প্রাচীন গ্রিসে অদ্ভুতভাবে মৃত্যুবরণ করা বিখ্যাত ব্যক্তিরা

প্রাচীন গ্রিসের সভ্যতা নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। তারা কেমন ছিল? তারা কিভাবে প্রাচীনকাল থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে এতদূর এগিয়ে ছিল? তাদের সমাজব্যবস্থা কেমন ছিল? ঠিক একইভাবে একটা প্রশ্ন এসে যায়। তারা মারা যেত কিভাবে? ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখলে দেখা যাবে গ্রিক নায়করা মারা গিয়েছে কারও বর্শার আঘাতে কিংবা রথের পিছনে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে!

তবে গ্রিক সমাজ সবচেয়ে বেশি আলোড়িত ব্যক্তিরা হলেন দার্শনিক-কবি-লেখকরা। এদের মধ্যেই কেউ কেউ মারা গিয়েছিলেন অদ্ভুতভাবে যা সাধারণ মানুষের কল্পনাতেও আসবে না। সেরকম কিছু ঘটনা নিয়েই সাজানো আজকের লেখা।

অপমানিত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলে পড়া

হিপোনাক্স ছিলেন একজন কবি, অন্তত প্রাচীন গ্রিসের লোকজনরা তাই বলত, যার বেশ বড় একটি কারণ ছিল ভাষার অপ্রাচুর্য্যতা। একজন কবির কবিতায় আপনি আপনি কি খুঁজে পেতে পারেন? প্রকৃতির সৌন্দর্য, জীবনের আকাঙ্ক্ষা বা প্রেম-ভালোবাসার উপাখ্যানই তো পাবেন, তারচেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু হিপোনাক্সের কবিতাগুলো ঘেঁটে দেখলে নগ্নতা আর অশ্লীল বাক্য ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে পাওয়াও গোবরে পদ্মফুল খুঁজে পাওয়ার শামিল।

যা-ই হোক, এই হিপোনাক্সকে ইতিহাসের অন্যতম কুৎসিত চেহারার অধিকারী বলে মনে করা হয়। তাই তিনি তার ভালোবাসার মানুষটিকে প্রস্তাব পাঠানোর পর প্রত্যাখ্যাত হবেন এমনটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সবাই ভেবেছিল, হিপোনাক্স সাধারণদের মতোই অন্য কাউকে খুঁজে নেবে। কিন্তু হিপোনাক্স বেছে নিলেন অন্য পথ। তার কুরুচিশীল কবিতাগুলোর শিকার হলেন তার বাবা বুপালাস! হিপোনাক্স তার খারাপ চেহারার জন্য দায়ী করলেন তার বাবাকেই। এই বিখ্যাত গ্রিক ভাস্কর তার ছেলের করা অপমানে শেষমেশ আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন।

Image Source: ancient.eu

নিজের কৌতুকে নিজেই হেসে মারা যাওয়া

প্রাচীন গ্রিসের সেরা দার্শনিকদের নামের তালিকায় ক্রিসিপাসের নামটা দেখা আশ্চর্যের কিছু নয়। দর্শনশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা এবং নীতিশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করা এই বিদ্বান যদিও বাস্তব জীবনে খুবই অহংকারী ছিলেন, তা সত্ত্বেও ক্রিসিপাসের গুণ মোটেই কম না। ৭৩ বছরের জীবনে তিনি প্রায় ৭৫০ বই রচনা করেছেন, এর বেশিরভাগই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তার বেশ কয়েকটি বিখ্যাত লেখার একটিতে তিনি দেবী জুনোকে পতিতা হিসেবে দাবী করেছেন, যা গ্রিকদের মতে “বইটি পড়ার পর মুখ ঠিক রাখা অসম্ভব একটা ব্যাপার”!

ক্রিসিপাস একদিন পথ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি গাধাকে ডুমুর ফল খেতে দেখে ব্যাপক মজা পান এবং তার লোকজনদেরকে নির্দেশ দেন গাধাটিকে ওয়াইন দেওয়ার জন্য! এ কথা বলতে বলতেই তিনি মারা যান!

Sculpture Courtesy: British Museum

উপহারের ওজনে মারা যাওয়া

এথেন্স শহরের প্রথম হর্তাকর্তা বেশ কড়া শাসকই ছিলেন বলা যায়। তিনি মনে করতেন, গাজর চুরি করার জন্যেও মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা রাখা উচিৎ! এসব সত্ত্বেও এথেন্সবাসীরা ড্রাকোকে এতটাই পছন্দ করত যে, ড্রাকোকে শেষ পর্যন্ত নিজের জনপ্রিয়তার ওজনে চাপা পড়ে মারা যেতে হয়!

এইজিনার থিয়েটারে ড্রাকোর ভক্তরা তার জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ড্রাকো তার বক্তব্য দেওয়া শেষ করলে ভক্তরা তার দিকে নিজেদের জামাকাপড় খুলে তার দিকে ছুড়ে মারা শুরু করে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, প্রাচীন গ্রিসে অভিবাদন জানানোর রীতিটাও ছিল এরকম অদ্ভুতই। যা-ই হোক, ড্রাকোর ভক্তরা সেদিন একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। কয়েকশ ভক্তের ঘামে ভেজা কাপড়ের নিচে পড়ে শেষপর্যন্ত দমআটকে মারা যান প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত এই শাসক!

Image Source: ancient-origins.net

গোবরে মাখামাখি হয়ে কুকুরের কামড়ে মারা যাওয়া

অ্যারিস্টটল-প্লেটোর ভাবাদর্শকে প্রভাবিত করা হেরাক্লিটাস ছিলেন সক্রেটিস যুগেরও আগের দার্শনিক। বর্তমান তুরস্ক এবং প্রাচীন পারস্যের অধীনে থাকা এফিসাস শহরে থেকেই “বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক” তার গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। এই দার্শনিক বৃদ্ধ বয়সে শরীর ফোলা রোগে আক্রান্ত হন। তার শরীরে পানি জমতে শুরু করে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোনোরকম উপকার না পাওয়ায় তিনি অদ্ভুত এক উপায়ের দ্বারস্থ হন। তার মনে হয়েছিল, “গোবরে শুয়ে থাকলে গোবর তার শরীরের পানি শুষে নেবে”!

এই চিন্তাভাবনা থেকেই তিনি একদিন সকালে গোবরে মাখামাখি হয়ে শুয়ে পড়লেন। সন্ধ্যার দিকে উঠতে চেষ্টা করলেও গোবর শক্ত হয়ে লেপ্টে যাওয়ায় তিনি ওখানেই আটকে থাকলেন। শেষমেশ গভীর রাতে জ্যান্ত অবস্থাতেই হিংস্র কুকুরের পেটে চলে যান এই দার্শনিক।

Painting Courtesy: Johannes Moreelse

বই লেখার সময়ে মারা যাওয়া

“দ্য হিস্টোরি অফ পেলোপোনেশিয়ান ওয়্যার”- বইয়ের লেখক থুসিডাইডস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের আরেকজন বিখ্যাত দার্শনিক। প্রাচীন গ্রিসের অল্প কিছু ইতিহাস রচয়িতাদের মধ্যে থুসিডাইডসই ছিলেন এমন ব্যক্তি যারা ইতিহাসের মধ্যে গালগল্প এবং রুপকথা ঢুকিয়ে দেননি, এজন্য বর্তমানে তার লেখা ইতিহাসের বইগুলোই একেবারে প্রথম সারিতে রাখা হয়।

থুসিডাইডস ছিলেন স্পার্টা এবং অ্যাথেন্সের মধ্যে সংঘটিত পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধের একজন সেনাপতি। কিন্তু তিনি তার শহর “আম্ফিপোলিস” রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকাকালীন সময়ে তিনি তার বই লেখার কাজ চালিয়ে যান। তারপর হঠাৎ করেই গ্রিস থেকে নির্দেশ আসে তার দন্ড উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। একেবারে সঠিক কারণ জানা না গেলেও গ্রিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার পর পথিমধ্যেই কেউ একজন তাকে খুন করে। ছুরি দিয়ে করা আঘাতের সময় তিনি বই লেখায় ব্যস্ত ছিলেন এবং তার বাক্য তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি!

Image Source: ancient-origins.net

ভুল ঠিক করতে গিয়ে না খেয়ে মারা যাওয়া

ফিলিটাস ভুল সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, কথাটা একেবারে হাড়ে হাড়ে সত্যি। এই আধুনিক যুগে যদি ফিলিটাস জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে ইন্টারনেটের রাজা হতে যে তার বেশি সময় লাগত না তা বলাই বাহুল্য।

লেখক এবং একইসাথে কবি এরকম কিছু ব্যক্তিদের মধ্যে প্রাচীন গ্রিসে সর্বপ্রথম উদয় হয়েছিলেন ফিলিটাস। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো “ডিজঅর্ডারলি ওয়ার্ডস”, যে বইতে খুবই বিরল কিছু সাহিত্যের শব্দের উল্লেখ রয়েছে যেগুলো পড়ে হোমার তার লেখায় ব্যবহার করেছিলেন। ফিলিটাস তার সময় পার করতেন আরেকজন মানুষের ভুল ধরে! যখনই কেউ তার সামনে কোনো ভুল শব্দ উচ্চারণ করত কিংবা অযৌক্তিক কথা বলত, তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে তার ভুল ধরিয়ে দিতেন। কোন শব্দটি ব্যবহার করলে তার বাক্যটি আরও যৌক্তিক এবং আরও সুন্দর হত তা নিয়েই সারাদিন গবেষণা করতেন।

তিনি আরেকজনের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এতটাই উদগ্রীব ছিলেন যে, নিজের খাওয়ার কথাটাই মনে রাখতে পারতেন না! তিনি এতটাই রুগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন যে, রোমান কবি এলিয়ান তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন যে ফিলিটাস তার জুতার নিচে সীসার পাট বসিয়ে রাখতেন যেন বাতাসের তোড়ে উড়ে না যান! শেষমেশ তিনি মারাই যান ভুল শব্দ নির্বাচনের প্রতিকার নিয়ে চিন্তা করতে করতে! ফিলিটাসের এই কান্ড কিংবদন্তীর রূপ নেয়। অবশেষে তার কবরের ফলকে লিখে রাখা হয়, “আগন্তুক, আমি সেই ফিলিটাস। মিথ্যা শব্দগুলো আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে”!

Sculpture Courtesy: National Archaeological Museum of Athens

অলিম্পিক জেতা প্রথম মৃত ব্যক্তি

প্রাচীন গ্রিসের অলিম্পিক গেমসে প্যানক্রেশন ছিল অন্যতম আকর্ষণীয় ইভেন্ট। এটি অনেকটা আধুনিক রেসলিং-এর মতো, খালি হাতে মারামারি করা এবং আরেকজন ট্যাপ আউট করা না পর্যন্ত তা চালিয়ে যাওয়া। বেশিরভাগ সময়েই প্যানক্রাটিয়াস্টরা মারা যেত। আরিকিওন ছিলেন এমন একজন প্যানক্রাটিয়াস্ট এবং বোধহয় সবচেয়ে বিখ্যাত। অলিম্পিক গেমসে নিজের ক্যারিয়ারের একেবারে শুরু থেকেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন ছিলেন আরিকিওন।

প্রতিবারের মতো সেবারও চ্যাম্পিয়নশিপ নিজের দখলে রাখতে ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলেন আরেকজন মুষ্টিযোদ্ধার। ম্যাচের এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষ আরিকিওনের পা বাঁকিয়ে চেপে ধরে কটিসন্ধির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আরিকিওন ব্যাথায় পরাজয় স্বীকার করতে যাওয়ার ঠিক আগেই পাশ থেকেই তার ওস্তাদ এরিক্সিয়াস তাকে চিৎকার করে উৎসাহ দিয়ে বলছিলেন, “কতটা গৌরবের ব্যাপার হবে যদি তোমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সবাই বলতে থাকে এই লোকটি অলিপিয়াতেও হাল ছেড়ে দেয় নি!” এই কথা শুনতেই আরিকিওন তার প্রতিপক্ষের গোড়ালি পা থেকে আলাদা করে ফেলেন! প্রতিপক্ষ ব্যাথায় আত্মসমর্পণ করার আগেই আরিকিওন দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নেয়।

Image Source: Alibaba.com

ঈগলের মুখ থেকে ফেলে দেওয়া কচ্ছপের আঘাতে মারা যাওয়া

“ট্রাজেডি সাহিত্যের জনক” এইসকিলাসকে দেখে এক সাধু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন “তুমি সাগরের ঝাপ্টায় মারা যাবে”! এই বাণীর কারণেই তিনি সবসময়ই কোনো নাটকীয় মৃত্যুর অপেক্ষা করতেন, হয়ত জলোচ্ছাসের আঘাতে ভাঙ্গা বাড়ির নিচে চাপা পড়ে মরবেন এরকম কিছুই তার আশঙ্কা ছিল। তবে তার মৃত্যুর কারণটাও যে এর চেয়েও নাটকীয় ছিল তা কে জানত?

এইসকিলাস যখন সিসিলিতে অবস্থান করেছিলেন, তখন এক ঈগল মুখ থেকে কচ্ছপ ফেলে দেয়। এরকম ঈগলের অভ্যাস হলো মুখে কচ্ছপ নিয়ে কোনো পাথরের উপর ছুড়ে মারা যাতে কচ্ছপের খোলস ভেঙে যায়। এইসকিলাসের চকচকে টাক দেখে ঈগলটি ভেবেছিল হয়ত এটি কোনো পাথরই হবে! শেষমেশ কচ্ছপের খোলস ফাটার বদলে এইসকিলাসের মাথাটাই ফেটে একাকার হয়ে যায়!

Caption

অমর হওয়ার জন্য আগ্নেয়গিরিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যু

সিসিলির অন্তর্গত আক্রাগাস শহরে বাস করতেন বিখ্যাত দার্শনিক এম্পেডোক্লিস। হঠাৎ করেই আক্রাগাস শহরের এক বৃদ্ধা ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল, কোনো চিকিৎসকই তাকে সুস্থ করে তুলতে পারছিল না। তো সেই বৃদ্ধা এম্পেডোক্লিসের শরণাপন্ন হলেন। এম্পেডোক্লিসও কিভাবে যেন সেই বৃদ্ধার রোগ সারিয়ে দিল। তারপর থেকে এই বিখ্যাত দার্শনিক মনে করতে থাকলেন তিনি নিশ্চয়ই কোনো দেবতা হবেন। এরপর তিনি শহরের সবাইকে জড়ো করে এক আগ্নেয়গিরির চূড়ায় উঠলেন। সেখান থেকেই ঘোষণা করলেন, “সবাই মাথা নিচু কর! আমিই তোমাদের অমর দেবতা!” কথাটা বলেই আগ্নেয়গিরিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এম্পেডোক্লিস এবং এভাবেই মারা যান!

Image Source: The History of philosophy by Thomas Stanley

This article is in Bangla language. It's about some famous Greeks people who died in bizarre way. The sources are hyperlinked in the article. Please click on the hyperlinks to check the references.

Featured Image: modafinilsale.com

Related Articles

Exit mobile version