“গলি গলি ম্যায় শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়”- এটি ছিল ১৯৮৯ সালের ভারতীয় জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস বিরোধীদের একমাত্র স্লোগান। এই একটি নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটিয়েছিল। সেবার কংগ্রেস মোর্চার বিরুদ্ধে যে মোর্চাটি দাঁড়িয়েছিল, তার নাম ছিল রাষ্ট্রীয় মোর্চা। এর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কংগ্রেসেরই একসময়ের জাঁদরেল নেতা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, যাকে সবাই ভিপি সিং নামে চেনে। ভারতের ইতিহাসে আশির দশকের পট পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণটি ছিল বোফর্স কেলেঙ্কারি। বোফর্স এবি মূলত সুইডেনের একটি সমরাস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি। সুইডেনের কার্লসকোগায় অবস্থিত কোম্পানিটির রয়েছে ৩৫০ বছরের ঐতিহ্য। সপ্তদশ শতাব্দীতে একটি হ্যামার মিলকে সুইডেন রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্ত্র নির্মাণ কারখানায় রূপান্তরিত করে।
সেই বোফর্স কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, ১৯৮৬ সালে ভারতের সাথে ১,৪৩৭ কোটি রূপির সামরিক চুক্তি করার জন্য বোফর্স কর্তৃপক্ষ ও তাদের কয়েকজন দালাল মিলে ভারতের রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা মহলের কয়েকজন হোমড়া-চোমড়াদের বিভিন্নভাবে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছিল। ভারত এই চুক্তিতে বোফর্স কোম্পানির থেকে ৪১০টি হাউইৎজার কামান ক্রয় করে। এই কামানগুলোও পরে বোফর্স কামান নামে পরিচিতি পায়। ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে কামানগুলো ভারতীয় আর্মিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
থলের বেড়াল বের হয় তার বছরখানেক বাদে। দিনটি ছিল ১৯৮৭ সালের ১৬ এপ্রিল। সুইডিশ রেডিও একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রচার করে। সেই খবরে বলা হয়, বোফর্স কোম্পানি ভারতের সাথে তাদের সমরাস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করার জন্য সেদেশের উপর মহলের রাজনৈতিক ও সামরিক অফিসারদের মোটা অঙ্কের ঘুষ প্রদান করে। খবরটি মুহূর্তের মধ্যেই সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেয়। তার চারদিন বাদে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী লোকসভায় বলেন যে, এই চুক্তির জন্য কোনো প্রকার ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ করা হয়নি, এবং এখানে কোনো দালালেরও সম্পৃক্ততা নেই।
তার কয়েকমাস পরে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করা হয়। এটি একপ্রকার অ্যাডহক পার্লামেন্টারি কমিটি। এটি ভারতের সংবিধান স্বীকৃত। এই কমিটি গঠন করা হয় দুটি পর্যায়ে। প্রথমটি হচ্ছে, যখন কোনো বিল বা প্রস্তাব এক কক্ষ (লোকসভা বা রাজ্যসভা) থেকে উত্থাপিত হয় বা প্রস্তাবিত হয় এবং আরেক কক্ষ থেকে সেটি গৃহীত হয়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, দুই কক্ষের দুই প্রিজাইডিং চিফ বা অধিষ্ঠাতা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও আলোচনার মাধ্যমে এক সিদ্ধান্তে এসে জেপিসি কমিটি গঠন করতে পারে।
জেপিসি কমিটির অধিকার আছে কোনো তথ্যের জন্য দেশের যেকোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহি করানোর। জেপিসির তদন্ত প্রক্রিয়ায় বাধাদান বা অসহযোগিতামূলক আচরণ লোকসভাকে উপেক্ষার মতো অপরাধের সমপর্যায়ে ফেলা হয়। ভারতের ইতিহাসে প্রথম জেপিসি গঠন করা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে বোফর্স কেলেঙ্কারির রহস্য উন্মোচনের জন্য। তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণচন্দ্র পান্ত ১৯৮৭ সালের ৬ আগস্ট লোকসভায় জেপিসি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। তাঁর প্রস্তাব লোকসভায় গৃহীত হয়। সপ্তাহখানেক বাদে গৃহীত হয় রাজ্যসভায়।
কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় কংগ্রেসেরই আরেক রাজনীতিবিদ বি শঙ্করানন্দকে। জেপিসি মোট ৫০টির মতো অধিবেশন করে। তারপর ১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল রিপোর্ট পেশ করে। লোকসভায় সরকারপক্ষ এই রিপোর্টকে সমর্থন দিলেও বিরোধীপক্ষ তা বয়কট করে। তারা অভিযোগ তোলে, জেপিসির চেয়ারম্যান একজন কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ; কীভাবে তার পেশকৃত রিপোর্ট পুরোপুরি পক্ষপাতহীন হবে? এসব ঘটনা দিন দিন রাজীব গান্ধীর স্বচ্ছ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে মলিন করতে শুরু করে। এর মধ্যে কংগ্রেসের ভেতরে শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক গৃহযুদ্ধ।
১৯৮৪-র অষ্টম লোকসভা নির্বাচনে রাজীব গান্ধীর দল কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। সেবার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হওয়ার পরে ভিপি সিং ১৯৮৬ সালে বোফর্স কোম্পানির সাথে হওয়া সামরিক চুক্তি নিয়ে অভিযোগ তোলেন। এদিকে দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সাথে তার মত বিরোধ দেখা দিতে থাকে। একপর্যায়ে রাজীব গান্ধী তাকে মন্ত্রীসভা থেকে বহিষ্কার করে। অপমান সইতে না পেরে সিং সাহেব লোকসভার সদস্যপদ এবং কংগ্রেসের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন।
এমতাবস্থায়, তিনি আরিফ মুহম্মদ আর অরুণ নেহেরুকে নিয়ে জনমোর্চা দল গঠন করেন। তার কয়েকদিন পরে, এলাহাবাদ লোকসভা কেন্দ্র থেকে উপ-নির্বাচনে জিতে তিনি আবার লোকসভায় প্রবেশ করেন। এরপর তার গঠিত জনমোর্চা দল জনতা দলের সাথে সামিল হয়। ভিপি সিং আসার পরে জনতা দলে নতুন জোয়ার আসে। তিনি এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৮৮ সালে জনতা দলের উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক দল একটি বৃহৎ মোর্চা গঠনে এগিয়ে আসে। এদের মধ্যে ছিল তেলেগু দেশম পার্টি, অসম গণপরিষদ, দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগাম ইত্যাদি। এই মোর্চার নাম দেওয়া হয় জাতীয় মোর্চা বা রাষ্ট্রীয় মোর্চা। মোর্চার আহ্বায়ক হন ভিপি সিং। সভাপতি হন দক্ষিণ ভারতের ফিল্মস্টার এনটি রামা রাও এবং সাধারণ সম্পাদক হন হরিয়ানার পি উপেন্দ্র। পরের বছর নির্বাচনে বাম ও বিজেপির সমর্থনে কংগ্রেসকে এই মোর্চা হারিয়ে দেয়, যদিও একক দল হিসেবে কংগ্রেস পেয়েছিল বেশি আসন। বোফর্স কেলেঙ্কারিকেই জাতীয় মোর্চা হাতিয়ার বানিয়ে সেবারের নির্বাচনে জিতে যায়। ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বোফর্স কোম্পানির সাথে যেকোনো প্রকার চুক্তি সম্পাদনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
বোফর্স কেলেঙ্কারিতে গান্ধী পরিবার ছাড়াও আরো কয়েকটি পরিবারের সম্পৃক্ততার গুজব উঠেছিল। তাদের মধ্যে আছে হিন্দুজা পরিবার ও বচ্চন পরিবার। অমিতাভ বচ্চন ছিলেন রাজীব গান্ধীর ছেলেবেলার বন্ধু। রাজীবের আহ্বানে অমিতাভ কিছুকালের জন্য রাজনীতিতে এসেছিলেন। বোফর্স কেলেঙ্কারিতে বচ্চনের নাম উচ্চারিত হওয়ার পর তিনি রাজনীতি থেকে চিরকালের জন্য অবসর নেন। যাওয়ার আগে রাজনীতিকে অমিতাভ বচ্চন বলেছিলেন “গান্দিনালি”, যার অর্থ “নর্দমা”। পরে প্রমাণিত হয় যে, কেলেঙ্কারির সাথে বচ্চনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
আরেকটি পরিবার হলো হিন্দুজা পরিবার। শ্রীচন্দ হিন্দুজা, প্রকাশচন্দ হিন্দুজা ও গোপীচন্দ হিন্দুজা তিন ভাই হিন্দুজা পরিবারের তিন মহাপাত্র। তাদেরও এই কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার রব উঠেছিল, যা পরে ভুল প্রমাণিত হয়। বোফর্স কেলেঙ্কারিতে রাঘব বোয়াল যে কয়জন আছেন তারা হলেন ওত্তাভিও কুয়োতারোচ্চি, একজন ইতালীয় নাগরিক। যে ছিল এই কেলেঙ্কারির মধ্যস্থতাকারী, উইনচাড্ডা – আর্মস এজেন্ট। এস কে ভাটনগর, যিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিব। আরেকজন হলেন তৎকালীন বোফর্স চিফ মার্টিন আর্ডোব। এরাই ছিলেন এই কেলেঙ্কারির মূল হোতা।
পরবর্তীতে এদের সবার বিরুদ্ধেই সিবিআই চার্জশিট দাখিল করে। রাজীব গান্ধীর নামে করা হয়নি, কারণ তিনি তার আগেই বোমা হামলায় নিহত হন। তবুও ভারতের হাইকোর্ট রাজীব গান্ধীকে নির্দোষ বলে রায় দিয়েছিল। এতসব কেলেঙ্কারি-নথিপত্রের মধ্যে একটি জিনিস চাপা পড়ে গিয়েছিল। সেটি হচ্ছে বোফর্স কামানগুলো। ১৯৯৯-এ কার্গিল যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শক্তি অনেক গুণে বাড়িয়েছিল এই কামানগুলো। কিন্তু সেই আলোচনা কেউ করেনি। রাজনৈতিক কারণে কামানগুলো ইতিহাসের অন্তরালেই রয়ে গেল।