পনাও ছিলো চুরুটকে ঘিরেই, তবে বিষ্ফোরক ভরে নয়, বিষ মিশিয়ে! এবার সিআইএ ভেবেছিলো একজন ডাবল এজেন্ট কাজে লাগানোর যে কিনা কাস্ত্রোর চুরুটের বাক্সে বটুলিন বিষ মেশানো একটি চুরুট রেখে আসবে। ফলে চুরুটে টান দেয়ার অল্প সময়ের মাঝে বিষক্রিয়ায় মারা যাবেন এ নেতা। এমনকি এ উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই ডাবল এজেন্টকে বটুলিন মেশানো চুরুট দেয়াও হয়েছিলো। তবে সেই এজেন্ট এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে শেষ মুহূর্তে আর সাহস পান নি। তাই পিছিয়ে আসেন তিনি, বেঁচে যান ফিদেল কাস্ত্রো।
বিষ্ফোরক শঙ্খ
কাস্ত্রোর শখ ছিলো স্কুবা ডাইভ করা। আর এ তথ্যটি জানা ছিলো সিআইএর। তাই তারা এ শখকেই তাঁর মৃত্যুর কারণ বানাতে চাইলো। তাদের পরিকল্পনা ছিলো কাস্ত্রোর পছন্দের স্কুবা ডাইভিংয়ের জায়গায় একটি নকল শঙ্খ রেখে আসার যা হবে আসলে বোম। এটিকে উজ্জ্বল রঙ দেয়া হবে, গঠনে আনা হবে বৈচিত্র। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর দিকে এগিয়ে যাবেন কাস্ত্রো। আর তাঁকে মারার মতো কাছাকাছি পৌঁছালেই ফেটে যাবে শঙ্খটি, মারা যাবেন ফিদেল কাস্ত্রো!
শ্মশ্রুহীন করে দেয়া
এ পরিকল্পনাটি ছিলো বেশ অদ্ভুত। ১৯৭৫ সালের সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির রিপোর্ট থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়। সিআইএ ভেবেছিলো যে, যদি কোনোভাবে কাস্ত্রোকে শ্মশ্রুহীন করে দেয়া যায়, তাহলে কিউবার জনগণ তাকে দুর্বল ভাবতে শুরু করবে। ফলে জনগণের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও যাবে কমে। এজন্য তারা থ্যালিয়ামের লবণ ব্যবহারের কথাও ভেবেছিলো যা তাদের এ উদ্দেশ্যকে সফলতার মুখ দেখাবে। এটি খাবারে বা শ্বাসের সাথে কোনোভাবে কাস্ত্রোর শরীরে প্রবেশের ফন্দি এঁটেছিলো তারা।
এলএসডি
খুন করা বাদে ফিদেল কাস্ত্রোকে ঘিরে সবচেয়ে ভয়াবহ কোনো পরিকল্পনার কথা যদি আসে, তবে অবশ্যই আসবে এলএসডি নামক মাদকদ্রব্যটির কথা।
একবার কাস্ত্রো এক রেডিও স্টেশন থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তো সিআইএ ভেবেছিলো যে, যদি সেই অনুষ্ঠানস্থলে কোনোভাবে এলএসডি স্প্রে করে দেয়া যায়, তাহলে অবধারিতভাবেই কাস্ত্রো উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকবেন। সরাসরি সম্প্রচারিত সেই অনুষ্ঠানে তাঁর অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে দেশবাসী তাঁকে পাগল ভেবে তাঁর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে।
বিষ মাখানো রুমাল
চুরুট কিংবা জুসে বিষে মেশাতে ব্যর্থ হয়ে সিআইএ এরপর টার্গেট করেছিলো কাস্ত্রোর রুমালকে। তারা ভেবেছিলো যে, যদি কোনোভাবে তাঁর রুমালে বিষ মাখিয়ে রাখা যায়, তাহলেই তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে। তারা এমন বিষ মেশাতে চেয়েছিলো যা তাঁকে মারাত্মক অসুস্থ করে দিবে। ফলে অবধারিতভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে হতো কাস্ত্রোকে।
মিল্কশেকে বিষ
কাস্ত্রোকে শেষ করে দিতে সিআইএ যতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিলো, তার মাঝে সফলতার সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছিলো মিল্কশেকে বিষ মেশানোর বেলাতেই।
হাভানার হিল্টন হোটেলে (বর্তমান নাম- Hotel Habana Libre) খেতে গিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। এখানে খাবার শেষে দেয়া চকোলেট মিল্কশেকটি খুব পছন্দ করতেন কাস্ত্রো। আর এ সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছিলো সিআইএ। তারা এক গুপ্তঘাতক নিযুক্ত করেছিলো ওয়েটারের বেশে সাজিয়ে। সেই ওয়েটারকে তারা কিছু সায়ানাইডের পিল দিয়েছিলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো কাস্ত্রোর প্রিয় সেই মিল্কশেকে সায়ানাইডের পিলগুলো মিশিয়ে তাকে খতম করে দেয়া। প্রায় এক বছর ধরে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো এজন্য। অবশেষে যখন কাস্ত্রো এসে সেই মিল্কশেকের অর্ডার দিলেন, তখন সেই ওয়েটার সেটিতে সায়ানাইডের পিল মেশাতে গিয়ে থমকে যায়। কারণ ঠান্ডার কারণে পিলটি ফ্রিজের গায়ে শক্ত হয়ে আটকে গিয়েছিলো। তাড়াহুড়া করে তুলতে গিয়ে বেচারা সেই পিলটিই ভেঙে ফেলে। ফলে এ যাত্রাতেও অল্পের জন্য রেহাই পান কাস্ত্রো।