মিশর নামক দেশটির নাম শুনলে আমাদের মানসপটে প্রথমেই যে দুটি চিত্র ভেসে ওঠে তা হলো ‘পিরামিড’ ও ‘মমি’। তবে এর সাথে আরেকজন ব্যক্তির পদবীও আমাদের মনে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায়, তিনি হলেন ফারাও। প্রাচীন মিশরের জনগণের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক এ সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন দেশটির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
মিশরের উচ্চ ও নিম্নভূমির শাসক ছিলেন ফারাও। মিশরের সকল ভূমির মালিক ছিলেন তিনি। এছাড়া আইন প্রণয়ন, কর সংগ্রহ ও বহিঃশত্রুর হাত থেকে মিশরের জনগণকে রক্ষার দায়িত্বও তিনিই পালন করতেন। আবার দেবতার সাথে আমজনতার যোগসূত্র স্থাপনের কাজটিও তিনিই করতেন।
আজ তেমনই কয়েকজন ফারাওকে নিয়ে লিখছি। তাদের বিশেষত্ব ছিলো জীবদ্দশায় করা তাদের অদ্ভুত কিছু কাজ-কারবার। কিছু কাজের কথা শুনে যেমন বিস্মিত না হয়ে থাকা সম্ভব না, তেমনি কিছু কাজ মারাত্মক হাসির খোরাক হওয়াও অসম্ভব না!
মেন্কৌরের মৃত্যুভীতি
আনুমানিক ২,৫৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরের রাজার আসনে বসেছিলেন মেনকৌর। মাইকেরিনোস ও মেন্খেরেস নামেও পরিচিত তিনি। ১৮-২২ বছর ধরে রাজত্ব করা মেন্কৌর বিখ্যাত হয়ে আছেন গিজার ‘মেনকৌরের পিরামিড’-এর জন্য।
মৃত্যুকে সবসময়ই বেশ ভয় পেতেন এ রাজা, চাইতেন যেকোনোভাবে এর নাম না শুনতে, এর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। একবার এক পুরোহিত এসে তাকে জানিয়েছিলো যে, তিনি সর্বসাকুল্যে আর ছয় বছরের মতো বাঁচবেন।
এ কথা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মেন্কৌরের। মৃত্যুকে যেকোনোভাবে এড়াতে নানা রকম ফন্দি-ফিকির করতে লাগলেন তিনি। রাজা ভেবে দেখলেন, যদি রাত শেষ না হয়, তাহলে নতুন দিন কখনো শুরু হবে না। যদি নতুন দিন শুরু না হয়, তাহলে সময়ও আর চলতে পারবে না। আর সময় যদি চলতে না পারে, তাহলে তার মৃত্যুও হবে না!
এরপর থেকেই শুরু হয় মেন্কৌরের অদ্ভুত কাজ-কারবার। জীবনের বাকি দিনগুলো রাতের বেলায় তিনি যত পারতেন আলো জ্বালিয়ে রাখতেন যাতে রাতকেও দিনের মতোই মনে হয়। রাতে সচরাচর ঘুমাতেন না তিনি। পান করে আর হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়েই কাটিয়ে দিতেন প্রতিটি রাত। মাথার মাঝে সারাক্ষণ একটা ভয়ই কাজ করতো তার- ‘এই বুঝি আলো নিভে গেলো!’
আখেনাতেনের আমার্না
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের দিকে প্রায় সতের বছর মিশরের অধিপতি ছিলেন আখেনাতেন। তিনি সিংহাসনে বসার পূর্বে মিশরীয়রা অনেক দেবতার পূজা করতো। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় এসে ওগুলো সব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একমাত্র সৌর দেবতা আতেনের উপাসনা চালু রাখেন। মূলত এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণেই ইতিহাস তাকে স্মরণে রেখেছে।
আতেনের সম্মানে আখেনাতেন নতুন এক শহর নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন, নাম তার আমার্না। প্রায় ২০,০০০ লোককে এ শহর নির্মাণের কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিলো। দিন-রাত অমানুষের মতোই পরিশ্রম করা লাগতো সেই দুর্ভাগাদের। শহরের কবরস্থানে পাওয়া কঙ্কালগুলো নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, শ্রমিকদের দুই-তৃতীয়াংশেরই কাজ করার সময় কোনো না কোনো হাড় ভেঙেছিল।
শহরের অধিবাসীদের অধিকাংশই অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাতো। তাদের অধিকাংশই ছিলো অপুষ্টির শিকার। তবে এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। তারা ব্যস্ত ছিলো আমার্নার সৌন্দর্য বর্ধন নিয়েই। যদি কেউ পেটের দায়ে লাইন ভেঙে কিছু বাড়তি খাবার চুরির চেষ্টা চালাতো, তাহলে ক্রমাগত ছুরিকাঘাত করতে করতেই শেষ করে দেয়া হতো তাকে।
এতকিছু করেও অবশ্য লাভ হয় নি শেষ পর্যন্ত। আখেনাতেনকে মন থেকে মেনে নিতে পারে নি মিশরের অধিবাসীরা। মৃত্যুর পর তাই আখেনাতেনের মূর্তির অনেকগুলোই ভেঙে ফেলা হয়েছিলো, কিছু কিছু লুকিয়েও রাখা হয়েছিলো। রাজাদের তালিকাতেও ঠাই দেয়া পায় নি তার নাম। মিশর আবার তার আগের বহু ঈশ্বরের আরাধনাতেই ফিরে গিয়েছিলো।
সেসোস্ত্রিসের অদ্ভুত স্মৃতিফলক
মিশরের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সামরিক কমান্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেসোস্ত্রিসকে। তৎকালীন জ্ঞাত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই তিনি তার বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। তার রাজ্য তৎকালে এতটাই বিস্তৃত হয়েছিলো যা কেউ কল্পনাও করতে পারতো না।
প্রতিটি যুদ্ধে জয়ের পরই সেসোস্ত্রিস সেই জায়গায় একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে আসতেন। সেখানে প্রথমেই শুরু হতো তাঁর পরিচয় দিয়ে। তিনি কে, কীভাবে তিনি তার শত্রুদের পরাজিত করেছেন এবং কীভাবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে দেবতারা এ আক্রমণে তার পক্ষেই থাকবেন- এসব বিষয়েই লেখা থাকতো নানা দম্ভোক্তি। এরপরই করা হতো সবচেয়ে অদ্ভুত কাজটি।
যদি শত্রুপক্ষ সেসোস্ত্রিসের বাহিনীর সাথে বীরের মতোই যুদ্ধ করে হারতো, তাহলে সেই স্তম্ভে এঁকে দেয়া হতো পুং জননাঙ্গের ছবি! আর যদি তারা বলার মতো প্রতিরোধ করতে না পারতো, তাহলে আঁকা হতো স্ত্রী জননাঙ্গের ছবি!
দ্বিতীয় আমাসিসের বায়ুত্যাগ
৫৭০-৫২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মিশরের রাজসিংহাসন অলঙ্কৃত করে ছিলেন দ্বিতীয় আমাসিস। পানাসক্ত এ রাজার ছোটবেলা থেকেই হাত সাফাইয়ের বদভ্যাস ছিলো।
আমাসিসের সিংহাসন প্রাপ্তি ঘটেছিলো বিদ্রোহের মাধ্যমে। মিশরের তৎকালীন রাজা তাকে পাঠিয়েছিলেন এক বিদ্রোহ দমন করতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমাসিস বুঝতে পারলেন যে, বিদ্রোহীদের জয়ের ভালোই সম্ভাবনা আছে। তাই এরপর বেশ পাল্টে তিনি নিজেই বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেন, হয়ে যান তাদের নেতা। এরপর রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে এক অদ্ভুত কাজ করেছিলেন তিনি। পা ফাঁক করে প্রথমেই তিনি বায়ুত্যাগ করেছিলেন। এরপর দূতের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, “এটা রাজার কাছে নিয়ে যাও!”
অ্যাক্টিসেন্সের নাক কাটাদের শহর
বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও এই বিদ্রোহই আবার ক্ষমতাচ্যুত করেছিলো দ্বিতীয় আমাসিসকে। বেশ রুক্ষ মেজাজের শাসক ছিলেন তিনি। তার শাসনে অতিষ্ট হয়ে একসময় তাকে উচ্ছেদ করে দেশবাসী। সেই উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক ইথিওপিয়ান, নাম তার অ্যাক্টিসেন্স। পরবর্তীতে তিনিই হয়েছিলেন মিশরের রাজা।
ক্ষমতায় বসেই অপরাধীদের শায়েস্তা করতে নতুন উপায় খুঁজতে শুরু করেন অ্যাক্টিসেন্স। অবশেষে তিনি এমন এক উপায় বের করেছিলেন যা একজন অপরাধীকে আজীবন স্মরণ করাতে থাকবে তার কৃতকর্মের কথা। অ্যাক্টিসেন্স ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে রাজ্যে যত অপরাধী ধরা পড়বে, সবারই নাক কেটে দেয়া হবে। শুধু তাই না, অপরাধীকে এরপর পাঠিয়ে দেয়া হবে শুধুমাত্র অপরাধীদের জন্যই বানানো এক শহরে; নাম তার রাইনোকলুরা। অবশ্য রাইনোকলুরাকে নাক কাটাদের শহর বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।
যে এই শহরে একবার ঘুরে এসেছে, সে কখনোই সেখানকার কথা ভুলতে পারে নি। সারা শহর জুড়ে কেবল নাক কাটা লোকদেরই বসবাস! এমন দৃশ্যের দেখা যেন শুধু দুঃস্বপ্নেই মেলে। শহরের পরিবেশও জনস্বাস্থ্যের জন্য খুব একটা উপযোগী ছিলো না। পান করার পানি ছিলো দূষিত। বেশ মানবেতর জীবন কাটাতে হতো সভ্য সমাজ থেকে রাইনোকলুরায় স্থান পাওয়া অপরাধীদের।
বর্তমান সমাজে বসে আমরা এ শাস্তিকে বেশ অমানবিক বললেও তৎকালীন শাস্তির হিসেবে এটাকে বেশ লঘুই বলা চলে। রাইনোকলুরা সম্পর্কে রোমানরা লিখেছিলো যে, এটা বন্দীদের প্রতি রাজার দয়ার এক অনন্য স্বাক্ষর!
ফেরোসের মূত্রপ্রীতি
একটু আগেই জননাঙ্গের ছবি স্মৃতিফলকে উল্লেখ করা সেসোস্ত্রিসের কথা মনে আছে তো? এই সেসোস্ত্রিসের ছেলেই ছিলেন ফেরোস। ধারণা করা হয় বংশগত এক রোগের কারণেই একসময় তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে এ দৃষ্টিশক্তি হারানো এবং পরবর্তীতে তা ফিরে পাওয়া নিয়ে বেশ চমৎকার এক গল্প প্রচলিত আছে। এর কতটা যে সত্য, আর কতটা মিথ্যে- কালের পরিক্রমায় সেটা মাপার আর কোনো উপায় নেই।
কথিত আছে যে, একবার নীল নদী বন্যার পানিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছিলো, মারাত্মক দুর্দশায় পড়েছিলো মিশরের জনগণ। তখন মিশর-রাজ ফেরোস নীল নদীকে আদেশ দিয়েছিলেন শান্ত হতে। কিন্তু এতে কোনো কাজ না হওয়ায় ক্ষেপে যান তিনি, নদীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মেরেছিলেন হাতে থাকা বর্শা। তার এমন স্পর্ধা মেনে নিতে পারেন নি দেবতারা। তাই তাদের অভিশাপে অন্ধ হয়ে যান ফেরোস।
এর প্রায় দশ বছর পরের কথা। একদিন এক পুরোহিত আসলেন ফেরোসের দরবারে। তিনি জানালেন যে, ফেরোস তার দৃষ্টি ফিরে পেতে পারেন। তবে এজন্য তাকে এমন এক নারীর মূত্র দিয়ে চোখ ধুতে হবে যিনি তার স্বামী ব্যতীত আর কারো সাথেই কখনো শারীরিক সম্পর্কে জড়ান নি।
এমন কথা শুনে রাজা প্রথমেই গেলেন তার স্ত্রীর কাছে। কিন্তু হায়, স্ত্রীর মূত্র দিয়ে চোখ ধোয়ার পরও তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো না! এতেই রাজার মনে তার স্ত্রী সম্পর্কে সন্দেহ ঢুকে গেলো। যা-ই হোক, ওদিকে মন না দিয়ে তিনি আপাতত মূত্র সংগ্রহে লেগে গেলেন। রাজ্যের সকল নারীই নির্ধারিত পাত্রে এসে মূত্র বিসর্জন করে যেতে লাগলো আর রাজা তা দিয়ে চোখ ধুতে লাগলেন।
কয়েক ডজন নারীর মূত্র দিয়ে চোখ ধোয়ার পর শেষ পর্যন্ত রাজা তার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিলেন। যে নারীর মূত্র দিয়ে চোখ ধোয়ার ফলে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান, তাকে তিনি সেখানেই বিয়ে করে নেন। আর বিশ্বাস ভঙ্গের দায়ে আগুনে পুড়িয়ে মারেন আগের স্ত্রীকে!
দ্বিতীয় রামেসিসের বিয়েপ্রীতি
মিশরীয় সাম্রাজ্যের ফারাওদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ক্ষমতাশালী ছিলেন দ্বিতীয় রামেসিস। তিনি বেঁচে ছিলেন প্রায় একানব্বই বছর ধরে। তৎকালের অধিকাংশ ফারাওই গুপ্তঘাতকদের হাতে নিহত হয়ে যেত। কিন্তু রামেসিসকে এতদিন ধরে বেঁচে থাকতে দেখে তার রাজ্যের লোকেরা ভাবতে শুরু করেছিলো যে, তিনি বোধহয় কোনোদিনই মরবেন না! ৬৬ বছর ধরে রাজত্ব করা দ্বিতীয় রামেসিস মৃত্যুর আগে নিজের ভাষ্কর্য বানানোর দিক যেমন অতীতে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি ছাড়িয়েছিলেন স্ত্রীর সংখ্যার দিক দিয়েও।
মৃত্যুর আগে কম করে হলেও নয়জন স্ত্রী ও একশ সন্তান রেখে গিয়েছিলেন তিনি। বোঝাই যাচ্ছে যে, রাজ্য পরিচালনার পাশাপাশি সংসার পরিচালনার দিকেও ভালোই নজর দিতেই এ রাজা। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তার এ বিয়ের বাসনা থেকে মুক্তি পায়নি স্বীয় সন্তানেরাও। নয় স্ত্রীর মাঝে তিনজন ছিলো তার নিজেরই মেয়ে। এ সংখ্যাটা চারজনও হতে পারে। তার স্ত্রী হেনুতমায়ার কি তার মেয়ে নাকি বোন ছিলেন সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকেরা নিশ্চিত হতে না পারাতেই বেধেছে এ বিপত্তি!