১৬১০ সালের ডিসেম্বরের প্রথমদিকে থুরজো নিজে এলিজাবেথের সাথে দেখা করেন। তবে তার মুখ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি আদায়ে ব্যর্থ হন তিনি। তবে দুর্গের আশেপাশে গ্রামবাসীরা আরো কিছু মৃতদেহ খুঁজে পেলে আবারও তার সাথে দেখা করার প্রস্তুতি নেন তিনি। এবার সঙ্গে নেন রাজা ম্যাথিয়াসকে।
অনেকে বলে থাকেন, পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে এলিজাবেথ তখন পালানোর বন্দোবস্ত করছিলেন। তার কাজিন পোলিশ রাজার কাছে আশ্রয় প্রার্থনাও করেন তিনি। তবে তার আগেই ২৪ ডিসেম্বর নৈশভোজে রাজার সামনে তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন থুরজো। এলিজাবেথ ক্রুদ্ধ হয়ে টেবিল থেকে উঠে চলে আসেন। এরপর ম্যাগেইরি আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করলেন।
২৯ ডিসেম্বর, ১৬১০।
একদল সেনা নিয়ে থুরজো, ম্যাগেইরি, পনিকেনুসজ আর বাথোরির জামাইরা জেস্থে দুর্গে প্রবেশ করল। গ্রেফতার করা হলো তাকে ও তার সহযোগী ইলোনা, ক্যাটারিনা, ডরোট্টি আর ফিকোকে। থুরজো পরে অভিযোগপত্র উল্লেখ করেন, পাতালঘরে বন্দী কয়েকজন মেয়েকে দেখতে পান তারা। একজনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বাকি দুজন মারা যায়।
বিচার
বাথোরিকে গৃহবন্দি করা হয়। ম্যাথিয়াস চাপ দেন তাকে কাঠগড়ায় তোলার জন্য। মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি যাতে তাকে দেয়া হয় সেজন্যও সুপারিশ করেন তিনি। তবে থুরজো রাজাকে বিষয়টির স্পর্শকাতরতা বোঝাতে সক্ষম হন, তাকে জানান- এমন কিছু হলে অভিজাত সম্প্রদায় রাজার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে।
তবে এলিজাবেথের সহযোগীরা তো আর অভিজাত বংশীয় নয়, তাই বলির পাঁঠা খুঁজতে বেগ পেতে হলো না। ১৬১১ সালের ২রা জানুয়ারি তাদের বিচারকদের সামনে হাজির করা হয়। প্রধান বিচারক আরো বিশজন সহকারীকে নিয়ে শুনানি করলেন।
আসামীরা ছিল ডরোট্টি জান্টেস বা ডর্কো, ইলোনা জো, ক্যাটারিনা বেনিকা আর জ্যানোস উজভারি বা ফিকো। তাদের বিপক্ষে ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছিলো প্রায় ৩০০ সাক্ষ্য। আসামীদের থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়, যা তৎকালীন নিয়মে বৈধ।
সব কথা জোড়া দিয়ে বেরিয়ে এলো গায়ে কাঁটা দেয়া এক বর্ণনা। জানা গেল- এলিজাবেথের হত্যাযজ্ঞের শুরু স্থানীয় কৃষক পরিবারের গরীব মেয়েদের দিয়ে, এরপর তিনি হাত বাড়ান অপেক্ষাকৃত অবস্থাসম্পন্ন লোকদের দিকে। বেশ কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে নিজের বিকৃত খেয়াল চরিতার্থ করতে অনেক মেয়েকে অপহরণ করেও নাকি হত্যা করেছেন তিনি। নিজ দুর্গেও জোরপূর্বক ধরে এনেছেন অনেককে।
কয়েকজন সাক্ষী দাবি করেন, এলিজাবেথ নাকি তার মেয়েদেরও এই শিক্ষা দিয়েছেন। বলা হয়- তার ছোট মেয়ে ক্যাটালিনকে বিয়ে দেবার আগে হাতে-কলমে নাকি তাকে নির্যাতন আর খুনের সবক দিয়েছেন তিনি। একজন সাক্ষী উল্লেখ করেন, মা-মেয়ে মিলে দুজন দরিদ্র মেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে, যদিও তার তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কিন্তু শক্ত ছিল না। গির্জার কর্মকর্তারা, যারা মৃতদেহ কবরস্থ করার সাথে জড়িত, তাদের কথায় জানা যায়, দুর্গ থেকে কোন মৃতদেহ এলে মৃত্যুর সুস্পষ্ট কোনো কারণ জানানো হতো না, তবে তারা মারপিটের চিহ্ন দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন।
ফিকো প্রায় ষোল বছর এলিজাবেথের ঘরে কাজ করেছিল। সে জানায়, ৩৭ জন মেয়েকে কর্ত্রীর আদেশে হত্যা করা হয়েছে। ইলোনা কাজ করেছিলেন দশ বছর, তিনি আবার ৫০ জনের কথা উল্লেখ করেন। ডর্কোর হিসেবে সেই সংখ্যা ছিল ৩৬। তবে সে দাবি করে তাকে এ কাজে বাধ্য করা হয়েছে। চারজনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ক্যাটারিনাও একই কথা বলে। ঐতিহাসিক কিম্বার্লি ক্র্যাফটের মতে, ক্যাটারিনা নাকি চার সহযোগীর মাঝে সবচেয়ে কম অত্যাচার করেছিল বলে রেকর্ডে উল্লেখ আছে, পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত।
বিচার-আচার শেষ হলে বাথোরির বিরুদ্ধে ৮০ জন মেয়েকে খুনের অভিযোগ আনেন থুরজো। ওদিকে তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয় ৭ জানুয়ারি। জেস্থে দুর্গের কাছেই নির্মাণ করা হয় মঞ্চ, সেখানে ইলোনা আর ডর্কোকে প্রকাশ্যে নির্যাতন করে আগুনে ফেলে দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে কাউন্টেসের নির্দেশ পালন করেছে বিধায় ফিকোকে নির্যাতন করা হয়নি, তার দণ্ড কার্যকর করা হয় শিরশ্ছেদ করে। ক্যাটারিনার স্থান হয় কারাগারে, তার শেষ পরিণতি অজানা।
মাজেরোভার ব্যাপারে যদিও থুরজো সরাসরি কোনো অভিযোগ পাননি, তবে তার প্ররোচনাতেই এলিজাবেথ এসব কাণ্ড করেছেন বলে অনেকেই বলতে থাকে। ডাইনী অপবাদও তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এলিজাবেথের সহযোগীদের প্রাণদণ্ডের দু’সপ্তাহ পরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারের ঝামেলায় না গিয়ে মধ্যযুগীয় রীতি মোতাবেক তাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে লোকেরা। বাথোরি কিন্তু সবসময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। কয়েকবার রাজার কাছে চিঠি লিখে তাকে মুক্তি দিতেও অনুরোধ করেন তিনি। ম্যাথিয়াস তাতে কর্ণপাত করলেন না।
জেস্থে দুর্গের একটি ঘর ছিল এলিজাবেথের কারাগার। প্রহরীরা দরজার নিচ দিয়ে খাবার ঠেলে দিত ঘরে, পারতপক্ষে কোনো কথা তাদের সাথে বলতেন না তিনি। একপর্যায়ে উইল করে সব সম্পত্তি সন্তানদের নামে লিখে দেন তিনি। ১৬১৪ সালের ২১ আগস্ট তাকে মৃত পাওয়া যায়। তার পাশেই পড়ে ছিল স্পর্শ না করা কয়েক প্লেট খাবার, ফলে ঠিক কোন সময় তিনি মারা গেছেন তা নির্ণয় করা যায়নি। নভেম্বরের ২৫ তারিখে তাকে ক্যাচটিস গ্রামের চার্চে প্রথমে সমাধিস্থ করা হয়, কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিবাদের মুখে মৃতদেহ সরিয়ে নেয়া হয় উত্তর-পূর্ব হাঙ্গেরির শহর নাগিক্সেডের (Nagyecsed) পারিবারিক গোরস্থানে। তবে ১৯৯৫ সালে কবর খুলে সেখানে তার দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি।
ব্লাড কাউন্টেসের কিংবদন্তি
এই পর্যন্ত কাউন্টেস এলিজাবেথ বাথোরিকে সিরিয়াল কিলার হিসেবেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তার সাথে ব্লাড কাউন্টেসের তকমা সেঁটে গেল কীভাবে?
থুরজো রাজনৈতিক স্বার্থে বাথোরির কাহিনী অনেকটাই ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছিলেন। আদালতের অনেক নথিও কালক্রমে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে জনসমক্ষে বড় আকারে এই ঘটনা প্রকাশিত হতে সময় লেগে যায় শ’খানেক বছর। হাঙ্গেরিয়ান এক জেসুইট পণ্ডিত, লাসজলো টুরোকজি (László Turóczi) বইয়ের পাতায় সর্বপ্রথম এলিজাবেথের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে আনেন তার ট্র্যাজিকা হিস্টোরিয়া (Tragica Historia) গ্রন্থে।
লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে এই কাহিনী। দ্রুতই শাখা-প্রশাখা গজিয়ে সত্যি আর মিথ্যা একাকার হয়ে যায়। জনশ্রুতি রটে যায়- যৌবন ধরে রাখার জন্য কাউন্টেস কুমারী মেয়েদের হত্যা করে তাদের রক্ত দিয়ে গোসল করতেন।
কিন্তু এভাবে বয়স আটকে রাখা যাবে এই প্রেসক্রিপশন এলিজাবেথকে কে দিল? অত্যুৎসাহী মানুষেরা এরো এক ব্যাখ্যা দাঁড়া করান। বলা হয়, রাগের মাথায় এক গৃহকর্মকে মেরেই ফেলেছিলেন কাউন্টেস। তার চোখে-মুখে এর ফলে রক্তের ছিটে পড়েছিল, তিনি নাকি দেখতে পান সেই জায়গার ত্বক সুঠাম আর সুন্দর হয়ে উঠেছে। এলিজাবেথ এরপর থেকে রক্ত দিয়ে গোসল করা শুরু করেন। এই থেকেই তার নাম হয়ে গেল ব্লাড কাউন্টেস। পরবর্তীতে কেউ কেউ এক পা এগিয়ে তাকে কাউন্ট ড্রাকুলার জ্ঞাতিগোষ্ঠীও বানিয়ে ফেলেন। অনেকে তো এমনও বলে থাকেন- ব্রাম স্টোকার নাকি এলিজাবেথের কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়েই ড্রাকুলার চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন!
ঠিক কতজন মেয়ে মারা গিয়েছিল এলিজাবেথ আর তার সহকারীদের হাতে? এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে রূপকথা আর ইতিহাস। বিচার চলাকালে তার সহকারীরাই সর্বোচ্চ ৫০ জনকে হত্যার কথা জানিয়েছিল, তবে মনে রাখতে হবে- এই স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল নির্যাতনের মাধ্যমে। দুর্গের অন্য কর্মচারীরা ১০০-২০০ মৃতদেহ বিভিন্ন সময়ে দেখার কথা জানায়। আদালতে এক সাক্ষী সরাসরি বলে বসেন ৬৫০ মেয়ের কথা, তিনি দাবি করেন- এলিজাবেথের কাছে থাকা ডায়রিতে এতগুলো নামই লেখা ছিল। যদিও এই ডায়েরির অস্তিত্বও নিঃসন্দেহ নয়।