১৪ এপ্রিল, ১৯৯৪; জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দেয়া শর্ত ১৯৯১ সালের এপ্রিলে মেনে নিয়েছে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকি সরকার। ফলে উত্তর ইরাকে জাতিসংঘের কোয়ালিশন ফোর্স প্রবেশ করে এবং অপারেশন প্রোভাইড কমফোর্ট (OPC) শুরু করে। এটি মূলত জাতিগতভাবে নিপীড়িত কুর্দি জনগোষ্ঠীর জন্য মার্কিন সুরক্ষা কার্যক্রম। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ইরাকের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান প্রদেশ তৈরি করা এবং পার্সিয়ান গালফ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত কুর্দি জনগণের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়া। এসময় ইউএস আর্মির দুটো ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টারকে ভুলক্রমে ইরাকি আর্মির হেলিকপ্টার মনে করে ভূপাতিত করে মার্কিন এয়ারফোর্সের একটি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান। এটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’ তথা স্বপক্ষের হামলায় সবচেয়ে বড় প্রাণহানীর ঘটনা, যেখানে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাসহ ২৬ জন প্রাণ হারান!
মূল ঘটনা
উত্তর ইরাকে কুর্দিদের রক্ষার জন্য তখন ‘নো ফ্লাই সিকিউরিটি জোন’ ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন ফোর্স। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নো ফ্লাই সিকিউরিটি জোন বলতে এমন একটি এলাকাকে বোঝানো হয় যেখানে কোনো সামরিক/বেসামরিক বিমান উড়বে না।
৭ এপ্রিল, ১৯৯১; ইরাক জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেয়। ঐদিনই প্রায় ৫ লাখ কুর্দির জন্য জাতিসংঘের ত্রাণবহর রওনা দেয়। এর নিরাপত্তা দেয়ার জন্যই OPC শুরু হয়। ত্রাণবহরের নিরাপত্তার জন্য প্রথমে ইরাকি বিমানবাহিনীর জন্য ঐ অঞ্চল নিষিদ্ধ করা হয়। ইরাকি দুটো যুদ্ধবিমান নিয়ম ভঙ্গ করে মার্কিন বিমানবাহিনীর হাতে ভূপাতিত হওয়ার পর ঐ অঞ্চলে একেবারে ‘নো ফ্লাই সিকিউরিটি জোন’ তথা সামরিক-বেসামরিক সব ধরনের বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এভাবে উত্তর ইরাকে ১৬০×৭০ কি.মি. এলাকা জুড়ে নো ফ্লাই সিকিউরিটি জোন বলবৎ থাকে।
উল্লেখ্য, ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় স্বাধীনতাকামী ইরাকি কুর্দিরা ইরানের পক্ষ নিয়ে সাদ্দাম হোসেনের চক্ষুশূল হন। ইরাকি এয়ারফোর্স ১৮ মার্চ, ১৯৮৮ সালে কুর্দিদের উপর হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে বিষাক্ত কেমিক্যাল বোমা ছুড়ে ৫ হাজারের বেশি কুর্দিকে হত্যা করে। ইতিহাসে এটি হালাবজা গণহত্যা নামে পরিচিত। ফলে নো ফ্লাই জোনে জাতিসংঘের সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যতীত অন্য যেকোনো সামরিক/বেসামরিক হেলিকপ্টারও প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ইরাককে জানিয়ে দেয়া হয়, যদি নো ফ্লাই জোনে তাদের কোনো এয়ারক্রাফট ঢোকে তবে সতর্কতা প্রদান ছাড়াই ভূপাতিত করা হবে। সাদ্দাম হোসেন জাতিসংঘের এসব শর্ত মানতে বাধ্য হন।
১৪ এপ্রিল, ১৯৯৪ সালে সকাল সাড়ে ৭টায় ইউএস এয়ারফোর্স এর ৯৬৩ তম এয়ারবোর্ন এয়ার কন্ট্রোল স্কোয়াড্রনের E-3 নামক Airborne Warning And Control System (AWACS) বিমান তুরস্কের ইনচির্লিক এয়ারবেজ থেকে ১৯ জন ক্রু-সহ টেকঅফ করে। এ ধরনের বিমানকে উড়ন্ত রাডার বলা হয়, কারণ এরা কয়েকশ কিলোমিটার এলাকাকে নিজস্ব রাডার নজরদারির আওতায় আনতে সক্ষম। সেদিন এই E-3 AWACS বিমানটির দায়িত্ব ছিল OPC-তে নিয়োজিত এয়ারক্রাফটগুলোর জন্য এয়ারবোর্ন থ্রেট মনিটরিং করা।
বিমানটি উত্তর ইরাক সীমান্তের কাছাকাছি ৩২ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ছিল। সকাল ৮:২২ মিনিটে দুটো UH-60 Black Hawk হেলিকপ্টার সেই তুর্কি এয়ারবেজ থেকে টেকঅফ করে। Black Hawk Down (2001) মুভির কল্যাণে আপনারা হয়তো এই হেলিকপ্টারের সাথে পরিচিত। এগুলো সেখান থেকে ২৪০ কি.মি. দূরে অপারেশন প্রোভাইড কমফোর্ট এর Military Co-ordination Center (MCC) এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এত দূরের ফ্লাইটের জন্য হেলিকপ্টারগুলো দুটো করে ২৩০ গ্যালন বা ৮৭০ লিটারের এক্সটার্নাল ফুয়েল ট্যাংক বহন করে, যা ডানার দু’পাশে লাগানো ছিল। কপ্টারগুলোর নাক, পেট, দরজা ছাড়াও ফুয়েল ট্যাংকগুলোতে মার্কিন পতাকা অঙ্কিত ছিল।
সকাল ৯:২১ এ কপ্টার দুটো AWACS এর রুট কন্ট্রোলার অফিসার (যিনি নো ফ্লাই জোনে যাওয়া-আসা করা এয়ারক্রাফট মনিটর করেন) লেফটেন্যান্ট জোসেফ হেলসির কাছে রিপোর্ট করে যে তারা নো-ফ্লাই জোনে পৌঁছে গেছে। পৌঁছার ৬ মিনিট পর তারা মিলিটারি কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের হেলিপ্যাডে ল্যান্ড করে। নিয়ম মোতাবেক নো ফ্লাই জোনে ঢোকার পরপরই AWACS বিমানের অপারেটর ক্যাপ্টেন জিম ওয়াং হেলিকপ্টার দুটোকে ‘ফ্রেন্ডলি হেলিকপ্টার’ হিসেবে রাডারে মার্ক করে রাখেন। এই সিস্টেমকে বলে Identification Friend or Foe (IFF)। এর ফলে নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো এয়ারক্রাফট শত্রু নাকি মিত্রের সেটি বোঝা যায়। হেলিকপ্টার দুটোর জন্য যথাক্রমে মোড ১ ও মোড ২ মার্কিং সিগন্যাল বরাদ্দ করেছিল AWACS বিমানের ক্রুরা। ৯:২৪ মিনিটে ল্যান্ডিং করার কারণে AWACS রাডার থেকে কপ্টারগুলো উধাও হয়ে যায়।
এখানেই রাডার অপারেটর ওয়াং একটি ভুল করেন। মোড ১ ছিল নো ফ্লাই জোনের Tactical Area of Responsibility (TAOR) এর জন্য বরাদ্দ। যারা নো-ফ্লাই জোনে পুলিশ হিসেবে উড়বে অর্থাৎ যারা এই অঞ্চলকে আকাশে সুরক্ষা দেবে (যুদ্ধবিমান), তারা মোড ১ এর IFF সিগন্যাল ব্যবহার করবে। এটি ছাড়াও প্রথম ব্ল্যাকহকের পাইলটরা “রুট ফ্রিকোয়েন্সির বদলে TAOR ফ্রিকোয়েন্সি কেন ব্যবহার করা হচ্ছে?” এই মর্মে AWACS এর কাছে ব্যাখ্যা চায়নি। যদিও অপর হেলিকপ্টারটি সঠিক মোড বরাদ্দ পায়।
ল্যান্ড করার পর হেলিকপ্টার দুটোতে ৪ জন কুর্দি বেসামরিক লোক, ৩ জন তুর্কি, ২ জন ব্রিটিশ, ১ জন ফরাসি মিলিটারি অফিসারসহ ৪ জন মার্কিন বেসামরিক লোক ও দুজন কর্নেল র্যাঙ্কের আর্মি অফিসারসহ মোট ১৬ জন পিকআপ করে। ৯:৫৪ মিনিটে কপ্টার দুটো ইরাকের ইরবিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, যা ল্যান্ডিং স্পট থেকে ১৯০ কি.মি. দূরে। আকাশে ওঠার সাথে সাথে যাত্রার সমস্ত তথ্য AWACS বিমানের লেফটেন্যান্ট হ্যালসির কাছে প্রেরণ করেন এবং তিনি পুনরায় কপ্টার দুটোকে ফ্রেন্ডলি মার্কিং করেন। মার্কিংগুলো অপর অপারেটর ওয়াং, ট্রেসি এবং AWACS বিমানের কমান্ডার মেজর মার্টিনের স্কোপেও দেখা যাচ্ছিল।
সকাল ১০:১২ মিনিটে কপ্টারগুলো উড়তে উড়তে পাহাড়ের আড়ালে চলে যায় এবং AWACS এর রাডার থেকে পুনরায় অদৃশ্য হয়ে যায়। উল্লেখ্য, পাহাড়ে রাডার তরঙ্গ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এয়ার সার্ভাইল্যান্স অফিসার ক্যাপ্টেন বেল প্রথম লক্ষ্য করেন এবং তিনি ওয়াং এর স্কোপে অ্যাটেনশন অ্যারো পাঠান যাতে তিনি ব্যাপারটিতে মনোযোগ দেন। কিন্তু তিনি সেটা দেখেননি বা নোটিফিকেশন রিসিভ করেননি।
ঐদিন নো ফ্লাই জোনে এয়ার পুলিশিং এর জন্য সকাল ৯:৩৫ মিনিটে দুটো F-15C যুদ্ধবিমান তুরস্কের ইনচিরলিক এয়ারবেজ থেকে টেকঅফ করে। Eagle নামে খ্যাত এই যুদ্ধবিমান দুটোর পাইলট ছিলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন এরিক উইকশন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেন্ডি এম. ওয়ে। তাদের মিশন ছিল সুইপার অপারেশন অর্থাৎ TAOR এলাকায় যেকোনো শত্রু এয়ারক্রাফট সুইপ করা। তবে ঐদিন মিশন এলাকায় কোয়ালিশন ফোর্সের কোন কোন এয়ারক্রাফট এর শিডিউল ফ্লাইট থাকবে সেটা নিয়েও তাদের ব্রিফ করা হয়েছিল টেকঅফ এর আগে। অর্থাৎ ব্ল্যাকহক দুটোর মিশনের কথা এফ-১৫ পাইলটরা জানতেন। তবে প্যাসেঞ্জার নিয়ে কখন, কোথা থেকে টেকঅফ করবে এবং কোথায় যাবে সেটা জানতেন না।
১০:১৫ মিনিটে যুদ্ধবিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন উইকশন AWACS এর অপারেশন কমান্ডার মেজর মার্টিনের কাছে জানতে চান আশেপাশে কোনো শত্রু এয়ারক্রাফট আছে কি না, কিন্তু তিনি না-সূচক জবাব দেন। কেননা দুটো ফ্রেন্ডলি ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার এবং সিভিলিয়ান কিছু প্লেন ছাড়া আশেপাশে এমন কেউ ছিল না যে কি না নো-ফ্লাই জোনের জন্য হুমকিস্বরুপ হতে পারে। ১০:২০ মিনিটে অপর এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেন্ডি রিপোর্ট করেন যে তারা উত্তর ইরাকে প্রবেশ করেছেন। এসময় তারা TAOR ফ্রিকোয়েন্সিতে কথা বলেন। অন্যদিকে কপ্টার দুটো ছিল রুট ফ্রিকোয়েন্সিতে। TAOR ফ্রিকোয়েন্সি এয়ার পুলিশদের জন্য এবং রুট ফ্রিকোয়েন্সি নো ফ্লাই জোনে যাতায়াতকারীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। AWACS এর অপর ক্রু উইলসন দুটো ফ্রিকোয়েন্সিই মনিটরিং করছিলেন এবং তিনি ব্ল্যাকহক দুটোকে আবার দেখতে পান যা ১০:১২ মিনিটে পাহাড়ের কারণে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তবে উইলসন এবং অন্য ক্রু মেম্বার যারা এফ-১৫ এর ফ্রিকোয়েন্সি মনিটরিং করছিল তারা কেউ ব্ল্যাকহকের ব্যাপারে এফ-১৫ দুটোকে জানাননি বা জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।
১০:২১ মিনিটে আবারও পাহাড়ের কারণে কপ্টার দুটো উধাও হয়ে যায় এবং অনেকক্ষণ রাডারে অদৃশ্য থাকে। উইলসন মনে করলেন কপ্টার দুটো আবার ল্যান্ড করেছে এবং তিনি ক্যাপ্টেন ওয়াংকে ফ্রেন্ডলি IFF মার্কিং সরিয়ে ফেলতে বলেন। নির্দেশনা পেয়ে ওয়াং সেটা করেন। অথচ উইলসনের উচিৎ ছিল কপ্টার দুটোর সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করে আসলেই তারা ল্যান্ড করেছে কি না সেটা নিশ্চিত হওয়া। উল্লেখ্য, উইলসন ছিল জুনিয়র অফিসার এবং তার সুপারভাইজার ক্যাপ্টেন মার্ক ক্যাথি তাকে দায়িত্ব দিয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়েছিলেন সকাল ১০:০০ এর দিকে। উক্ত AWACS বিমানে ১৩-১৯ জন ক্রু থাকে এবং কয়েক ঘন্টা ডিউটি করার জন্য ক্রুরা তাদের কাজ ভাগাভাগি করে নেয়।
সকাল ১০:২২ মিনিটে যুদ্ধবিমানের পাইলট উইকশন ২৭,০০০ ফুট উপর দিয়ে ফ্লাই করার সময় একটি লো-অ্যালটিটিউডে স্লো ফ্লাইং এয়ারক্রাফট শনাক্ত করেন। এফ-১৫ পাইলট সাথে সাথেই তথ্যটি AWACS ক্রু উইলসনকে জানান, কিন্তু তিনি বলেন ঐ অঞ্চলে তিনি কোনো রাডার সিগনেচার দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার দুটো এখনও পাহাড়ের আড়ালে থাকায় AWACS বিমানের রাডার তাকে ধরতে পারছে না। যদিও এফ-১৫ এর শনাক্ত করা সিগনেচার দুটো ছিল কপ্টার দুটোর, যা ২৭ হাজার ফুট উচ্চতায় ওড়ার কারণে তারা শনাক্ত করতে পেরেছিল। কিন্তু AWACS ক্রু ট্রেসি কিংবা ওয়াং কেউই এফ-১৫ এর শনাক্ত করা রাডার কন্টাক্টগুলো কী ছিল সেটা চেক করেননি। করলে হয়তো উইলসন সেটা খুঁজে পাননি, সেটা তারা খুঁজে পেত। কারণ AWACS বিমানগুলো একাধিক অ্যাঙ্গেলে রাডার ওয়েভ ছুড়ে চারপাশের থ্রি-ডি ম্যাপ তৈরি করতে পারে।
এদিকে এফ-১৫ এর পাইলট দুজন তাদের IFF সিস্টেম চেক করে মোড ১ এবং মোড ৪ এ কোনো মার্ক খুঁজে পাননি। TAOR এলাকায় কোনো ফ্রেন্ডলি এয়ারক্রাফট থাকলে মোড ১ এবং TAOR এর বাইরে থাকলে মোড ৪ মার্কিং বরাদ্দ ছিল। তাই এফ-১৫ দুটো আনআইডেন্টিফাইড এয়ারক্রাফট দুটোকে ইন্টারসেপ্ট করতে দৌড় লাগান। এরই মধ্যে আবারও কপ্টার দুটো AWACS ক্রু উইকশন এবং অন্যান্যদের স্কোপে ধরা পড়ে যা মোড ১ ও মোড ২ মার্কিং ছিল। ওয়াং তাদেরকে আবারও ফ্রেন্ডলি হিসেবে রাডারে মার্ক করেন। ১০:২৫ মিনিটে সেই রাডার কন্টাক্টগুলোকে ৩২ কি.মি. দূর থেকে ফলো করছিল দুটো এফ-১৫ এবং AWACS ক্রু উইকশনকে জিজ্ঞেস করলেন এখন AWACS এর রাডারে কিছু দেখাচ্ছে কি না। জবাবে উইকশন দুটো কন্টাক্টের কথা জানান, কিন্তু সেটা যে নিজেদের হেলিকপ্টার সেটা একবারও এফ-১৫ কে বলা হয়নি। তাই যুদ্ধবিমান দুটো এবার আনআইডেন্টিফাইড এয়ারক্রাফটের ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিফিকেশন (VID) পেতে হেলিকপ্টারের পাশ দিয়ে ‘সারপ্রাইজ পাস’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ একটি বিমান পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে টার্গেট সম্পর্কে নিশ্চিত হবে। কেননা শুট করার আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া OPC-তে অংশ নেয়া কোনো ফাইটার এয়ারক্রাফটের জন্য ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ তথা আক্রমণ করার জন্য ফ্লাইট অ্যালটিটিউড থাকতে হবে ১০ হাজার ফুট। কিন্তু এফ-১৫ এর আনআইডেন্টিফাইড এয়ারক্রাফট ব্ল্যাকহকগুলো মাত্র ২০০ ফুট উপর দিয়ে ২৪০ কি.মি./ঘন্টা গতিতে উড়ছিল যা এফ-১৫ এর কাছে সন্দেহজনক ছিল। কেননা রাডার ফাঁকি দেয়ার জন্য কম উচ্চতায় ওড়ার কৌশল একমাত্র শত্রু হেলিকপ্টারই প্রয়োগ করে থাকে।
পাইলট উইকশন ৮৩০ কি.মি./ঘন্টা গতি নিয়ে ব্ল্যাকহক দুটোর পাঁচশো ফুট উপর এবং এক হাজার ফুট বামে দিয়ে VID পাস হিসেবে উড়ে যান। এক্সটার্নাল ফুয়েল ট্যাংক থাকায় তিনি ব্ল্যাকহককে ইরাকের ব্যবহৃত Mil Mi-24 হিসেবে শনাক্ত করেন। উল্লেখ্য, এই রাশিয়ান ট্রান্সপোর্ট ও অ্যাটাক হেলিকপ্টারটি ইরাক এবং সিরিয়ার সামরিক বাহিনীতে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। হাইন্ডের দুই পাশে ছোট উইং আছে যাতে রকেট পড, বোমা, ফুয়েল ট্যাংক বহন করা যায়। পাইলট উইকশন AWACS বিমানে সম্ভাব্য ইরাকি হাইন্ড হেলিকপ্টার সম্পর্কে রিপোর্ট করেন এবং AWACS ক্রু উইলসন জবাবে বলেন, “Copy, Hinds”। অর্থাৎ তিনি অবগত হয়েছেন। তারপর তিনি সিনিয়র অফিসার ওয়াংকে জিজ্ঞেস করলেন, এফ-১৫ কি বলেছে তা তিনি শুনেছেন কি না। জবাবে ওয়াং “Affirmative” বলেন। কিন্তু তিনি এফ-১৫ বা ক্রু উইলসনকে কোনো নির্দেশনা দেননি।
এদিকে পাইলট উইকশন ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিফিকেশনে ভুল করেছিলেন। কেননা ইরাকি হাইন্ডগুলো ডেজার্ট ক্যামো করা এবং ব্ল্যাকহকগুলোর রং ছিল ডিপ গ্রীন ক্যামো। তাছাড়া এক্সটার্নাল ফুয়েল ট্যাংক লাগলেও ব্ল্যাকহকগুলো কোনোভাবেই হাইন্ডের মতো দেখতে নয়। হাইন্ডের ডানাগুলো খানিকটা বাঁকা থাকে। এছাড়া দুটো হেলিকপ্টারের ককপিট দেখতে একদমই অন্যরকম। তারপরও এফ-১৫ পাইলট হয়তো গতির কারণে ভুল দেখেছেন। যদিও সিভিল বা মিলিটারি যা-ই হোক না কেন, হেলিকপ্টারের সর্বোচ্চ ৫০০ ফুট দূর দিয়ে তিনি পাস দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত।
পাইলট উইকশন এবার সার্কেল করে কপ্টার দুটোর ১৬ কি.মি. পেছনে অবস্থান নেন। তিনি এবার কপ্টারের ন্যাশনালিটি শনাক্ত করার জন্য পুনরায় পাস দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তিনি হেলিকপ্টার ৫০০ ফুটের চেয়ে আরো কাছ দিয়ে উড়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ১০:২৮ মিনিটে পাইলট উইকশন AWACS থেকে শুট করার নির্দেশ পান এবং ১০:৩০ মিনিটে তিনি ১০ কি.মি. দূর থেকে AIM-120 AMRAAM নামক মিসাইল ফায়ার করেন।
৭ সেকেন্ড পর প্রথম কপ্টারে মিসাইল আঘাত করে এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। অপর হেলিকপ্টারটি সাথে সাথে আরো কম উচ্চতায় যাওয়ার জন্য ডাইভ দেয় এবং মিসাইল থেকে বাঁচার জন্য কাউন্টারমেজার চালু করে। কিন্তু এর ২০ সেকেন্ড পর ২.৮ কি.মি. দূর থেকে ফায়ার করা একটি AIM-9 Sidewinder মিসাইল ২য় ব্ল্যাকহককে আঘাত করে। এর ফলে দুটো হেলিকপ্টারে থাকা পাইলট, অন্যান্য ক্রু ও যাত্রীসহ মোট ২৬ জন লোক মুহূর্তেই নিহত হন। ২য় কপ্টারটি মিসাইল থেকে বাঁচতে এঁকেবেঁকে প্রায় ৮০০ মিটারের মতো ‘ম্যানুভারিটি ফ্লাই’ করেছিল। ফ্লেয়ার ছুড়েও বিভ্রান্ত করতে পারেনি হিটসিকিং সাইডওয়াইন্ডার মিসাইলকে!
এ ঘটনা খুব দ্রুত সিএনএন এর মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বার বার ব্রিটেন, ফ্রান্স, তুরস্কের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন। এছাড়াও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দুঃখ প্রকাশ করে।
১৯৯৩ সালের অক্টোবরে সোমালিয়ায় সংগঠিত ‘ব্যাটল অফ মোগাদিসু’-তে দুটো মার্কিন ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়ার ঘটনার চেয়েও এই ঘটনা বেশি আলোচিত হয়। মেজর জেনারেল জেমস অ্যান্ড্রুজের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনা ছিল সম্প্রতি ঘটা সবচেয়ে বড় এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনা যা ঘটেছিল ফ্রেন্ডলি ফায়ারিংয়ের কারণে। এর কারণ হিসেবে পাওয়া যায়:
১) পাইলট উইকশন ব্ল্যাকহককে চিনতে ভুল করেছিলেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বহুল ব্যবহৃত হেলিকপ্টার যা বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিদিনই চোখের সামনে ওঠা-নামা করতে দেখেছেন তিনি।
২) এফ-১৫ যুদ্ধবিমান বা ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টারের IFF ট্রান্সপোন্ডার সঠিকভাবে অপারেট করা হয়নি।
৩) বিমানবাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার অপারেশন কীভাবে চালাতে হয় সেটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।
৪) AWACS বিমানের ক্রু কমান্ডার যথেষ্ট মানসম্পন্ন ছিলেন না। যখন তার ক্রুরা ভুল করছে, তখন তিনি শুধরে দেননি।
৫) ‘অপারেশন প্রোভাইড কমফোর্ট’ পাইলটরা নো ফ্লাই জোনের ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ সম্পর্কে পুরোপুরি ট্রেনিং পায়নি। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম নো ফ্লাই জোন কার্যকর করা হয়েছিল। ফলে পাইলটদের ট্রেনিংয়ের ঘাটতি ছিল।
৬) ব্ল্যাকহকে এমন কোনো আধুনিক রেডিও ছিল না যা দিয়ে এফ-১৫ এর সাথে যোগাযোগ করা যায়। তা না হলে দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটি বেঁচে যেতে পারতো।
৭) এফ-১৫ এর VID পাস দেয়ার পর এর কারণ জানতে চেয়ে AWACS এ রিপোর্ট করেনি ব্ল্যাকহক। ৫০০ ফুটের বাইরে দিয়ে উড়ে গেলেও মারাত্মক ঝাঁকুনি খেয়েছিল হেলিকপ্টারটি, যা হেলিকপ্টারে থাকা বেসামরিক লোকদের ভয় পাইয়ে দেয়ার মতো যথেষ্ট।
৮) চেইন কমান্ড ঠিকমতো কাজ করেনি। AWACS ক্রুরা সিনিয়র অফিসারের নির্দেশের অপেক্ষা না করে নিজেরাই এফ-১৫-কে মিসাইল হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল।
৯) তদন্ত কমিটি রিপোর্ট করে যে AWACS এর সিনিয়র ডিরেক্টর ওয়াং, মিশন ক্রু কমান্ডার ট্রেসি এবং মেজর মার্টিন তার অধীনস্তদের বা এফ-১৫ পাইলটদের হেলিকপ্টার ইন্টারসেপ্ট করতে কোনো প্রকার দিক নির্দেশনাই দেননি। ফলে তারা ভুল করেছে।
১০) ক্রুদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে সবচেয়ে মুখ্য কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এমনকি তারা এই ঘটনার জন্য কাউকেই দায়ী করেনি, নিজেদের দোষ স্বীকার করেনি। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের এই অংশটি পড়লেই তা বোঝা যাবে,
1. When questioned by board investigators as to who was responsible for tracking the helicopters, Tracy said, “I cannot tell you that. I honestly don’t know.”
2. When Wang was asked the same question by the investigators, he replied, “No one is responsible.”
3. When the investigators asked Martin what action he took when the F-15s called a visual identification on two Hind helicopters, Martin stated, “I did nothing.”
পরবর্তীতে মার্টিন, ট্রেসি, ওয়াং, হ্যালসি ও উইলসনকে দোষী সাব্যস্ত করে দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রাথমিকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এফ-১৫ পাইলট উইকশনকে পাইলট হিসেবে অব্যাহতি দেয়া হয়। কেননা তিনি তদন্ত কমিটির কাছে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে কপ্টার দুটো হাইন্ড ছিল। যদিও তার আইডেন্টিফিকেশন ভুল ছিল। তারপরও তাকে ঐ এলাকায় ব্ল্যাকহক থাকার কথা কেউই জানায়নি AWACS থেকে। উল্টো AWACS থেকে কপ্টার শুট করার নির্দেশ দেয়া হয় এবং তিনি শুধু নির্দেশ অনুসরণ করেছেন। এ ঘটনার সাথে জড়িত প্রত্যেকের কোর্ট মার্শাল হয়। এমনকি তাদের কমান্ডিং অফিসার (কর্নেল থেকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত) যারা ঐ ঘটনার সময় অপারেশন প্রভাইড কমফোর্টের সাথে যুক্ত ছিল তাদের প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু প্রকৃত শাস্তি বলতে শুধু ওয়াংয়ের হয়েছিল। তাকে তিন বছরের জন্য গ্রাউন্ডেড করা হয় এবং প্রমোশন বিলম্বিত করা হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি সার্ভিসে ছিলেন বলে জানা যায়। বাকিরা অনেকেই তদন্ত শেষে অবসর নিয়ে নেন।
নিজেদের হেলিকপ্টার শুটডাউন করা সেই পাইলটের উইংম্যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল র্যান্ডি এম ওয়েকে একবারে গ্রাউন্ডেড করা হয়। তিনি আর কখনো যুদ্ধবিমান চালানোর দায়িত্ব পাননি। কেননা তিনি ইন্টারসেপ্টশনের কাজ জুনিয়র অফিসারের হাতে দিয়েছিলেন যা সিনিয়র অফিসার হিসেবে তার করার কথা ছিল। এছাড়া মিসাইল ফায়ার করার আগে নিয়ম অনুযায়ী আরেকবার ‘ন্যাশনালিটি পাস’ দেয়া উচিত ছিল। এ ঘটনার পর ইউএস আর্মি-এয়ারফোর্স সম্পর্ক কিছুটা খারাপ হয়।
পরবর্তীতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন শাখার সদস্যদের যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর জন্য একাধিক ট্রেনিং প্রোগ্রামের আয়োজন করে পেন্টাগন। তারপরও ২০০৩ সালের ২ এপ্রিল সাদ্দামের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’ পরিচালনার সময় বিপদে পড়া ইউএস আর্মির একটি ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটকে এয়ার সাপোর্ট দিতে এসে ইউএস নেভির একটি এফ-১৮ হরনেট যুদ্ধবিমানকে ভুল করে প্যাট্রিয়ট মিসাইল মেরে ভূপাতিত করেছিল ইউএস আর্মির আরেকটি ইউনিট। এ দুটি বড় ধরনের ঘটনা ছাড়াও সম্প্রতি মার্কিন সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু ফ্রেন্ডলি ফায়ারিং এর ঘটনা ঘটেছে যা বিশ্বের তথাকথিত সর্বাধুনিক সামরিক বাহিনীর সুনাম কিছুটা হলেও নষ্ট করেছে। এজন্য বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করতে যুক্তরাষ্ট্র জয়েন্ট অপারেশন কমান্ড প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে অপারেশন চালায়।
সম্প্রতি ফ্রেন্ডলি ফায়ারে সবচেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়েছে ভারত। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের সাথে আকাশযুদ্ধের সময় তাদের একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয় ও পাইলট অভিনন্দন বর্তমান আটক হন। ঐ খণ্ডযুদ্ধের সময় ভারত নিজেরাই নিজেদের একটি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার ভুলক্রমে ভূপাতিত করে। ফলে বেশ ক’জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মারা যান।