ক্যাথরিন দ্য গ্রেট: রাশিয়ান স্বর্ণযুগের রূপকার

১৭৬২ সালের ২৮ জুন সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্যাথরিন আলেক্সয়েভিনা জানতে পারেন তিনি পুরো রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। এক অভ্যুত্থানে তার স্বামী রাশিয়ার জার তৃতীয় পিটার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তিনি উক্ত পদে অধিষ্ঠিত হন। এই সংবাদ শোনার পর মোটেও দেরি করেননি তিনি। একপ্রকার অপ্রস্তুত হয়েই ছুটলেন বাহনের দিকে। সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে এই সংবাদ শুনে। এমনও খবর রটেছিল যে, সেদিন সকালে ক্যাথরিন এতই আত্মহারা ছিলেন যে তার ফরাসি চুল পরিচর্যাকারী লোকটিও প্রাসাদে প্রবেশ করার সময় পায়নি।

ক্যাথরিন দ্য গ্রেট; Image Source: History Extra

বাহনে চড়ে ক্যাথরিন যখন সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তা প্রদক্ষিণ করছিলেন, তখন রাস্তার দু’পাশের মানুষজন তার জয়ধ্বনি দিচ্ছিল। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে যে অভ্যুত্থানে তার স্বামী পদচ্যুত হয়েছিল সেটির নীলনকশা ক্যাথরিন নিজেই করেছিলেন। তৃতীয় পিটার সিংহসানে আরোহনের ৬ মাসের মাথায় তাকে সরিয়ে দিয়ে ক্যাথরিনের ক্ষমতা দখলের ঘটনা নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। কিন্তু এটিও সত্য যে, পিটারের সময়কালে রাশিয়া জুড়ে চলছিলো দাঙ্গাহাঙ্গামা, অভ্যুত্থান এবং অরাজকতা। প্রবল দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে দিন পার করেছিল রাশিয়ানরা।

উইন্টার প্যালেস; Image Source: Free Tour.com

এমন পরিস্থিতিতে ক্যাথরিনের ক্ষমতা দখল রাশিয়ানদের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এমন দূরবস্থা দূর করে রাশিয়াকে ইউরোপ তথা বিশ্ব শক্তিতে পরিণত করার পেছনে অবদান রাখায় পরবর্তীতে অবশ্য তাকে ‘ক্যাথরিন দ্য গ্রেট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ব্যয়বহুল জীবনযাপনের অভ্যাস, একাধিক প্রেমের সম্পর্ক কিংবা উচ্চ শিল্পের প্রতি প্রবল আগ্রহ তাকে ইউরোপের সবচেয়ে বর্ণময় সম্রাজ্ঞী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সাহায্য করেছিল। রাশিয়াকে মধ্যযুগীয় খোলস থেকে বের করে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া ‘দ্য গ্রেট’ ক্যাথরিনের উত্থান, সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

রাশিয়ান রাজপরিবারে প্রবেশের ইতিহাস

রাশিয়ানরা ক্যাথরিন আলেক্সয়েভিনাকে যতই ইতিহাসের ধারক ও বাহক হিসেবে গর্ব করুক না কেন, তার শরীরের এক ফোঁটা রক্ত রাশিয়ানদের নয়। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ২ তারিখ প্রুশিয়া কিংবা বর্তমান পোল্যান্ডের স্চুইসিনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার মা জোহানা এলিজাবেথ ছিলেন ড্যানিশ সাম্রাজ্য খ্যাত হোলস্টেইন গোত্রোপের একজন রাজকন্যা। সে হিসেবে ক্যাথরিন কিংবা তার মা কেউই অন্য ইউরোপিয়ানদের নিকট তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। কিন্তু প্রিন্সেস জোহানা এলিজাবেথ প্রচন্ড মাত্রার উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।

তরুণী ক্যাথরিন; Image Source: History Hit

সৌভাগ্যক্রমে ছোটবেলা থেকেই ক্যাথরিন ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী ও মেধাবী। তার ব্যক্তিত্ব যে কাউকে আকৃষ্ট করত। প্রুশিয়া অঞ্চলটি সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছাকাছি হওয়ায় প্রিন্সেস জোহানা যেকোনোভাবে নিজের মেয়েকে রাশিয়ান রাজপরিবারে যুক্ত করতে চেষ্টা চালিয়ে যান। ক্যাথরিনকে নিয়ে বাকবিতণ্ডা সে সময় রাশিয়ার আদালত অবধি পৌঁছায়। অতঃপর তৎকালীন সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ অব রাশিয়া অল্প বয়সী ক্যাথরিনের সঙ্গে নিজের ভাগ্নে পিটারের বাগদানের ব্যবস্থা করেন। পিটারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ক্যাথরিন রাশিয়ার রাজপরিবারে প্রবেশ করেন।

রাশিয়ানদের মাঝে প্রবেশ করে ক্যাথরিন সেকালে বিশ্বময় খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার টানাপোড়েনের সম্পর্ক লেগেই থাকত। ক্যাথরিন প্রচুর পরিমাণে সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ইতিহাস বিষয়ক বই পড়তেন। বই পড়ার খাতিরে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের সঙ্গে তার চিঠি আদান-প্রদান হতো বলেও ধারণা ইতিহাসবিদদের। অন্যদিকে, তার স্বামী পিটার ছিলেন একেবারেই অপরিণত এবং অবুঝ। ক্যাথরিন নিজেই লিখেছিলেন, সেনাবাহিনী ব্যাতীত পিটার সবসময় খেলনা পুতুল।

ক্যাথরিন ও পিটার; Image Source: Image by Bridgeman

পিটার ও ক্যাথরিনের বৈবাহিক জীবন ভয়াবহভাবে শুরু হয়েছিল। বিয়ের রাতে স্ত্রীকে নিজ কক্ষে রেখেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বাইরে চলে যান পিটার। হয়তো বা জোরপূর্বক ক্যাথরিনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তবুও পরবর্তীতে দুজনই মানিয়ে নিতে শুরু করেন। সে সময় দুজনে ভিন্নভাবে ব্যক্তিগতজীবন উপভোগ করছিলেন বলেও গুঞ্জন রটেছিল। অতঃপর ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি তৎকালীন রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী মৃত্যুবরণ করলে নিয়মানুযায়ী জার নির্বাচিত হন ক্যাথরিনের স্বামী পিটার।

সিংহাসনে আরোহনের পর পিটার তার রক্ষিতাদের মধ্য থেকে একজনকে শাসনকার্যের সহযোগী হিসেবে পাশে চাইলেন। ছাড় না দেয়ায় ক্যাথরিনের উপর নানাভাবে জোরজবরদস্তি করেন তিনি। তাদের একমাত্র পুত্র পল জন্মগ্রহণ করলেও শেষপর্যন্ত দুজনের মাঝে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। মূলত পুত্র পল পিটারের সন্তান ছিলেন না। তার বাবা ছিলেন ক্যাথরিনের গুপ্ত প্রেমিক সুদর্শন সের্গেই সালতেকভ। পরবর্তী জীবনে ক্যাথরিন নিজেই এমনটা উল্লেখ করেছেন বলে দাবি ইতিহাসবিদদের।

সেন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায় জয়োৎসব; Image Source: History Hit

পিটার যদিও রাশিয়ার জার ছিলেন, কিন্তু ক্যাথরিনের বিরুদ্ধাচরণ করায় তিনি শেষপর্যন্ত এক ভয়াবহ সামরিক অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হন। রাজনৈতিকভাবে সুকৌশলে সেনাবাহিনীর একাংশকে পিটারের বিরুদ্ধে কাজ করতে প্ররোচিত করেন ক্যাথরিন। এই কাজে তাকে সাহায্য করেন আর্টিলারি অফিসার গ্রিগরি অরলভ। পিটার শেষপর্যন্ত ঠিকই সিংহাসন ছেড়েছিলেন। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী, গির্জার ধর্মযাজক কিংবা সাধারণ মানুষ সবাই নতুন সম্রাজী হিসেবে ক্যাথরিনকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র মুকুটখানি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ক্যাথরিন চেয়েছিলেন ইউরোপের অন্যান্য পরাশক্তি, বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তার জাতিকে যথাযথ সম্মান করুক। আর এই লক্ষ্য সামনে রেখেই তিনি শাসনকার্য চালিয়ে যেতে থাকেন।

পিটারের খুনের জন্য ক্যাথরিন দায়ী!

সেকালে ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যসমূহে অভ্যুত্থান তেমন একটা প্রভাব ফেলত না। কিন্তু ১৭৬২ সালের গ্রীষ্মে সদ্য সিংহাসনের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়া জার তৃতীয় পিটারের বিরুদ্ধে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানটি গোটা ইউরোপ জুড়ে আলোচিত হয়। ক্যাথরিন জানতেন, পিটারকে সরাতে পারলে নিয়মানুযায়ী তিনিই রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী নির্বাচিত হবেন। আর এই কারণে তিনি সেনাবাহিনীর আর্টিলারি অফিসার গ্রিগরি অরলভকে দিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে অরলভ ছিলেন ক্যাথরিনের গুপ্ত প্রেমিকদের একজন।

পিটার এবং ক্যাথরিনের সঙ্গে পুত্র পল; Image Source: 
PHOTOGRAPH BY FINE ART IMAGES, HERITAGE IMAGES/GETTY

অভ্যুত্থান সফল হওয়ায় পিটারের পতন নিশ্চিত হয়। সেনাবাহিনী তাকে আটক করে রোপশা নামক গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে পিটারকে গ্রিগরি অরলভের ভাই গ্রিগরিভিচের হেফাজতে রাখা হয়। কিছুদিন পর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন পিটার। মৃত্যুর পর রাজপরিবারের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে জানানো হয় যে, তিনি হাইমোরোহাইডাল কোলিকে ভুগছিলেন। কিন্তু রাজপরিবারের কেউ কেউ এই বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। তখনি প্রশ্ন ওঠে, ক্যাথরিন এই খুনের জন্য দায়ী কি না?

অভ্যুত্থানের কারণে পিটারের পতন; Image Source: History Hit.com

উত্তর হবে, আমরা কেউই কিছু জানি না! বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ একমত যে, ক্যাথরিন তার স্বামীকে খুন করার ইচ্ছা পোষণ করলে কখনোই নির্বাসনে যাওয়ার অনুমিত দিতেন না। বরঞ্চ আইনের মুখোমুখি করে শাস্তি দিতেন। ইতিহাসবিদরা আরও মনে করেন, ক্যাথরিনের প্রেমিক অরলভ পথের কাঁটা একেবারে পরিষ্কার করার নিমিত্তে পিটারকে হত্যা করেছিলেন। হত্যাকারী যে-ই হোক না কেন, পিটারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সঙ্গে ক্যাথরিনের সিংহাসন দখল যেহেতু একসূত্রে গাঁথা, সেহেতু পিটারের মৃত্যুর দায় ক্যাথরিন কখনও এড়িয়ে যেতে পারেন না।

শাসনকার্য পরিচালনা ও ব্যক্তিগত জীবন

পরবর্তী তিন দশকে রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর শক্তিসামর্থ্য আরো বাড়িয়ে তোলেন ক্যাথরিন। পাশ্ববর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে দূর-দূরান্তের কয়েকটি সাম্রাজ্যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে ইউরোপে তোলপাড় সৃষ্টি করে রাশিয়ানরা। পূর্বদিকে পোল্যান্ডকে বিভক্ত করার পাশাপাশি লিথুয়ানিয়া এবং বেলারুশকে পরাজিত করে রাশিয়ানরা। অতঃপর দক্ষিণের অটোমানদের বিরুদ্ধাচরণ করতেও দুবার ভাবেননি ক্যাথরিন!

ক্যাথরিনের শাসনামলে রাশিয়ার মানচিত্র; Image Source: History Extra 

যদিও তুর্কিদের মোকাবেলা করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে রাশিয়ানরা। ভূমধ্যসাগরে নৌবাহিনীর অভাবে তারা তুর্কি সেনাদের বিপক্ষে সুবিধা করতে পারেনি। এই সমস্যা সমাধানে রাশিয়ান জেনারেলরা একটি দুঃসাহসী পরিকল্পনা হাতে নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় চার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ফ্রান্স ও স্পেনের পশ্চিমে অবস্থিত বাল্টিক সমুদ্র উপকূল ব্যবহার করে তুর্কিদের উপর হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ক্যাথরিন শেষপর্যন্ত এই পরিকল্পনায় সম্মত হন। ফলশ্রুতিতে ১৭৭০ সালের চেসমা যুদ্ধে জয়লাভ করে রাশিয়া। এই যুদ্ধে প্রায় ৯,০০০ তুর্কি যোদ্ধা নিহত হয়। অন্যদিকে, রাশিয়ান সেনা নিহত হয় মাত্র ৬০০ জন।

এমন আরো অনেক যুদ্ধে ক্যাথরিনের অনুগত সেনারা জয়লাভ করেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, সেনাবাহিনীর এমন প্রশংসনীয় রণকৌশলগুলোর বেশিরভাগই আসতো ক্যাথরিনের সামরিক উপদেষ্টা গ্রিগরি পোতেমকিনের কাছ থেকে। জেনারেল পোতেমকিন একদিকে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, অন্যদিকে ক্যাথরিনের সঙ্গে গোপন প্রেমের সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন। ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ‘মাই টাইগার’ সম্বোধন করে তাকে নিয়ে লিখেছিলেন ক্যাথরিন। কিন্তু তার গোপন প্রেমের সম্পর্ক এখানেই শেষ হয়নি। ধারণা করা হয়, পোতেমকিনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় ক্যাথরিন একাধিক প্রেমে লিপ্ত ছিলেন। তার প্রেমিকদের বেশিরভাগই ছিলেন সেনাসদস্য।

তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধ; Image Source: History Extra

এত এত গুঞ্জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল প্রিন্স প্লাটন জুবভের সঙ্গে ক্যাথরিনের প্রেমের সম্পর্কটি। অন্যসব ঘটনার মতো এটি গোপন রাখতে পারেননি তিনি। কারণ প্রিন্স জুবভ ছিলেন ক্যাথরিনের চেয়েও ৩৮ বছরের ছোট। তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কারণে সেকালে তরুণ প্রিন্স জুবভ হয়ে ওঠেন রাশিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুরুষদের একজন। তবে রাশিয়ার বাইরের বিখ্যাত ব্যক্তিরাও ক্যাথরিনের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। শোনা যেত, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছদ্মবেশে তাকে দেখার জন্য রাশিয়ায় গমন করতেন।

ব্যক্তিগত জীবনে এত এত আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিলেও ক্যাথরিন নিজের নীতিতে সবসময় অটুট ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন রাশিয়াকে মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা থেকে বের করে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলতে। ক্যাথরিনের মতে, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হতে দরকার ছিল রাশিয়ানদের মাঝে আলোকিতকরণের মূল্যবোধ প্রবর্তনের পাশাপাশি চারুকলার প্রচারে বিপুল অর্থ ও শক্তি বিনিয়োগ করা।

ক্যাথরিন দ্য গ্রেট; Image Source: History Hit

এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটেনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ওয়ালপোলের চিত্রকর্ম, ফ্রান্স থেকে সাংস্কৃতিক ধন-রত্ন কিনে সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করেন ক্যাথরিন। এটি প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জাদুঘর হিসেবে সুখ্যাতি না পেলেও এর দেয়ালে দেয়ালে ৩৮,০০০ বই এবং ১০,০০০ চিত্রকর্ম রাখা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, ক্যাথরিনের নির্দেশে বার্ষিক বাজেটের ১২ শতাংশ সংগ্রহশালার জন্য ব্যয় করা হত। তার এমন কার্যক্রমের জন্য অনেকে তাকে উচ্চাভিলাষী সম্রাজ্ঞী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা চিন্তা করলে দেখা যায়, তার কল্যাণেই রাশিয়ান সংস্কৃতিতে স্বর্ণযুগের শুভসূচনা ঘটেছিল।

ব্যর্থতা ও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ

ক্যাথরিন যখন সিংহাসনে আরোহন করেন তখন রাশিয়া জুড়ে ভূমি দাসদের দৌরাত্ম্য ছিলো প্রবল। প্রায় শত বছর ধরে এমনটা চলে আসছিল। এই প্রক্রিয়ায় পুরুষদের মাঝে শ্রেণীবিভক্তি তৈরি হত। বেশি জমির মালিকেরা অল্প জমির মালিকদের সাথে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করত। অতঃপর ক্যাথরিন নতুন ‘নাকাজ’ আইন পাশের মধ্য দিয়ে পুরুষদের মাঝে বিভক্তি দূর করার প্রতিশ্রুতি দেন।

ক্যাথরিন দ্য গ্রেট; Image Source: Istock.com

আইন প্রণয়ন যতটা সহজ ছিল, বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে ঠিক ততটুকু অনিয়ম দেখা গিয়েছিল। ক্যাথরিন কিংবা তার সমর্থিত প্রশাসন এই আইন অনুযায়ী রাশিয়ানদের মধ্যে চলমান বিভক্তি দূর করতে পারেননি। এতে করে ভূমি দাসদের একাংশ বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে। আর এই বিদ্রোহের সমর্থন যোগানো ইয়েমিলেয়ান পুগাচেভ নিজেকে ক্যাথরিনের বিতাড়িত স্বামী হিসেবে দাবি করে। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনাটি হাস্যকর মনে হলেও বিদ্রোহের কারণে প্রায় ১,৫০০ অভিজাত ব্যক্তিবর্গ নিহত হন। এর দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারেননি ক্যাথরিন।

এই ঘটনার পর রাশিয়ানরা ক্যাথরিনের ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পেয়েছিল। তার নির্দেশে পুগাচেভকে গ্রেফতার করে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। ভবিষ্যতে যাতে কেউ এভাবে দ্বিতীয়বার বিদ্রোহের সাহস করতে না পারে সেজন্য জনসম্মুখে পুগাচেভের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাটা হয়। অতঃপর নতুন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাশিয়ান অভিজাতদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেয় ক্যাথরিনের প্রশাসন। আজকের যুগে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার কথা প্রায়শই আলোচনায় আসে। মোটামুটিভাবে সবাই কম-বেশি বোঝে, বিশ্ব অর্থনীতি পুঁজিবাদ নীতিতেই চলছে। কিন্তু এমন সমাজ ব্যবস্থা শত বছর আগে থেকেই চলে আসছিল। শাসকরা ক্ষমতার আয়ু বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের উচ্চবিত্তদের সবরকম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। ক্যাথরিনও তাদের মধ্যে সফলতম একজন।

পতন এবং রাশিয়ার সিংহাসনের ভবিষ্যৎ

ক্রমশই ক্যাথরিন নিজের কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করেন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ায় তার একমাত্র ছেলে পলের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়। ক্যাথরিনের পর নিয়মানুযায়ী সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন তার পুত্র পল। কিন্তু ক্যাথরিন চেয়েছিলেন তার নাতি প্রথম আলেক্সান্দার পলের পরিবর্তে শাসনভার গ্রহন করুক। কিন্তু পল সেটা হতে দেননি।

ক্যাথরিনের পুত্র পল; Image Source: History Extra

১৭৯৬ সালের ১৬ নভেম্বর সেন্ট পিটার্সবার্গের উইন্টার প্যালেসে মৃত্যুবরণ করেন ক্যাথরিন। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন বলে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়। একই দিন রাশিয়ার জার হিসেবে অভিষিক্ত হন তার ছেলে পল। দায়িত্ব নিয়েই নতুন আইন প্রণয়ন করেন তিনি। এই আইন অনুযায়ী ভবিষ্যতে কোনো নারী রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী হতে পারবে না বলে জনসম্মুখে ঘোষণা দেয়া হয়।

নাতি আলেক্সান্দার; Image Source: National Geographic

কিন্তু বাবার মতো তাকেও অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়। পলের পতনের পর ১৮০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার জার হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন ক্যাথরিনের প্রিয় নাতি আলেক্সান্দার। এই ঘটনার পর অনেকেই বলাবলি করত, মৃত্যুর পরেও ক্যাথরিনের প্রভাব রাশিয়ার রাজনীতিতে বিরাজ করছে। বস্তুত এর পরের অর্ধশত বছর ধরে রাশিয়া জুড়ে ক্যাথরিনের প্রভাব ছিলো লক্ষ্যণীয়।

একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-

১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে

This article written about Catherine The Great First Woman Who Create The Golden Age Of Russia. All necessary sources have been hyperlinked.

Featured Image Source: Mental Floss.com

Related Articles

Exit mobile version